প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ৫ জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ রক্ষায় জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটির ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে উপজীব্য করে প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো 'প্লাস্টিক দূষণ আর নয়' এবং স্লোগান হলো 'প্লাস্টিক দূষণ আর নয়/বন্ধ করার এখনি সময়'। প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও এর ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আলোকে এ বছরের নির্ধারিত প্রতিপাদ্যটি নিঃসন্দেহে যথাযথ এবং সময়োপযোগী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানবস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সুরক্ষার আলোকে দিবসটির তাৎপর্য আলোচনা করা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
প্লাস্টিক একটি কৃত্রিম বস্তু যা আবিষ্কারের পর এর বহুমুখী ব্যবহারের জন্য মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ব্যাপক আগ্রহ। দীর্ঘস্থায়ী, ওজনে হালকা, নমনীয় ইত্যাদি গুণের জন্য এটি দ্রুত মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বহুমাত্রিক ব্যবহার, সুলভ ও সহজলভ্য হওয়ায় এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এর উৎপাদন ও ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৫০ সালে বার্ষিক ব্যবহার ছিল ১.৫ মিলিয়ন টন যা ২০২০ সনে ৩৬৭ মিলিয়ন টনে দাঁড়ায়। আবিষ্কারের প্রথম দিকে এর নেতিবাচক প্রভাব উপলব্ধি না হলেও বর্তমানে প্লাস্টিক দূষণ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ স্তরে পৌঁছেছে। এর বিস্তার পাহার, নদী, বন, স্থল ভাগ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। নির্বিচার ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার দরুণ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণির স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। তাই সারবিশ্বে এর ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিকার নিয়ে চলছে গবেষণা এবং আলোচনা।
প্লাস্টিক দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাবের গঠন এবং আকারের ওপর নির্ভর করে। আকারের ওপর ভিত্তি করে প্লাস্টিক কণা প্রধানত ৩ প্রকারের হতে পারে। যথা ম্যাক্রোপ্লাস্টিক (>=৫ মিমি), মাইক্রোপ্লাস্টিক (<৫ মিমি) এবং ন্যানোপ্লাস্টিক (<১ মাইক্রোমিটার)। সব ধরণের প্লাস্টিক কণাই পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ম্যাক্রোপ্লাস্টিক দ্রব্যের অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতির জন্য মাটির স্বাভাবিক গঠন, বুনন, পুষ্টি প্রাপ্রতা ও অনুজীবীয় কার্যকারিতা বিনষ্ট করে। এরা জলাবদ্ধতা তৈরি করে বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যঘাত ঘটায়। প্লাস্টিক দ্রব্যের উপস্থিতির ফলে জমির জৈব পদার্থের পচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে পুষ্টি চক্র ব্যাহত হয়। এ ছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণির মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খল হয়ে মানুষের দেহে পৌঁছে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের জন্য এর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
অন্যদিকে মাইক্রোপ্লাস্টিক নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষ এবং প্রাণি দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। এটি নিঃশ্বাস, তরল বা কঠিন খাদ্যবস্তু ভক্ষণের মাধ্যমে কিংবা সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে এসে মানুষের দেহে ক্ষতি করতে পারে। এরা অপচনশীল বিধায় পরিবেশে দীর্ঘ দিন উপস্থিত থেকে নানামুখী ক্ষতির কারণ হতে পারে। খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে অবস্থান করার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে মানব দেহে প্রবেশ করে রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। শরীরে এর উপস্থিতির ফলে হরমোনের কার্যকারিতা নষ্ট, শ্বাস কষ্ট, দৈহিক বৃদ্ধি ও প্রজনন সবাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটানো থেকে শুরু করে প্রতিবন্ধিতা ও ক্যান্সারের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
প্লাস্টিক ব্যবহারের বিভিন্ন খাতের মধ্যে যে খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো কৃষি। এর বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। প্লাস্টিক সিট দিয়ে জমিতে মালচিং, ছাউনি তৈরি, সার ও কীটনাশক বহন, সংরক্ষণ, পানি পরিবহনের পাইপ, এমন কি পশু-পাখি থেকে ফসল রক্ষার জন্য ‘কাকতাড়ুয়া” তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় প্লাস্টির তথা পলিথিন। অর্থাৎ এক কথায়, ফসল উৎপাদনে বীজ তলা তৈরি থেকে শুরু করে ফসল সংরক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার দেখা যায়। প্লাস্টিক দ্রব্যের উপস্থিতি মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করে মাটিকে অনুর্বর করে তোলে। এতে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। এভাবে কৃষি জমির উর্বরতা বিনষ্টে প্লাস্টিকের ভূমিকা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে শুধুমাত্র কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজে বছরে ২.২৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দ্রব্য পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানব সবাস্থের ওপর তৈরি করছে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তৈরি না হওয়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব বহুমাত্রিক। দেশের শিশু এবং নিম্নআয়ের মানুষ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয় বেশি।
সারা বিশ্বে প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে মাথাপিছু ব্যবহারে রয়েছে ব্যাপক তারতম্য। সাধারণত অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশে এর ব্যবহার বেশি। অন্যদিকে উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশে এর ব্যবহার কম। বার্ষিক মাথাপিছু কম প্লাস্টিক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ (৯ কেজি), ভারত (১৫ কেজি), পাকিস্তান (৬.৫ কেজি), নেপাল (১৭.২৪ কেজি) এবং উগান্ডা (২০.৪ কেজি)। অন্যদিকে বেশি ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (২২০ কেজি), অস্ট্রিয়া (১৫৬ কেজি), জাপান (৮২ কেজি), এবং নরওয়ে (১১০ কেজি)। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশে মাথাপিছু ব্যবহার বৈশ্বিক গড়ের (৮০ কেজি) চেয়ে অনেক কম। অন্যদিকে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেখা যায় চমকপ্রদ চিত্র। প্লাস্টিক বর্জ্য অব্যবস্থাপনা সূচকে বিশ্বে শীর্ষ স্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ইথিওপয়া (৯৪.৮%), উগান্ডা (৯১.৮%), পাকিস্তান (৮৬.৪%), আফগানিস্তান (৮৬.৩%), নেপাল (৮৪.৭%), বাংলাদেশ (৮৩.২%) এবং ভারত (৬৮.৬%)। একই সূচকে সবচেয়ে নীচের দিকে অর্থাৎ যাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপন উন্নত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অস্ট্রিয়া (০%), ফিনল্যান্ড (২.২%), সিঙ্গাপুর (২.৮%), নিউজিল্যান্ড (৩.৩%), জাপান (৩.৮%), নরওয়ে (৪.৬%) এবং যুক্তরাষ্ট্র (৫.১%)। এই পরিসংখ্যান থেকে এটা সুস্পষ্ট যে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন কিংবা ব্যবহারের পরিমাণের সঙ্গে ব্যবস্থাপনার সরাসরি যোগসূত্র নেই। বরং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে যথাযথ ও কার্যকর আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের ওপর।
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষে করণীয় সমূহকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত প্রয়োজন সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সকল প্রচার মাধ্যমে এর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়মিত প্রচার করতে হবে। শিশুদের পাঠ্যবইতে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা হলে প্রতিটি মানুষ পরিবেশের ব্যাপারে সংবেদনশীল হবে এবং প্লাস্টিকের বিকল্প পরিবেশ বান্ধব বস্তু ব্যবহারে আগ্রহী হবে। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে যাতে কেউ নিষিদ্ধ ঘোষিত প্লাস্টিক উৎপাদন, বিপণন, ও বাজারজাতকরণ করতে না পারে। একই সঙ্গে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করার জন্য পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকের বিকল্প বস্তু উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য প্রণোদনা স্বরূপ ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। প্লাস্টিকের তৈরি এককালীন ব্যবহার্য বস্তু পরিহার করা। যেমন এককালীন ব্যবহার্য প্লাস্টিকের তৈরি পেয়ালা, পাত্র, গ্লাস, পাইপ, ইত্যাদির পরিবর্তে সিরামিক্স কিংবা ধাতুর তৈরি সামগ্রী ব্যবহারে উৎসাহিত করা। একই সঙ্গে প্লাস্টিকের এককালীন ব্যবহারের পরিবর্তে পৌণঃপুনিক ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্যের পুনঃপ্রক্রিয়া করার যথাযথ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যপদার্থ যথাযথভাবে সংগ্রহ এবং তা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষতির মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং নীতিমালায় প্লাস্টিকের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসার ঘোষণা দিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, প্লাস্টিকের দূষণ যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার লাগাম এখনই টেনে ধরা দরকার। অন্যথায়, বাংলদেশের মতো ঘন বসতিপূর্ণ দেশে এর নেতিবাচক প্রভাবে মানুষের স্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য এবং কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা হুমকির মধ্যে পড়বে। শুধুমাত্র ঢাক-ঢোল পিটিয়ে একদিন দিবস পালন করার মধ্যে সীমিত না রেখে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করে সারা বছর ধরে নিবিড়ভাবে এই দূষণের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালাতে হবে।
লেখক: ড. মুহাম্মদ জাবেদ হোসেন
অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়