আর্ট মার্কেটের গোপন রহস্য দাম নাকি গুণ, কী বানায় মাস্টারপিস? একটা চিত্রকর্ম বিখ্যাত হওয়ার পেছনে কি শুধু শিল্পগুণ কাজ করে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকে? এই নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
ইতিহাসের হাত ধরে বিখ্যাত হয়ে ওঠা
শিল্প মানেই কি শুধু শিল্পীর প্রতিভা? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে থাকে ক্ষমতা, রাজনীতি, আর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার গভীর প্রভাব? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অনেক বিখ্যাত চিত্রকর্ম শুধুমাত্র শিল্পীর প্রতিভার জোরে নয়, বরং রাজা-বাদশাহদের দাক্ষিণ্যের কারণেও বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ কিংবা ডিয়েগো ভেলাসকেজের ‘লাস মেনিনাস’ এসব মাস্টারপিস আজ যতটা বিখ্যাত, তার পেছনে রয়েছে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার বড় ভূমিকা।
আজকের দিনে ‘মোনালিসা’ মানেই বিশ্বব্যাপী আলোড়ন, কিন্তু এটি যদি সাধারণ কোনো ব্যক্তির ঘরে পড়ে থাকত, তাহলে কি এতটা বিখ্যাত হতো? এই পেইন্টিং প্রথম থেকেই বিখ্যাত ছিল না। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি যখন এটি আঁকেন, তখন এটি ছিল কেবল একটি ব্যক্তিগত পোর্ট্রটে, যা ফ্লোরেন্টাইন বণিক ফ্রান্সেস্কো দেল জিওকন্দোর স্ত্রীর ছবি। কিন্তু দা ভিঞ্চি ফ্রান্সে পাড়ি জমানোর পর, রাজা ফ্রাঁসোয়া প্রথম এটি কিনে নেন এবং ল্যুভ্রের রাজকীয় সংগ্রহে যুক্ত করেন। রাজপরিবারের সংগ্রহে থাকার কারণে ‘মোনালিসা’ ধীরে ধীরে মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর ঐতিহাসিক মূল্য, রাজকীয় পরিচিতি এবং পরে নেপোলিয়নের মতো ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় এটি শুধুমাত্র একটি চিত্রকর্মের চেয়ে অনেক বেশি কিছু হয়ে ওঠে।
শুধু ‘মোনালিসা’ নয়, অনেক মহান শিল্পীর সাফল্যের মূলেও রয়েছে রাজা-বাদশাহদের হাত। রেনেসাঁর বিখ্যাত শিল্পী স্যান্ড্রো বোত্তিচেল্লি, রাফায়েল, এবং মাইকেলেঞ্জেলো এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। বোত্তিচেল্লির ‘বার্থ অফ ভেনাস’ ছিল মেডিচি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত, যারা তখন ইতালির অন্যতম ক্ষমতাশালী পরিবার ছিল।
রাফায়েল তার ক্যারিয়ারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন পোপের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায়।
মাইকেলেঞ্জেলোর ‘সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদচিত্র’ যদি পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয়’র নির্দেশে আঁকা না হতো, তাহলে হয়তো এত বিখ্যাত হতো না।
অনেক রাজকীয় সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে জাতীয় মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। যেমন, ল্যুভ্র মিউজিয়াম এক সময় ছিল ফ্রান্সের রাজাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। ফলে এখানে থাকা সব চিত্রকর্ম স্বাভাবিকভাবেই প্রচারের আলোয় আসে। রাজাদের সংগ্রহের মর্যাদা এবং মিউজিয়ামে সংরক্ষণের কারণে এ ধরনের পেইন্টিংগুলো ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকে।
রাজা-বাদশাহদের সঙ্গে যুক্ত থাকলে চিত্রকর্মের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়, কারণ এটি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক ঘটনার অংশ হয়ে ওঠে। যেমন, ভেলাসকেজের ‘লাস মেনিনাস’ স্পেনের রাজপরিবারের কাহিনির সঙ্গে মিশে আছে, যার ফলে এটি শুধুমাত্র একটি মাস্টারপিসই নয়, বরং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
যদিও আজ আর আগের মতো রাজা-বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতা নেই, তবে ধনকুবের সংগ্রাহক, করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় গ্যালারি এখন সেই জায়গা দখল করেছে। জেফ কুনস, ড্যামিয়েন হার্স্ট বা তাকাশি মুরাকামির মতো শিল্পীরা আজকের যুগে ধনী পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থন পেয়েই আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন।
