বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বিমানের টেকনিক্যাল হেলপার ক্লিনাররা!

  • বিমানের গোপন প্রতিবেদনে তথ্য
  • ১৬০ জন নিয়োগ পেয়েছেন প্রকৌশল বিভাগে 
  • ১২ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে পেয়ে যাচ্ছেন পদোন্নতি
  • ক্লিনাররা কিভাবে প্রকৌশল বিভাগে বুঝতে পারছি না : ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
আপডেট : ২১ মে ২০২৫, ১২:৩০ এএম

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সমস্যার যেন শেষ নেই। সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলেছে অব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন সময়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। সরকার পরিবর্তন হলেও বিমানের ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হচ্ছে না। সর্বশেষ গত শুক্রবার বিমানের একটি উড়োজাহাজ আকাশে উড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকা খুলে পড়ে গেলে শুরু হয় তোলপাড়। পাইলটের দক্ষতায় যাত্রীদের জীবন রক্ষা পেয়েছে। এই নিয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি।

এবার বিমানের একটি গোপন প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কর্মরত ক্লিনাদের পদোন্নতি দিয়ে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে টেকনিক্যাল হেলপার। এই জন্য তাদের দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১২ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ। তারা বিমানের প্রকৌশল বিভাগে কাজ করছেন। এই পর্যন্ত ১৬০ জন ক্লিনার টেকনিক্যাল হেলপার হিসেবে কর্মরত আছেন বলে বিমানের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে। আরও নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, বিমানের প্রকৌশল বিভাগে নিয়োগের কাজটি বাস্তবায়ন করতে ২০২৩ সালে ১৭ ডিসেম্বর পরিচালক (প্রশাসন) সিদ্দিকুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। ক্লিনারদের টেকনিক্যাল হেলপার পদে নিয়োগ দিতে ওই চিঠির কার্যকারিতা এখনো বলবৎ রয়েছে।

জানা যায়, ওই চিঠি সকল পরিচালক, সকল জেনারেল ম্যানেজার, প্রিন্সিপাল বিএটিসি, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, সময়সূচি ও পরিকল্পনা প্রধান ফ্লাইট সেফটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার, প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা, কোম্পানি সচিব, সকল ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, উপপ্রধান ইঞ্জিনিয়ার প্রধান প্রশিক্ষক, ম্যানেজার সমন্বয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সকল ম্যানেজার কান্ট্রি ম্যানেজার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক জেলা ব্যবস্থাপক, অর্থ ব্যবস্থাপক স্টেশন ব্যবস্থাপক, সকল অ্যাডমিন সেলে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিটি এখনো কার্যকারিতা আছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ম্যানেজমেন্ট সন্তুষ্টির সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট ডিরেক্টরেটের এয়ারক্রাফট টেকনিক্যাল হেল্পারের নিম্নলিখিত নীতিমালা সংশোধন করতে পেরেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাকশনে ক্যাজুয়াল কর্মী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিটি এয়ারক্রাফট টেকনিক্যাল হেল্পারকে তাদের কর্মক্ষমতা এবং  কোম্পানির প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে অ্যারোস্পেস (এয়ারফ্রেম এবং ইঞ্জিন) অথবা এভিওনিক্স ( বৈদ্যুতিক ও যন্ত্র এবং  রেডিও ও রাডার) ট্রেডে নিয়োগ করা হবে। 
নিয়োগের ১ বছরের মধ্যে প্রধান প্রকৌশলী উৎপাদন (কমিটির চেয়াররম্যান) এবং সংশ্লিষ্ট উপপ্রধান প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি এই নিয়োগটি সম্পন্ন করবে। অনুচ্ছেদ-সি-তে উল্লিখিত মৌলিক কোর্সে অংশগ্রহণের জন্য কমপক্ষে ২ বছরের বাণিজ্য অভিজ্ঞতা পূর্বশর্ত। অনুমোদিত সিলেবাস এবং প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা অনুসারে তাদের অ্যারোস্পেস ট্রেডের জন্য বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষেবার বেসিক  কোর্স অথবা এভিওনিক্স ট্রেডের জন্য বিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষেবার জন্য ক্লাসরুম প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

অনুমোদিত প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা অনুসারে, কোর্সের সময়কাল ১৫ সপ্তাহ (১২ সপ্তাহের ক্লাসরুম এবং ৩ সপ্তাহ ব্যবহারিক)। কোর্সটি সফলভাবে সম্পন্ন করার পর, সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের জন্য ৯০ দিনের ওজেটি প্রযোজ্য হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স (আইঅ্যান্ডকিউএ) বিভাগ তাদেও ট্রেড অনুযায়ী ওজেটি ব্যবস্থা করবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ৫ বছরের চাকরির পর এয়ারক্রাফট টেকনিক্যাল হেল্পারদের (এটিএইচ) বেতন গ্রুপ-১ লেচটে এ-নম্বরসহ চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করা হবে, যদি তিনি সফলভাবে প্রশিক্ষণ এবং ওআই সম্পন্ন করেন। বেতন গ্রুপে-১ (টেক) তিন বছরের চাকরি সম্পন্ন করার পর বিমান টেকনিক্যাল  হেল্পারদের বেতনে নিয়োগ করা হবে। পে গ্রুপে তিন বছরের চাকরি সম্পন্ন করার পর এয়াররক্রাফট টেকনিক্যাল হেল্পারদের শূন্য পদের বিপরীতে পে গ্রুপে এয়ারক্রাফট মেকানিক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া  যেতে পারে। তবে এয়ারক্রাফট টেকনিক্যাল হেল্পার (এটিএইচ) থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত এয়ারক্রাফট মেকানিকের সংখ্যা পে গ্রুপে অনুমোদিত পদের ৩০% এর বেশি হবে না। যেসব প্রার্থী প্রথম প্রচেষ্টায় অনুচ্ছেদে উল্লিখিত কোর্সটি সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হবেন তাদের নিজেদের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আরেকটি প্রচেষ্টা (পূর্ণ  কোর্স) দেওয়া যেতে পারে। দুটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা বিমানের বিদ্যমান নীতিমালা অনুসারে তাদের চাকরি চালিয়ে যেতে পারবেন।

এই প্রসঙ্গে বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, শুক্রবার বিমানের চাকা খুলে গেলে বিষয়টি সামনে আসে। দীর্ঘদিন ধরেই ক্লিনাররা প্রকৌশল বিভাগে চাকরি করে আসছে। তারা বিমানের যন্ত্রাংশের বিষয়ে কিছু না বুঝলেও টেকনিক্যাল হেলপার হিসেবে কাজ করে আসছে। এখনো ১৬০ জন কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের হাইকমান্ডের কাছে পাঠিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, ক্লিনাররা কিভাবে প্রকৌশল বিভাগে কাজ করে তা বুঝতে পারছি না। তাদের নিয়োগ দিয়ে একটি চক্র লাভবান হচ্ছেন। তারা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। গত শুক্রবারের ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটিও ক্লিনারদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বিষয়টি আরও গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বিমান সূত্র জানায়, বিমানের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৭  মে ২৫ জন বিমান প্রকৌশলী (এস২-এজেডব্লিই) বিমান ২ হুইল অ্যাসেম্বলি প্রতিস্থাপন করেন। ইনস্টলেশনের সময় তারা বেয়ারিং সিল সঠিকভাবে ঠিক করেননি (ভুল দিকনির্দেশনা)। আর এই কারণে ২৬টি অবতরণ চক্রের পর সব গ্রিজ লিক হয়ে যায় এবং  বেয়ারিং শুকিয়ে যায়। ফলে বেয়ারিং ব্যর্থ হয়। এবং অ্যাক্সেল থেকে চাকা বেরিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে বিশেষজ্ঞ মেকানিক এবং  টেকনিশিয়ানের পরিবর্তে এয়ারক্রাফট টেকনিক্যাল হেল্পার দ্বারা চাকা প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে বিমানে মেকানিকের ঘাটতি থাকায় সেই শূন্যস্থান পূরণ করে ক্লিনারদের নিয়োগ করে এবং তাদের মেকানিক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ২০২২ সালে ১০ এপ্রিল হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সে স্থল দুর্ঘটনা ঘটেছিল (ই৭৭৭ এবং ড্যাশ-৮ বিমান)। ওই সময় ই-৭৭৭ বিমানটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শুক্রবার কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার সময় বিমানের চাকাসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্লিনার থেকে টেকনিক্যাল হেলপারদের পদে নিয়োগ পাওয়া লোকজন পরীক্ষা করেছেন। বিষয়টি তদন্ত চলছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এখনো হেলপারদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। এখনো ১৬০ জন মেকানিক হেলপার কাজ করছে। আরও নিয়োগ দেওয়ার কাজ চলছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এই প্রসঙ্গে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বোয়িং ৭৮৭-৮ টানা ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা উড়তে পারে এবং এটি নিউইয়র্ক বা টোকিওর মতো দূরবর্তী গন্তব্যের জন্য বেশি উপযোগী। সরকার পরিবর্তন হলেও বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন হয়নি এখনো। গত এক দশকে উড়োজাহাজে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবারে ঘটনা থেকে আমরা বড় ধরনের রক্ষা পেলেও অনেক কিছু সামনে চলে এসেছে। ঘটনার পর আমরা জানতে পেরেছি, ফ্লাইট শুরুর আগে নিয়ম অনুযায়ী উড়োজাহাজ ইনসপেকশনের পাশাপাশি উড়োজাহাজের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে এই ল্যান্ডিং গিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় ল্যান্ডিং গিয়ারের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ল্যান্ডিং গিয়ারে থাকা গ্রিজ শুকিয়ে যাওয়া বা সেখানে থাকা বিয়ারিংয়ে সমস্যা দেখা যাওয়ার কারণে উড়োজাহাজ উড্ডয়নের সময় চাকা খুলে পড়ে। ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানির নির্দেশনা অনুযায়ী ল্যান্ডিং গিয়ার ৬ মাস পরপর মেইনটেন্যান্স করার কথা। কিন্তু তা করা হয়নি। এই ঘটনার দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। 
সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বহরে ২১টি আধুনিক উড়োজাহাজ রয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনার অভাবে বহরের অনেক নতুন উড়োজাহাজ সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং মানসম্পন্ন পূর্ণ সেবা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে লোকসান গুনতে হচ্ছে বিমানকে।

১৯৭২ সালে বিমান তার ডানা মেলার পর থেকে জাতীয় উড়োজাহাজ সংস্থাটি প্রায় প্রতি অর্থবছরেই লোকসান দিচ্ছে। বর্তমানে সংস্থাটি ১৯টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে আসা যাওয়া করছে। বেশিরভাগ গন্তব্যই স্বল্প অথবা মধ্যম দূরত্বে। আগে সংস্থাটি আরও কম উড়োজাহাজ নিয়েও নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে টোকিওসহ ইউরোপের প্রধান শহরগুলোতে ফ্লাইট পরিচালনা করত। ২০০৬ সাল থেকে বিমান ধীরে ধীরে নিউইয়র্ক, ফ্রাঙ্কফুর্ট, রোম, টোকিও, ব্রাসেলস, আমস্টারডাম ও লিবিয়াসহ ১০টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে  দেয়। এর পেছনে মূল কারণ আর্থিক সমস্যা, আধুনিক বিমানের স্বল্পতা এবং কিছু গন্তব্যে পরিচালনায় অর্থনৈতিকভাবে লাভবান না হওয়া। তবে রোম ও নারিতার ফ্লাইট চলাচল শুরু হতে না হতে নারিতার ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে দুদিন আগে। ৪২টি দেশের সঙ্গে উড্ডয়নের চুক্তি আছে বিমানের। 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত