বাংলাদেশে আওয়ামী সরকার পতনের পর ভারত বাংলাদেশের মধ্যকার বাগযুদ্ধ এখন রীতিমতো বাণিজ্যযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ভারত সম্প্রতি তাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যগুলোতে (সেভেন সিস্টার্স) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
এর ফলে এখন থেকে বাংলাদেশের এসব পণ্য আসাম, মিজোরাম, মেঘালয় কিংবা ত্রিপুরার কোনো শুল্কস্টেশন দিয়ে সেভেন সিস্টার্সে পাঠানো যাবে না। এরই মধ্যে ভারতের এ সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। একই অবস্থা যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের ক্ষেত্রে। ভারতের সিদ্ধান্তের কারণে গতকাল রবিবার দুপুর পর্যন্ত বেনাপোল স্থলবন্দরে ৩৬ ট্রাক বোঝাই তৈরি পোশাকের রপ্তানি চালান আটকা পড়ে।
রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়বে। কারণ বেনাপোল স্থলবন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর বা বিকল্প পথে পণ্য ভারতে পাঠাতে সময় এবং খরচ দুটোই দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ভারতের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় তৈরি পোশাকের চেয়ে পরিমাণে কম হলেও ভারতে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিসহ নানা পণ্যের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ হিসেবে রপ্তানিকারকরা বলছেন- সময় ও খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা।
গত শনিবার ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বৈদেশিক বাণিজ্য দপ্তর (ডিজিএফটি) বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য বেশ কিছু পণ্য ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, ফল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য, তুলা, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক এবং পিভিসি দিয়ে তৈরি জিনিস, রঞ্জকের মতো পণ্য বাংলাদেশ থেকে আসাম, মিজোরাম, মেঘালয় কিংবা ত্রিপুরার কোনো শুল্কস্টেশনে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে ভারত হয়ে নেপাল বা ভুটানে রপ্তানি করা পণ্যের বিষয়ে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। ভারতীয় সংস্থার নির্দেশনায় বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা এবং ফুলবাড়ী শুল্কস্টেশনের ক্ষেত্রেও একই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। তবে বাংলাদেশ থেকে মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেল পণ্যের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।
এই ঘোষণাটি ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে দ্বিতীয় বাধা। এর আগে বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ভারত বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। যে সুবিধার আওতায় ভারতীয় অবকাঠামো ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি করত বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভারতের স্থলবন্দর বন্ধ হওয়ায় রপ্তানিতে খরচ বাড়বে। এখন বিকল্প হিসেবে নদী ও আকাশ পথে পণ্য পাঠাতে হবে। এতে রপ্তানি ও আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। সময়ের হিসাবে স্থলপথে আগে ৩ থেকে ৪ দিনে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব ছিল। এখন হয়তো এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। এই বাড়তি সময়ের জন্য বাড়তি খরচ গুনতে হবে।’
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়লেও সেটা দেশের সামগ্রিক পোশাক রপ্তানির ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির মধ্যে ভারতের অংশীদারত্ব খুব কম। এ ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা থাকায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কিছু খরচ বৃদ্ধি ছাড়া তেমন কোনো প্রভাব আসবে না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক পণ্য ভারতে রপ্তানি হয়েছে। যা তার আগের বছরের চেয়ে সামান্য বেশি ছিল।
এ বাণিজ্যযুদ্ধের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে সচিবালয়ে কথা বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসা চলমান থাকবে। তবে ভারত থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানেন না বলেন জানান এ উপদেষ্টা, জেনেছেন গণমাধ্যম থেকে। যার ভিত্তিতে একাধিক দপ্তর এর প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণে কাজ শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ভারতে আমাদের আসবাব খুব বেশি রপ্তানি হয় না, সেই তুলনায় পোশাকের বড় রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি হয় প্রতিযোগিতা সক্ষমতার কারণে। আশা করছি ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর স্বার্থে এটা চলমান থাকবে।
ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের ধারাবাহিকতায় এটা হয়েছে কি না জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, তার ধারাবাহিকতায় এটা হয়নি। এর ফলে ভারতের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ভৌগোলিক কারণে আমরা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তারপরও পরিস্থিতি বুঝতে দুএক দিন সময় লাগবে, এরপর করণীয় ঠিক করা হবে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের যে ব্যবসা তাতে ভারতের পাল্লাই ভারী। এক দিনে এই বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না। এটা দূর করতে সময় লাগবে।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব ভারতে ফল, ড্রিংকস, বিস্কুট, কেক, চিপস, স্ন্যাকস রপ্তানিতে যে সহজ পথটি ছিল এখন সেটি বন্ধ হয়েছে। ফলে এসব খাতের ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাবটা বেশ তীব্র হবে বলে জানান রপ্তানিকারকরা। তবে এর প্রভাব শুধু বাংলাদেশের রপ্তানিতেই পড়বে না, ভারতের জনগণের ওপরও পড়বে। কারণ প্রক্রিয়াজাত পণ্যের চালান ভারতে রপ্তানির জন্য এখন কলকাতা ঘুরে পণ্য পাঠাতে হবে আগরতলায়। ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের বিস্কুট, কেক, চিপস, ফলের ড্রিংকস জনপ্রিয়। ওই অঞ্চলে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড প্রাণ-আরএফএল পণ্যই বেশি রপ্তানি হয়। নতুন ব্যবস্থায় সেভেন সিস্টারে ওই সব পণ্য স্থলপথে পাঠাতে হলে সাতক্ষীরার ভোমরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ স্থলবন্দরই ভরসা।
এখন এসব পণ্য প্রথমে কলকাতা যাবে। পরে কলকাতা থেকে সড়ক বা রেলপথে প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ওই পণ্য যেতে হবে ত্রিপুরার আগরতলায়। অবশ্য আসামের গুয়াহাটি, করিমগঞ্জ কিংবা মেঘালয়ের শিলংয়ে পণ্যের চালান পাঠাতে আরও কম পথ পাড়ি দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর বা মোংলা বন্দর থেকে কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পাঠাতে হবে। তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার রাজ্যে নিয়ে যেতে হবে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, কলকাতা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পাঠাতে কমপক্ষে ১০ দিন সময় লাগবে। এতে আগরতলার আমদানিকারকরা এত ঘোরা পথে পণ্য নেবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বলেন, সীমান্তের ওপারে পণ্য পৌঁছানোর পর সব খরচ আমদানিকারকের। ফলে ওই আমদানিকারকরা এত পরিবহন খরচ দিয়ে কতটা প্রতিযোগীসক্ষম থাকতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ভারতের যে বাণিজ্য সেখানে ভারতের অংশীদারত্বই বেশি, বাংলাদেশের সামান্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ ডলারের পণ্য বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে। যেখানে ভারত বাংলাদেশে ৯০০ কোটি ১ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। আগের অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২১২ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের পণ্য, যেখানে ভারত করেছে ৯৪৯ কোটি ২৪ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের ১৯৯ কোটি ১৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানির ভারত রপ্তানি করেছিল ১৩৬৮ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে দুদেশের বাণিজ্যে কালোবাজারি বাড়তে পারে। কারণ প্রভাবটা দুদেশের ওপরই পড়বে। ব্যবসায়ী-ভোক্তা দুই পক্ষই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা যে দিবে এবং যার ওপরে আরোপ করা হবে প্রভাব দুজনের ওপরেই পড়বে। হয়তো কম বা বেশি। এখন ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়েছে। এর আগে ভারত ট্রানশিপমেন্ট বাতিল করেছে এবং বাংলাদেশ সুতা আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে আগেই বলে দেয়। বা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। কিন্তু ভারত কেন এমন পদক্ষেপ নিল তা কিন্তু ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়নি। সেজন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ক‚টনৈতিকভাবে কারণ জানতে চাওয়া দরকার।
জাহিদ হোসেন বলেন, তৈরি পোশাককে লক্ষ্য করে এটি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ ভারতে পোশাক রপ্তানির ৯০ ভাগ স্থলবন্দর দিয়ে যাচ্ছিল। এখন সেটি বিকল্পভাবে করতে হবে। সে হিসেবে একটি বড় প্রভাব থাকবে। তবে, পোশাক রপ্তানিতে ভারতের অংশীদারত্ব কম। সে দিক থেকে বেশি প্রভাব আসবে বলে মনে হচ্ছেনা। তিনি বলেন, উভয় পক্ষ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে থাকলে দুদেশের কারখানা, কর্মসংস্থান ও জনগণের ওপর সব থেকে বেশি প্রভাব পড়বে। সে জন্য বলা হয়, নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা হাস্যকর। আশা করছি, দুদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসবে।