ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ভয়াবহতার আশঙ্কা প্রকাশ করে দেশটিতে ধারাবাহিক হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। তাদের দাবি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের কাছাকাছি রয়েছে, আর তা রোধ করার জন্য এই হামলা প্রয়োজনীয় ছিল।
তবে মার্কিন গোয়েন্দারা খুঁজে পেয়েছে আরও একটি ভিন্ন তথ্য। ইরান কেবল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না; নির্মাণ ও পছন্দসই লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর সক্ষমতার তিন বছর দূরে রয়েছে তারা। সংশ্লিষ্ট চার গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে এমনটি জানিয়েছে বার্তা সংস্থা সিএনএন।
ইসরায়েলি বিমান হামলার পর মার্কিন গোয়েন্দাদের ধারণা, ইসরায়েলের এমন আক্রমণে হয়তো ইরানের পরমাণু কর্মসূচি মাত্র কয়েক মাসের জন্য পিছিয়েছে। এমনকি ইসরায়েল ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে। তবে ফোর্দোতে থাকা দ্বিতীয় বৃহৎ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সাইটটি অক্ষত রয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট মার্কিন অস্ত্র ও বিমান সহায়তা ছাড়া ফোর্দোর ক্ষতি করার সক্ষমতা ইসরায়েলের নেই।
ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসনের অধীনে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক শীর্ষ কূটনীতিক এবং সিএনএন বিশ্লেষক ব্রেট ম্যাকগার্ক সিএনএনকে বলেন, ‘ইসরায়েল এসব পরমাণু স্থাপনার ওপর নজর রাখতে পারে, সেগুলো অকেজো করে দিতে পারে। কিন্তু আপনি যদি সত্যিই এগুলো ধ্বংস করতে চায় তাহলে তা হয় মার্কিন সামরিক হামলা অথবা চুক্তির প্রয়োজন অত্যাবশ্যক।
আর এ বিষয়টিই মূলত ট্রাম্প প্রশাসনকে ইরান ইস্যু নিয়ে সংশয়ে ফেলেছে। কারণ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একটি ব্যয়বহুল, জটিল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এড়ানোর চেষ্টা করছে।
যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংস করতে ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িত করতে চান না। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সূত্রগুলো সিএনএনকে জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে ইসরায়েলের একমাত্র উপায় হলো মার্কিন সামরিক সহায়তা। বিশেষ করে, ভূগর্ভস্থ পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস করতে প্রয়োজন মার্কিন বোমা ও তা বহনকারী বি-২ বোমারু বিমান।
সোমবার কানাডায় জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরানকে ‘খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই’ আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানান।
এ আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, ইসরায়েলের সেন্ট্রাল কমান্ড মনে করে ইরান যদি লক্ষ্যের দিকে ছুটে যায় তবে আরও দ্রুত পরমাণু অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
সম্প্রতি মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলাসহ কিছু সামরিক কর্মকর্তা ইসরায়েলকে রক্ষা ও সমর্থনে আরও সহায়তা চেয়েছেন। কারণ, বর্তমানে ইসরায়েল যেভাবে ইরানের সঙ্গে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তা বড় ধরনের আক্রমণে সক্ষম নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সংঘাত বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করছে যাতে মার্কিন বাহিনী সুরক্ষিত থাকে এবং প্রয়োজনে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে পারে। ওই সূত্রটির মতে, মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড আকস্মিক হামলার প্রস্তুত থাকতে চাইছে।
সোমবার এক মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, রণতরী ইউএসএস নিমিৎজ ‘দেরি না করেই’ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম কিছু মার্কিন রণতরী আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে চলে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় মার্কিন নৌবাহিনীর দুটি জাহাজ অন্তত দু’বার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করেছে।
মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রায়ই মতপার্থক্য হয়।
ট্রাম্পের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড মার্চ মাসে বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না এবং সর্বোচ্চ নেতা খামেনিও পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি অনুমোদন করেননি, যা তিনি ২০০৩ সালে স্থগিত করেছিলেন।
রবিবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে— ‘গ্যাবার্ডের কথার সঙ্গে ইসরায়েলের গোয়েন্দা তথ্যের পার্থক্য’ কেন তা জানতে চাওয়া হয়।
মার্চের শেষ থেকে এ সপ্তাহের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে কিনা এবং মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ভুল ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা যে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেয়ার করেছি তা একেবারে পরিষ্কার। তারা ইউরেনিয়ামকে অস্ত্র বানানোর গোপন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। তারা খুব দ্রুত তা করছিল।’
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা গত সপ্তাহে বলেছে, ইরান নয়টি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য অস্ত্র-গ্রেডের সামান্য নিচের মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে, যাকে তারা ‘গুরুতর উদ্বেগের বিষয়’ বলে অভিহিত করেছে।
ইরানের জন্য চ্যালেঞ্জটি কেবল একটি অপরিশোধিত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে কয়েক মাসের মধ্যে এটি করতে পারে।