বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে (আরইবি) স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলেছেন সংস্থাটির অধীনস্থ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতিষ্ঠান দুটি একীভূতকরণ, অভিন্ন চাকরিবিধি বাস্তবায়ন, আরইবির সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবি তোলার কারণে আরইবি সমিতির কর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে গত চার মাসে প্রায় ৩৭০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বদলি সংযুক্তিসহ হয়রানি মুলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুৎ অ্যাসোসিয়েশন (বাপিবিএ)।
নানা হয়রানি আর আতঙ্ক নিয়ে বৈদ্যুতিক লাইনে কাজ করার সময় মানসিক অশান্তির কারণে যেকোনও সময় কর্মীদের প্রাণহানি বা অন্য কোনও দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি গ্রাহক সেবা ব্যাহত হওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আজ বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি দাবি করে, শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো জরুরি সেবা খাতের সংস্কার চাওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বিনা নোটিশে ২৯ জনকে চাকরিচ্যুত, মামলা-রিমান্ড-গ্রেপ্তার, বরখাস্ত ও সংযুক্তির পাশাপাশি গত চার মাসে ৩৬৮৩ জন কর্মীকে শাস্তিমূলকভাবে নিজে জেলা হতে কয়েক শ কিলোমিটার দূরত্বে বদলি করা হয়েছে।
হয়রানিমূলক বদলির শিকার হওয়াদের মধ্যে লাইনক্রু প্রায় ৬৭৩ জন, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ৫৮৯ জন, ইসি ২৯০ জন, পিউসি ১২১ জন, বিলিং সুপারভাইজার ৩০৮ জন, এজিএম ৫৮০ জন, ডিজিএম ১৭৯ জন, সিনিয়র জিএম/জিএম ৩৬ জন, অন্যান্য ৯০৭ জন রয়েছেন। তাদের দাবি, সংস্কার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই আন্দোলনের অযুহাতে বিভিন্ন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে শাস্তিমূলকভাবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এই বদলি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে পিবিএ নেতারা অভিযোগ করেন, আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিদ্যমান দীর্ঘদিনের সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত এবং ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সমিতির জনবলের ওপর আরইবির দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তারা বলেন, আরইবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন এবং সকল অনিয়মিতদের নিয়মিত করার দাবিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বিদ্যুৎ সেবা চালু রেখে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, স্মারকলিপি প্রদানসহ, আন্দোলন করে আসছে সমিতির ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরইবির অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তদন্ত দাবি করেন তারা। দাবির প্রেক্ষিতে সরকারও বিভিন্ন সময় কমিটি গঠনসহ নানা পদেক্ষেপ নেয়। কিন্তু সরকারের নেওয়া সংস্কার পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করতে আরইইবি বরাবরই নানা প্রহসনমুল পদক্ষেপ গ্রহন করে আসছে।
তাদের অভিযোগ, সর্বশেষ গত ১২ মে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৯০ জন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার (আইটি)সহ আরও ৩৯৫ জন লাইনক্রুকে হয়রানিমূলক বদলি আদেশ জারি করেছে আরইবি। এতে কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে এবং ঝড় বৃষ্টির মৌসুমে বিদ্যুৎ কর্মীদের এমন গণবদলি নজিরবিহীন এবং চরম অমানবিক দাবি করে পল্লী বিদ্যুৎ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে ব্যাপক জনবলের ঘাটতি রয়েছে, স্বল্প জনবল দিয়ে বর্তমানে কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম ও তীব্র তাপদাহে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা চালু রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে এই ধরনের গণ-বদলির কারণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও গ্রাহক সেবা চরমভাবে বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। প্রহসনমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গণবদলির কারণে নতুন লাইনম্যানদের মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৪৫ হাজার কর্মীর যৌক্তিক দাবিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, চাকরিচ্যুতদের স্বপদে পুনর্বহাল, সংযুক্ত ও সাময়িক বরখাস্তদের স্বপদে বহালসহ প্রায় ৭মাস পূর্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির পল্লী বিদ্যুৎ সংস্কারের রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানান তারা।
একই সঙ্গে সকল চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিতদের নিয়মিতকরণসহ বর্তমান ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে লাইনক্রুদের বদলি আদেশ বাতিল করে সমিতির সুষ্ঠু ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে আরইবির চেয়ারম্যান, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ উপদেষ্টাসহ সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে সই করেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভুক্তভোগী এজিএম (সহকারী মহাব্যবস্থাপক) মনির হোসেন, ভুক্তভোগী কর্মী গোলাম মোস্তফা (এমআরসিএম), মো. মইনুল ইসলাম (লাইন টেকনিশিয়ান), মো. হাসানুজ্জামান (জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার) প্রমুখ।
আরইবির অধীনে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। দেশের মোট ৪ কোটি ৭২ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি ৬১ লাখ গ্রাহকই আরইবির অধীন।
মূল প্রতিষ্ঠান, নিয়োগকারী কর্মকর্তা, চাকরির যোগ্যতা এক হওয়া সত্বেও সুযোগ-সুবিধা বিচেনায় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজে নিয়োজিত কর্মীরা একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও পদ-পদবি, বেতন-ভাতা ও বোনাসসহ পদোন্নতির ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আরইবির কিছু কর্মকর্তা নিজেদের সুবিধার জন্য বছরের পর বছর ধরে এই বৈষম্য জিইয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
নিজেদের ন্যায্য দাবি জানিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আরইবিকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হলেও সমিতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকা আরইবি কোনও সমাধান না করে উল্টো পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কৌশলে নানারকম হুমকি অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এস এম জিয়া-উল-আজিমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার কোনও সাড়া না মেলায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।