শিল্প ইতিহাসে রাজাদের ভূমিকা যে বিশাল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু প্রতিভা
থাকলেই যথেষ্ট নয় সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রচার এবং রাজনৈতিক সংযোগও অনেক চিত্রকর্মকে অমর করে তুলেছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির হাতে আঁকা ‘মোনালিসা’ যদি কোনো সাধারণ ব্যক্তির ঘরে পড়ে থাকত, তাহলে কি এটি আজকের মতোই আলোচিত হতো? হয়তো না। তাই বলা যায়, রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা শুধুমাত্র শিল্পকে রক্ষা করেনি বরং অনেক শিল্পকর্মকে ইতিহাসের সেরা আসনে বসিয়ে দিয়েছে। বিপ্লবী নতুন ধারা : কিছু শিল্পকর্ম একেবারে নতুন স্টাইল বা ভাবনার জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ভ্যান গঘের ‘স্টারি নাইট’ বা পিকাসোর ‘গুয়েরনিকা’। এগুলো শুধু ছবি নয়, একটা নতুন যুগের ঘোষণা।
কেলেঙ্কারি ও কন্ট্রোভার্সি : ১৯১১ সালে যখন ‘মোনালিসা’ চুরি হয়, তখন পর্যন্ত এটা সাধারণ দর্শকদের কাছে তেমন পরিচিত ছিল না। কিন্তু চুরি হওয়ার পর ব্যাপক সংবাদ প্রচার এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় পেইন্টিং বানিয়ে দেয়। আর্ট মার্কেটের কারসাজি কে দাম বাড়ায়?
নিলামঘরের চালাকি, আর্ট ইনভেস্টমেন্ট এবং মিডিয়া ও পপ কালচারের প্রভাব এই তিনটি বিষয় শিল্পবিশ্বের দিক থেকে গভীরভাবে সম্পর্কিত। আসুন, এই বিষয়গুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করি।
নিলামঘরের চালাকি
বিশ্ববিখ্যাত নিলামঘর যেমন ‘সথবি’ এবং ‘ক্রিস্টি’ পেইন্টিংয়ের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালায়, যা কখনো কখনো কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। পেইন্টিংয়ের দাম যদি খুব বেশি হয়, তবে তা কেবল শিল্পের বিশুদ্ধ মূল্য নয়, বরং তা বাজারের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে ‘ সালভাদর মুন্ডি’ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটি নকল পেইন্টিং ছিল, যা ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল, যা এক ধরনের বিপুল বাজারচলতি কৌশল ছিল। পেইন্টিংয়ের মূল্য বাড়ানোর জন্য শিল্পকর্মটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিশাল বিপণন প্রচার করা হয়, যেখানে শিল্পের ঐতিহাসিক মূল্য এবং কাল্পনিক গল্পের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা হয়।
কালেক্টরদের ‘আর্ট ইনভেস্টমেন্ট’
শিল্প আর্ট কালেকশন এবং বিনিয়োগের মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে, বিশেষত যখন এটি কিছু ধনী কালেক্টরদের জন্য একটি শেয়ারবাজারের মতো ‘ফাইন্যান্সিয়াল পণ্য’ হয়ে দাঁড়ায়। এই কালেক্টররা শুধুমাত্র শিল্পের সৌন্দর্য উপভোগ করেন না, তারা এটি একটি বিনিয়োগ হিসেবে দেখেন। অনেক সময় এমন হয় যে, শিল্পকর্মটির প্রকৃত মূল্য তার ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক গুরুত্বের থেকে অনেক বেশি হয়। এই প্রক্রিয়াটি শিল্প বাজারকে কিছুটা অস্পষ্ট এবং অপ্রত্যাশিত করে তোলে, যেখানে শুধুমাত্র সৃষ্টির মূল্যই নয়, বরং সেই শিল্পকর্মের বাজারে প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মিডিয়া ও পপ কালচারের প্রভাব
শিল্পকর্মের বিখ্যাত হওয়া অনেকটাই নির্ভর করে তার মিডিয়া কাভারেজ এবং পপ কালচারাল রেফারেন্সের ওপর। একটি পেইন্টিং যদি সিনেমা, বই বা গসিপের অংশ হয়ে যায়, তবে তার বিখ্যাত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। পপ কালচারের এই প্রভাব অনেক সময় শিল্পের মূল অঙ্গীকার এবং মানের সঙ্গে আপস করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘মোনালিসা’র হাসির রহস্য নিয়ে শত শত গবেষণা হয়েছে, যা আজও পৃথিবী জুড়ে আলোচিত হয় এবং এটি আরও মিথিক্যাল ও ভুতুড়ে তকমা অর্জন করে। মিডিয়া এবং পপ কালচার এই ধরনের পেইন্টিংগুলোকে শুধু একটি কাজ হিসেবে নয়, বরং তা হয়ে ওঠে এক ধরনের ব্র্যান্ড। এগুলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, শিল্পকর্মের বাজার, মূল্য এবং জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র সৃষ্টির সৌন্দর্য বা সাংস্কৃতিক তাৎপর্য থেকে তৈরি হয় না, বরং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিল্পের আসল মূল্য কী এবং তার মূল্যায়ন কেন কখনো কখনো বাজারের ভিত্তিতে হয়ে থাকে এটি একটি জটিল এবং বিতর্কিত বিষয়। এখানে একাধিক দিক থেকে শিল্পের মূল্য এবং তার বিখ্যাত হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
শিল্পের আসল মূল্য
শিল্পের আসল মূল্য নির্ধারণের কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই, কারণ এটি বহু বিষয়ে নির্ভর করে:
সাংস্কৃতিক মূল্য : শিল্পকর্মটি যদি সমাজ, ইতিহাস বা সংস্কৃতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, তবে তার সাংস্কৃতিক মূল্য অত্যন্ত বেশি। এই ধরনের শিল্পকর্ম ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।
প্রযুক্তিগত বা সৃজনশীল মূল্য : অনেক শিল্পকর্ম তার সৃজনশীলতা বা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে মূল্যবান। যেমন, মোনালিসা -এর আঁকার স্টাইল এবং রেনেসাঁর যুগের শৈলী তাকে এক অনন্য স্থান দিয়েছে।
ঐতিহাসিক মূল্য : শিল্পকর্মের ইতিহাস এবং স্রষ্টার জীবনও এর মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, ভ্যান গঘ-এর শিল্পকর্ম যখন বিক্রি হয়নি, তখন তার কাজের মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর এবং তার জীবনের সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তার কাজ এখন বিশ্বব্যাপী অমূল্য হয়ে উঠেছে।
শিল্পকর্মের দাম এবং খ্যাতি
একটি চিত্রকর্ম কখনো কখনো শুধুমাত্র তার মূল্য বা দাম বাড়ানোর জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে, বিশেষত যদি তা নিলামঘর বা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। দাম বাড়ানোর পেছনে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়, যা বাজারের মধ্যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে এবং কালেক্টরদের মধ্যে আগ্রহ জাগায়। তবে কিছু শিল্পকর্ম তার গুণমান বা ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই বিখ্যাত হয়। ভ্যান গঘ যেমন, তার জীবদ্দশায় বিক্রি হয়নি, কিন্তু তার কাজের শিল্পগুণ, আবেগ এবং সংস্কৃতির ওপর প্রভাবের কারণে পরে তার কাজ কোটি কোটি ডলারে বিক্রি হয়েছে। আবার, কিছু শিল্পকর্ম শুধুমাত্র বাজারের চাহিদার কারণে দাম বাড়িয়ে বিখ্যাত হয়ে যায়, যেমন সমসাময়িক শিল্পী যারা তাদের কাজকে এক চমৎকার বাজারি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
মিডিয়া, সিনেমা, গসিপ বা ফ্যাশন শিল্পের প্রতি আগ্রহ তৈরি করে এবং এটি শিল্পকর্মের বিখ্যাত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। যেমন, কিছু পুরনো চিত্রকর্ম আজও পপ কালচারের অংশ হয়ে উঠেছে এবং তাদের বিখ্যাত হওয়ার পেছনে মূলত মিডিয়ার প্রভাব রয়েছে।
যতটা সম্ভব, এটা বলা যেতে পারে যে, সমস্ত শিল্পকর্ম বিখ্যাত হতে পারে না। অনেক কাজ আজও অবহেলিত এবং হারিয়ে গেছে, কারণ তাদের বাজারে চাহিদা নেই, অথবা তারা কখনো মিডিয়ার দৃষ্টিতে আসেনি। শিল্পের বাজার এবং তার গুণের সংমিশ্রণই ঠিক করে কোন শিল্পকর্ম জনপ্রিয় হবে এবং কোনটা অদৃশ্য হয়ে যাবে।
শিল্পের আসল মূল্য কখনো শুধুমাত্র দামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এর মূল্য সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং সৃজনশীল দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ধারিত হয়। তবে বাজার, মিডিয়া, নিলামঘর এবং কালেক্টরদের সম্মিলিত প্রভাবই অনেক সময় একটি চিত্রকর্মকে বিখ্যাত এবং মূল্যবান করে তোলে, যা পরবর্তী সময়ে শিল্পের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়।