কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটি আসন্ন বাজেটের মূল লক্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘কৃষি-শিল্প-পাট-সুন্দরবন ও প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষায়’ বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে জানানো হয়েছে।
বুধবার (১৪ মে) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সাধারণ সম্পাদক নারীনেত্রী সুতপা বেদজ্ঞ।
সুতপা বেদজ্ঞ বলেন, সরকার আসন্ন বাজেটে কৃষিতে বার্ষিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, তা যথেষ্ট নয়। অর্থনীতিবিদদের সুপারিশের সঙ্গে একমত পোষণ করে তিনি কৃষিখাতে বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ এবং ৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদানের জোর আহ্বান জানান।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও পরিবেশের সুরক্ষায় বীজ ব্যাংক স্থাপন করে উন্নত ও উচ্চফলনশীল বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করে তা কৃষকদের কাছে সহজলভ্য করার দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে আগামী বাজেটে দেশীয় (চিরায়ত) বীজ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্যেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানানো হয়।
কৃষি জমিতে সেচের সুবিধা বাড়ানো এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণে খাল খনন ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি নদী-খাল ইজারা দেওয়া বন্ধ করে কৃষকদের জন্য উন্মুক্ত রাখার দাবি জানানো হয়েছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং শস্য বীমা চালুরও দাবি জানান তারা।
পাটশিল্পের করুণ চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২ জুলাই সরকার একসঙ্গে খুলনার ৯টিসহ সারাদেশের ২৬টি পাটকল বন্ধ করে দেয়। মিল বন্ধের দুই মাসের মধ্যে শ্রমিকদের সমুদয় পাওনা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, এখনো বহু শ্রমিক তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। অথচ দুর্নীতিগ্রস্ত বিজেএমসি ও মিলের ২ হাজার ৫১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎপাদন বন্ধ থাকার পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন এবং সরকার তাদের বেতন বাবদ বছরে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা ব্যয় করছেন।
নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই ২৫টি পাটকলের জমি, রাস্তা, গোডাউন, নদীর ঘাট ও যন্ত্রপাতির বাজারমূল্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান ডলারের
বিনিময় হার অনুযায়ী, মাত্র ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেই পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন সম্ভব। কিন্তু ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটশিল্পকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পুনরায় চালুর কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আধুনিকায়ন ও দুর্নীতিমুক্ত করে পর্যায়ক্রমে চালুর উদ্যোগ নিতে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। একইসঙ্গে, খুলনা, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কয়েকটি বন্ধ পাটকলের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধের জন্যেও বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হয়।
খুলনার একসময়ের ঐতিহ্য নিউজপ্রিন্ট মিল ও হার্ডবোর্ড মিল পুনরায় চালুর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দেরও দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য সুপেয় পানির বিশেষ বরাদ্দেরও দাবি জানানো হয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কয়লা সংকটের কারণে বর্তমানে এই কেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনে নেই এবং এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন খরচ দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় উৎপাদন খরচের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। এর ফলে বায়ু ও নদী দূষণ হচ্ছে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প এখনই ভাবতে হবে।
সুন্দরবন রক্ষায় বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত উল্লেখ করে বলা হয়, সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা শিল্প কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া এবং নতুন শিল্প স্থাপনের নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে কার্যকর করার ওপর জোর দিতে হবে। একইসঙ্গে সুন্দরবন ইকোট্যুরিজম মাস্টার প্লানের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য বন বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলেন নাগরিক কমিটির নেতারা।
আসন্ন বাজেটে খুলনাঞ্চলে নদী-খাল পুনঃখনন ও নদীতীর সংরক্ষণে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে নাগরিক কমিটি বিদ্যমান পুকুর ও দীঘি সংরক্ষণে স্থানীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জাতের গাছকে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি এস এ রশীদ, মুনীর চৌধুরী সোহেল, নাগরিক নেতা জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকী, পরিবেশকর্মী মাহফুজুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক মো. বাবুল হাওলাদার, এস এম চন্দন, কোহিনুর আক্তার কণা, কোষাধ্যক্ষ এসএম সোহরাব হোসেন, দপ্তর সম্পাদক আফজাল হোসেন, শ্রমিকনেতা মো. অলিয়ার রহমান, নিজাম উর রহমান, মিজানুর রহমান প্রমুখ।