গাড়ি থেকে ওয়াশিং মেশিন প্রায় সবকিছুর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রেয়ার আর্থের (বিরল মৃত্তিকা খনিজ) ওপর চীনের বিধিনিষেধ আরোপে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্বের বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তারা। দুর্লভ এসব খনিজ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ শিথিলে ইতিমধ্যে চীনকে আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এদিকে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান দেশটির অটোমোবাইল শিল্পের জায়ান্টদের।
২০২৩ সালে চীন ১৬টি দুর্লভ খনিজ ও সংশ্লিষ্ট পণ্যের রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে। গত ৪ এপ্রিল বেইজিং তাদের রপ্তানি বিধিনিষেধের তালিকায় আরও সাতটি খনিজ- ডিসপ্রোসিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, লুটেটিয়াম, সামারিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম, টারবিয়াম এবং ইট্রিয়ামকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ট্রাম্প ‘পারস্পরিক শুল্ক’ ঘোষণার ঠিক দুই দিন পর এ সিদ্ধান্ত নেয় বেইজিং। চীনা আমদানির ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯০% রেয়ার আর্থের যোগানদাতা চীন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য যুদ্ধের মধ্যে খনিজ শিল্পে চীনের আধিপত্যকে বেইজিংয়ের মূল অস্ত্র হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) মতে, বিশ্বব্যাপী খনি থেকে উৎপাদিত এই বিরল মাটির ৬১ শতাংশই চীনে পাওয়া যায়। তবে প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে এই খাতে চীনের নিয়ন্ত্রণ উৎপাদনের ৯২ শতাংশ।
ভেহিকেল সাপ্লায়ার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহ চেইন মারাত্মক হুমকির মুখে। বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যাওয়া উদ্বেগের মাত্রা খুব বেশি। অটোমোবাইল খাতে বিঘ্ন ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব অটোমোটিভ সাপ্লায়ার্স (সিএলইপিএ) এর সেক্রেটারি জেনারেল বেঞ্জামিন ক্রিগার এক বিবৃতিতে বলেন, চীনের রফতানি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতোমধ্যে ইউরোপের বেশ কয়েকটি উৎপাদন লাইন বন্ধ হয়ে গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য কমিশনার মারোস সেফকোভিচ মঙ্গলবার প্যারিসে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্সের সাইডলাইনে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাওয়ের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
ইউরোপীয় ব্যবসায়িক সংস্থার ভাইস-চেয়ারম্যান ডানেট বলেন, ‘হাজার হাজার আবেদন পর্যালোচনা করা প্রয়োজন, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সম্পদ সীমিত। গত সপ্তাহে কিছু ক্ষেত্রে অনুমোদন মিলেছে, কিন্তু কিছু কোম্পানি ডজন ডজন আবেদন জমা দিয়েছে... কিছু কোম্পানিকে উৎপাদন বন্ধ করতে হয়েছে।’
সেফকোভিচ বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিরল খনিজ এবং স্থায়ী চুম্বক শিল্প উৎপাদনের জন্য একেবারে অপরিহার্য। আমি চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীকে ইউরোপীয় গাড়ি শিল্পের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৯০ দিনের বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও বেইজিং এখনো এসব খনিজ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেনি। এর ফলে গত সপ্তাহে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য বাদানুবাদের সৃষ্টি হয়েছে, যা জেনেভায় সম্পাদিত অস্থায়ী বাণিজ্য চুক্তি লঙ্ঘন।
গাড়ি নির্মাতারা সতর্ক করে দিয়েছে, কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; কারণ চীন থেকে বিরল খনিজ আমদানি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তারাও চীনের বিরল মৃত্তিকা রফতানি অনুমোদনের ধীর গতিতে হতাশ হয়ে উঠছেন। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করেছিল, বাণিজ্য যুদ্ধবিরতির অংশ হিসাবে, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরল পৃথিবীর উপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। কিন্তু বেইজিং সেটি না করায় জেনেভা চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করছে ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, বেশ কয়েকটি আমেরিকান গাড়ি নির্মাতাদের কাছে বিরল খনিজ রপ্তানিতে কিছু সরবরাহকারীকে অনুমোদন দিয়েছে চীন।
তবে সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে না-ও যেতে পারে।
রপ্তানি বিধিনিষেধের ফলে উৎপাদকরা এখন হিমশিম খাচ্ছেন এবং আরও বেশি দামে চোরাই পথে কেনার চেষ্টা করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেয়ার আর্থের এক ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেন, ‘দুই মাস আগে বাজারে যে দামে পাওয়া যেত, তার চেয়ে ৪ থেকে ৭ গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে যাদের কাছে এসব মজুদ আছে। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন নরম ধাতু ইট্রিয়ামের মূল্য ১০ গুণের বেশি দিতে ইচ্ছুক।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাপান, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিক ও শিল্পখাতের নেতারা চীনের সাথে জরুরি আলোচনায় বসার চেষ্টা করছেন। ভারতের বাজাজ অটো ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে, চীন থেকে চুম্বক আমদানিতে বিলম্ব হলে তা তাদের ইভি উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করতে পারে।
এর আগে, মে মাসে জেনারেল মোটরস, টয়োটা, ভক্সওয়াগেন ও হুন্ডাইয়ের মতো শীর্ষ গাড়ি নির্মাতারা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়ে দ্রুত এই সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিল। অ্যালায়েন্স ফর অটোমোটিভ ইনোভেশন সতর্ক করে বলেছে, এই দুর্লভ খনিজ ছাড়া গাড়ির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।