ফেনী সদর উপজেলার ভালুকিয়া গ্রামের প্রতিবেশী এক ছেলের সঙ্গে দুই বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল স্কুলপড়ুয়া ১৪ বছরের এক কিশোরীর। গত ৫ এপ্রিল কিশোরী বাসা থেকে পালিয়ে ছেলেটিকে বিয়ে করে। পরে তারা ঢাকায় চলে যায়। মেয়ের মা প্রতিবেশী ছেলে ও তার মা-বাবাকে অপহরণ করেছে মর্মে পরদিনই স্থানীয় পুলিশকে অভিযোগ দেয়। অপহরণের মামলার আসামি হিসেবে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে হাজির করা হলে আদালত ছেলেটিকে কারাগারে এবং মেয়েটি পরিবারের কাছে যেতে না চাইলে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এমনই অসম প্রেমে ফেনীতে গত তিন মাসে শতাধিক কিশোর-কিশোরী ঘর ছেড়ে নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ জনকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ফেনী কোট ইন্সপেক্টর মাজহারুল করিম জানান, তিন মাসে ফেনীতে ২৭ মামলায় ১৮ জনকে কোর্টের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ও ৪ জনকে চট্টগ্রাম শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) পাঠানো হয়েছে।
ফেনী পুলিশ সুপার অফিসের অপরাধ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত তিন মাসে ফেনীতে ৩৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ও ১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
ফেনী মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সামসুজ্জামান জানান, রমজান মাসে (মার্চ) থানায় ২৪ জন কিশোরী ও ৭ জন কিশোরের নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছিল। তারমধ্যে ১৭ জন কিশোরী ও ৭ জন কিশোরকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার কিশোরীদের মধ্যে বেশিরভাগই নিখোঁজে প্রেমঘটিত কারণ ছিল। এছাড়া বিভিন্ন মাদ্রাসা পড়ুয়া ৭ জন শিক্ষার্থীর নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছিল। তাদেরও পুলিশ উদ্ধার করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের পাঠানবাড়ি সড়কের এক কিশোরীর অভিভাবক বলেন, আমার মেয়ে শহরের একটি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। গত ৩০ মার্চ দুপুরে আমাদের অগোচরে মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে থানায় জিডি করলে দুইদিন পরে পুলিশ ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে মেয়েকে উদ্ধার করে। তখন জানতে পেরেছি পাশের বাসার সমবয়সী এক ছেলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপপরিদর্শক আলমগীর বলেন, সম্প্রতি এমন দুটি উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিলাম। যেখানে ফেসবুক, টিকটক ও ফ্রি-ফায়ার গেমস খেলতে গিয়ে ছেলে-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ঘর ছাড়ার পর মেয়ের পরিবার সাধারণ ডায়েরি করলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।
ওসি সামসুজ্জামান বলেন, প্রতিদিনই কিশোর-কিশোরীর খোঁজে সাধারণ ডায়েরি হচ্ছে। যেখানে বেশিরভাগই প্রেমঘটিত বিষয়। যাদের প্রত্যেকের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে হযে থাকে। এসব বিষয়ে অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ফেসবুক, টিকটক ব্যবহার থেকে সন্তানদের দূরে রাখতে হবে।
ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, সাধারণত অপহরণের মামলা হয় মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে। মামলায় আদালত ছেলেকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন এবং মেয়ের কাছে জানতে চান সে কোথায় যেতে চায়। যেহেতু মা–বাবার অমতে বিয়ে, তাই মেয়েরা নিজের পরিবারে ফিরতে অসম্মতি জানায়। আবার অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাকে নিজের জিম্মাতেও ছেড়ে দিতে পারেন না আদালত। এ অবস্থায় মেয়েকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক ফেনী জেলার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, কম বয়সে আবেগের বশে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা ভুল করে। সেই ভুলের মাশুল দিতে হয় মেয়েদের। অনেক মেয়ের পড়াশোনা আর এগোয় না। কম বয়সে মা হয়ে যায়। স্বাবলম্বী হওয়ার যে সম্ভাবনা তাদের মধ্যে ছিল, তা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যায়।
ফেনী সরকারি জিয়া মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, মেয়েরা বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে জানে না, আইন সম্পর্কে ধারণা নেই, অপরিপক্বতার কারণে ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলে কী কী ধরনের বিপদের মধ্যে পড়তে পারে, সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই। শুধু কম বয়সের আবেগ ও সাময়িক উত্তেজনা থেকে তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর-ফেনীর উপপরিচালক নাসরিন আক্তার বলেন, পিতা মাতাদের এ অবস্থায় কৌশলী হতে হবে। ছেলেটি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করে মেয়েটিকে পড়াশোনার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। মেয়েটিকে বলতে হবে, তোমার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমরা একমত নই। তবে তুমি আগে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াও। এরপর তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ো কাকে বিয়ে করবে। মা-বাবাকে সতর্কতার সঙ্গে মেয়ের ওপর নজর রাখতে হবে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় যায় খেয়াল রাখতে হবে। পড়াশোনার অজুহাত দিয়ে মোবাইল ব্যবহার সীমিত করতে হবে। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তুলে মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে।
ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, অভিভাবকের অমতে বিয়ে করা কিশোরীদের ৯৫ শতাংশই ছাত্রী। প্রতিবেশী, খালাতো-মামাতো ভাই, শিক্ষক ইত্যাদি সর্ম্পকের ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থেকে তারা আইনি জটিলতায় পড়ে যায়। কেন্দ্রে এখন এমন ৪০ জন নিবাসী রয়েছে, যারা অভিভাবকের অমতে বিয়ে করেছে। তিনি বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে আইনসিদ্ধ নয়। আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত না নিয়ে তারা যেন পড়াশোনা অব্যাহত রাখে।