২৯ মে—মানব ইতিহাসে এক অনন্য দিন। ১৯৫৩ সালের এই দিনে স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে প্রথমবারের মতো মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে রচনা করেন এক নতুন অধ্যায়। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মরণে বিশ্বজুড়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক এভারেস্ট দিবস।
প্রতিবারের মতো এবারও এভারেস্ট জয়ীদের সাফল্য সামনে চলে এসেছে সংবাদ শিরোনামে, ইতিহাসের পাতায় লিখা হচ্ছে তাদের কৃতিত্ব। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে যাঁরা এই জয়যাত্রার প্রতিটি ধাপে ছিলেন অবিচ্ছেদ্য, যাঁদের উপস্থিতি ছাড়া এমন অর্জনের কল্পনাও করা যায় না, তাঁরাই শেরপা—হিমালয়ের প্রকৃত নায়ক।
শেরপারা শুধু গাইড নন, তাঁরা একটি জাতিগোষ্ঠী। পূর্ব নেপালের খুম্বু অঞ্চলে বসবাসকারী এই তিব্বতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর জীবনই গড়ে উঠেছে হিমালয়ের কোলে। যেখানে উচ্চতা, অক্সিজেনের ঘাটতি কিংবা প্রচণ্ড ঠান্ডা অন্যদের জন্য ভয়ানক, সেখানে শেরপাদের কাছে এসবই দৈনন্দিন বাস্তবতা।
বিজ্ঞান বলছে, শেরপাদের দেহ গঠনে রয়েছে ব্যতিক্রমী অভিযোজন ক্ষমতা। কম অক্সিজেনেও তারা দক্ষভাবে কাজ করতে পারেন, তাঁদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের গঠনও আলাদা। এ কারণেই পর্বতারোহণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক যেন শরীর ও মাটির আত্মীয়তা।
প্রথম জয়জুটির নাম ইতিহাসে লেখা হয়েছে হিলারি-তেনজিং নামে। কিন্তু অনেকেই ভুলে যান, সেই অভিযানে পথপ্রদর্শক ছিলেন তেনজিং নিজেই। শেরপা হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা, সাহস ও নেতৃত্ব ছাড়া সেই বিজয় সম্ভব হতো না। তেনজিং শুধু একজন সহযাত্রী ছিলেন না, তিনিই ছিলেন হিলারির পথের আলোকবর্তিকা।
শেরপাদের দায়িত্ব সীমিত নয়। তারা খাবার ও গ্যাস ট্যাঙ্ক বহন করেন, ক্যারাভান পরিচালনা করেন, পর্বতের দুর্গম পথ নিরাপদ করতে দড়ি পুঁতেন এবং বিপদের সময় ঝাঁপিয়ে পড়েন উদ্ধারকাজে। এসবই করেন ন্যূনতম পারিশ্রমিকে, যেখানে অভিযাত্রীরা একটি অভিযানে ব্যয় করেন লাখ লাখ ডলার।
শেরপাদের জীবনে ঝুঁকি যেন নিত্যসঙ্গী। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১৩ জন পর্বতারোহীর বিপরীতে একজন শেরপার মৃত্যু ঘটে। ২০১৪ সালের বরফধস ও ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে প্রাণ হারান শতাধিক শেরপা। এভারেস্টে মৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে রয়েছেন তাঁরাই। অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কিংবা ইতিহাসে তাঁদের কথা উঠে আসে খুব কমই।
বংশপরম্পরায় এই পেশায় যুক্ত হলেও আজকের শেরপারা অনেকেই শিক্ষিত, ইংরেজি ভাষায় দক্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কেউ কেউ নিজেরাই হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি পর্বতারোহী। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কামি রিতা শেরপা, যিনি এভারেস্ট জয়ের বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন ৩০ বার চূড়ায় পৌঁছে।
তবু আজও ‘শেরপা’ শব্দটি বহু সময় কেবল ‘কুলি’ বা ‘গাইড’ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই সামাজিক অবমূল্যায়ন ও শ্রেণিবিভেদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সচেতনতা গড়ে উঠছে। এভারেস্ট দিবসে যখন আমরা বিজয় উদযাপন করি, তখন মনে রাখতে হবে, সেই বিজয়ের নেপথ্য কৃতিত্ব তাঁদের, যাঁরা নীরবে পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে দেন সাফল্যের পথ।
হিমালয়ের প্রকৃত উচ্চতা কেবল মাপা যায় না মিটারে—তা বুঝতে হয় শেরপাদের সাহস, শ্রম ও আত্মত্যাগের পরিমাপে।