বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সাটুরিয়া ভূমি অফিসে ভোগান্তি, টাকা ছাড়া মেলে না সেবা

আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:২৭ পিএম

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলা সহাকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস যেন ভোগান্তির অপর নাম। অভিযোগ উঠেছে, নামজারি, মিসকেসসহ বিভিন্ন সেবার জন্য বাড়তি টাকা দিলেই ২০-৩০ দিনের মধ্যেই মিলে সেবা। আর টাকা না পেলে বছরের পর বছর ঘুরেও কাজ হয় না।

সরেজমিনে সাটুরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে বুধবার সকাল থেকে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের অবস্থান করতে দেখা যায়। প্রতি বুধবার এখানে বিভিন্ন শুনানির দিন ধার্য করা হয়। ফলে সকাল থেকেই ভূমি অফিসের গোলচত্বর ও অফিস আঙ্গিনায় শতাধিক মানুষের জটলা ছিল। অনেকে অপেক্ষায় ছিলেন কখন শুনানির জন্য ডাক আসে। কিন্তু অভিযোগ আছে, সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর আহমদ অফিসে এসে চা, নাস্তা খাওয়ার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রুমে বসে থাকেন। তার দপ্তরে যেতে গ্রাহকের ১ থেকে ২ ঘণ্টা বাইরে অপেক্ষা করতে হয়।

দুপুর ১২টার দিকে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) জানান বুধবার ২৫টা শুনানি রাখা হয়েছে। তবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ৫টি শুনানি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী, এমনকি সহকারী কমিশনারের (ভূমি) চালকের সাথে একটি শক্তিশালী দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। নামজারির ডিসিআর কাটতে সরকারি ফি লাগে মাত্র ১১০০ টাকা। কিন্তু ঝামেলা ছাড়া নামজারি বা জমির খারিজ করতে প্রতিটির জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা নেয় দালালরা। আবার কোন ওয়ারিশ কিংবা রেকর্ডমূলে ঝামেলা থাকলে প্রতি শতাংশ জমির জন্য ১- ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।

দালাল ছাড়া নামজারি/ খারিজের জন্য অনলাইনে আবেদন করলে সেটা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার তদন্ত শেষে আসে উপজেলা ভূমি অফিসে। কিছুদিন পর দালালের মাধ্যমে তদবির না করলে সেটা কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হয়। আর নির্দিষ্ট সিন্ডিকেট বা দালালকে বাড়তি টাকা দিলেই আবেদনের ২৮ দিনের মধ্যেই নামজারি হয়ে যায়।

বুধবার সাটুরিয়া ভূমি অফিসে আসা দরগ্রাম ইউনিয়নের আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ১৫ বছর আগে একটি জমি কিনেছি। যার থেকে কিনেছি তার নামে খারিজ করা। পরে আমার নামেও খারিজ করেছি। কিন্তু আমার খারিজের বিরুদ্ধে আরেকজন টাকা দিয়ে মিসকেস করেছে। তিনবছর ধরে শুনানিতে অংশ নিলেও আমাকে মুক্তি দিচ্ছে না।’ 

ফুকুরহাটি ইউনিয়নের আব্দুস সামাদ সামু বলেন, ‘আমি যার কাছে জমি কিনেছি আরএস রেকর্ডে তার নাম নাই। এ নিয়ে মানিকগঞ্জের জজ কোর্টে মামলা করি। এতে আমি রায় পাই। এর মধ্যে আমার কেনা জমি আরেকজনের নামে খারিজ করে দিয়েছে। আমি ওই ভূয়া খারিজের নামে মিসকেস আবেদন করি ১০ মাস আগে। এখন টালবাহানা করছে।’

বালিয়াটি ইউনিয়নের গর্জনা গ্রামের ইমারত হোসেন বলেন, ‘আমি জমি কিনি ১৪ শতাংশ দুই দাগ থেকে। জমির পূর্বমালিক আলকাছ আলীর আছে ৯ শতাংশ। কিন্তু খারিজ করে নিয়েছে ১২ শতাংশ। আমি অনলাইনে নামজারি আবেদন করতে গেলেও নিচ্ছে না। জমির দলিল আছে, পর্চা আছে। কিন্তু আমি জমি খারিজের জন্য আবেদন করতে পারছি না। আমার প্রশ্ন রেকর্ডমূলে মালিকের আছে ৯ শতাংশ। তাকে কিভাবে ১২ শতাংশ জমি খারিজ দিল?’

শুনানিতে আসা গর্জনা গ্রামের আব্দুল মজিদ বলেন, ‘গর্জনা মৌজায় পৈতৃক সূত্রে জমির মালিক হচ্ছি ৯.৭৫ শতাংশের। অনলাইনে আবেদন করি। কিন্তু খারিজ করার পর দেখি ১৩ শতাংশ। আমি আমার ওয়ারিশদের ঠকাব না। এখন উল্টা মিসকেসের আবেদন করছি বাকি জমি ফেরত দিয়ে সংশোধন করার জন্য। ঢাকায় একটি অফিসে জব করি। দিনের পর দিন ঢাকা থেকে সাটুরিয়ায় আসতে ভাল লাগে না।’ 

পূর্ব কুষ্টিয়া গ্রামের একই মৌজার মিস কেস নং ৭৬/২৩-২৪-এর বিবাদী শুকুর আলী বলেন, ‘আমার কোর্ট থেকে রায় আছে, নামজারি করা আছে। তারপরও সাহিদা আক্তার নামে একজন মিসকেসের আবেদন করেছেন। সেটা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমলে নিয়েছেন। দলিলসহ বিভিন্ন প্রমাণ থাকার পরও আমাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে না। টাকা ছাড়া তো এমন হয়রানি করার কথা না।’ 

ফুকুরহাটি ইউনিয়নের শেখ রহম আলী বলেন, ‘আমি ১৯৭৩ সনে পৌনে ১০ শতাংশ জমি কিনি। নানা কারণে এতদিন খারিজ করতে পারি নাই। এখন জানতে পারলাম আমার জমি আরেকজন খারিজের আবেদন করেছে। যার আবেদন নম্বর ১১৬১৭৯৩০, ৪৪২৭/২৪-২৫। আমি এর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে অনুমোদন না দেওয়ার জন্য আবেদন করি ০৭-০৪-২০২৫ তারিখে। সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তরে দেখা করতে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। তারপরও এসেছি। এ মাসে ৩-৪ বার দেখা কইরাও কোন কাজ হয় নাই। আমার প্রতিপক্ষ মোটা অংকের টাকা দিয়ে খারিজ করে নিবে বলে আমাকে হুমকি দিচ্ছে। পরে সাংবাদিকদের অবস্থান দেখে আমাকে বলছে, বিষয়টি দেখে আবেদন বাতিল করব।’

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সাটুরিয়া উপজেলা ভূমি অফিস পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, যে কোন সেবা নিতে গেলে হয়রানি করা হয়। পরে দালালের মাধ্যমে গেলে তা নিদিষ্ট সময়ের আগেই করে দেওয়া হয়। প্রথমে কম্পিউটার দোকান থেকে জমি খারিজের আবেদন করা হয়। সেটা দালাল ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে দিয়ে অনুমোদন করে উপজেলায় নিয়ে আসেন। কিন্তু টাকা লেনদেন হয় গোপনে। টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে আবেদন নম্বর লিখে রাখা হয়। সেটি সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে অফিসের স্টাফ সরবরাহ করলে তিনি খারিজের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। এমনভাবে এ অফিসের সকল কাজ এখন দালালের মাধ্যমেই সম্পাদন করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর আহমদ বলেন, তদন্তের স্বার্থে মিসকেসের রায় ধীরে দিই। দ্রুত করলে ভুল হলে গ্রাহকরা উচ্চ আদালতে গিয়ে হয়রানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

টাকা ছাড়া নামজারি হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংবাদকর্মীরা সহযোগিতা করলে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
 
এদিকে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে দুদকের অভিযান চান অনেক ভুক্তভোগী। দালাল ও সিন্ডিকেটমুক্ত অনলাইনে সকল নাগরিক সুবিধা পাবেন এমন চাওয়া সাটুরিয়ার লাখো মানুষের। 

 

 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত