
করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে সারা বিশ^ উন্মুখ হয়ে আছে। কিন্তু টিকা তো আর এমনি এমনি আসে না। এর জন্য দরকার গবেষণা। সেই গবেষণার সূত্রপাতটা হয় ল্যাবে। তারপর অ্যানিমেল ট্রায়াল হয়ে হিউম্যান ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার পরই ঠিক হয় টিকাটি বাজারজাতকরণের অনুমতি পাবে কি না।
কোন দেশ আগে ভ্যাকসিন আনতে পারল, কোন কোম্পানি প্রথমে এটা বাজারে আনতে পারল, তার প্রতিযোগিতা চলছে বিশ^জুড়ে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ৯ সেপ্টেম্বর দেওয়া তথ্য মতে, বিশ^ব্যাপী বর্তমানে করোনার ১৮০টি ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা অব্যাহত আছে। এর মধ্যে অন্তত ৩৫টি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে বর্তমানে। এর মধ্যে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল চলছে নয়টি ভ্যাকসিনের। আবার ভ্যাকসিন বাজারে এলে কোন দেশ আগে পাবে, কোন দেশ কতটা পাবে, সে নিয়েও আছে প্রতিযোগিতা। এ নিয়ে নানা রকম রাজনীতিও আছে বলে আলোচনা হচ্ছে।
আমেরিকার নির্বাচনে ভ্যাকসিন রাজনীতি যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিতে পারে, সে কথাও বলছেন অনেকেই। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। করোনা ভ্যাকসিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশের একটি কোম্পানি করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে থাকলেও তা এখনো হিউম্যান ট্রায়াল বা মানবদেহে পরীক্ষার পর্যায়ে আসেনি। কিন্তু বাংলাদেশে করোনার ভ্যাকসিনের মানবদেহে ট্রায়াল বা তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। সেটা চীনের কোম্পানি সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন। এর সরকারি অনুমতি মিলে যাওয়ার পর চুক্তি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আইসিডিডিআর-বি হিউম্যান ট্রায়ালের অংশ হিসেবে ৪ হাজার ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীর সুরক্ষা ও সম্মানী নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবীরা কি অন্যান্য দেশের স্বেচ্ছাসেবীদের মতোই সুরক্ষা পাচ্ছেন এ প্রশ্নটিও উঠছে বেশ জোরেশোরেই। আমেরিকার ওহাইয়ো ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মোস্তাক মাহমুদ। ফাইজারের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নিয়েছেন তিনি। তার অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে। তিনি বলেন, ২৬ পাতার একটি চুক্তিপত্র আমাকে পড়তে হয়েছে। তারপরও তারা আমাকে বুঝিয়ে বলেছেন, এই ভ্যাকসিন ট্রায়াল নেওয়ার কারণে আপনার যদি কোনো শারীরিক অসুস্থতা হয় এবং সেটা যদি প্রমাণিত হয় যে এই ভ্যাকসিনের কারণেই সেই অসুস্থতাটা হয়েছে, তাহলে তার দায়-দায়িত্ব ও তার চিকিৎসার খরচ সবকিছু আমরা বহন করব। ...এই ট্রায়ালে অনেক ঝুঁকি আছে। এই ট্রায়ালের কারণে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই কথাটা জেনেই তুমি ট্রায়ালে অংশ নিচ্ছো। এটা আপনাকে আমরা ভালো করে বললাম। আপনি যাচাই করে দেখুন। মোস্তাক মাহমুদ আরও বলেন, ট্রায়ালের জন্য আমি যে ছয়টা ভিজিটে যাব, তার একেকটা ভিজিটে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। এর কমপেনসেশন হিসেবে আমাকে প্রতি ভিজিটে ১২০ ইউএস ডলার দেওয়া হবে। আর প্রতি সপ্তাহে যে ডেটা এন্ট্রি করতে হবে, তার জন্য সপ্তাহে পাঁচ ইউএস ডলার করে দেওয়া হবে। এটা চলবে দুই বছর পর্যন্ত। বাংলাদেশের চ্যানেল টোয়েন্টিফোর টিভির সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ডাক্তার মোস্তাক মাহমুদ। তার কথায় এটা স্পষ্ট, ফাইজারের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে যারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নেবেন, তাদের ইনস্যুরেন্স থাকবে। যেকোনো সমস্যা হলে তার দায়দায়িত্ব নেবে যারা ট্রায়ালটি চালাবে সেই প্রতিষ্ঠান। আর এতে অংশগ্রহণকারী আর্থিক সম্মানীও পাবেন অন্তত ১ হাজার ২০০ ইউএস ডলার বা প্রায় এক লাখ টাকা।
ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে অংশ নিতে গিয়ে ফিলিপাইন্স ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত অন্তত ৬০০ মানুষ মারা যায়, যার অধিকাংশই শিশু। আফ্রিকায় এইচআইভি ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের সময়ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে যারা অংশ নেবেন, তারা সব জেনে-বুঝে মানবকল্যাণে এগিয়ে আসবেন এটা যেমন সত্য, আবার তারা যে একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত নন, এটাও ঠিক। অনেকেরই হয়তো জানা আছে, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের করোনার টিকার ট্রায়ালে অংশ নেওয়া একজন স্বেচ্ছাসেবীর গুরুতর পাশর্^প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় এ ট্রায়াল তিন দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু মানবতার খাতিরে যারা বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালে অংশ নেবেন, তাদের ক্ষেত্রে কী কী সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকছে? এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে গবেষক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমাদের দেশে কি স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে ভ্যাকসিনের ঝুঁকি ঠিকমতো হাইলাইট করা হয়? আমাদের দেশে কি তাদের জন্য হেলথ ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা আছে? এগুলো নিশ্চিত করার বডিতে যারা আছেন, তারা কি এই বিষয়গুলো সত্যি সত্যি মনিটর করেন?
বাংলাদেশে মানুষের দেহে করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের দায়িত্বে থাকা আইসিডিডিআর-বি এ বিষয়ে কতটা সতর্ক এবং এ ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবীদের নিরাপত্তা ও সম্মানীর বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয় ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ দৈনিক ভোরের কাগজে। রাশেদ আলীর করা এ প্রতিবেদনে লেখা হয়, বাংলাদেশে চীনের তৈরি করোনার ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হলেও এর নিরাপত্তা ইস্যুতে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে, তেমনি কখনো তা শারীরিক জটিলতা বা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। সে কারণে ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে ভ্যাকসিন বা টিকার মান, ট্রায়ালে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যবীমা, সম্মানীসহ বিভিন্ন বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু দেশে এসবের কিছুই হচ্ছে না। প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের ইমিউনোলজিস্ট ও স্টাফ সায়েন্টিস্ট ড. মো. শামছুল আলম, ড. জুবায়ের রহমান এবং নেদারল্যান্ডসের ডব্লিউএইচও-ইউট্রেক সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর এফোরডেবল বায়োথেরাপিউকিক্সের ইমিউনোলজিস্ট ও প্রজেক্ট লিড ড. রেজাউল করিমের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লেখা হয়, ভ্যাকসিন অন্যান্য ওষুধের মতো নয়। শুধু নিরাপত্তা ইস্যুতে বিশ্বে ভ্যাকসিন তৈরির অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এজন্য সরকার ও প্রাইভেট ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে থাকে। ট্রায়ালের সব খরচ চীনা কোম্পানিটি দেবে। এতে লাভবান হবে আইসিডিডিআর-বি। কিন্তু যারা ট্রায়ালে অংশ নেবেন, তাদের নিরাপত্তায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেনকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশই যাদের ওপর ভ্যাকসিন ট্রায়াল করছে, তাদের কয়েক হাজার ডলার সম্মানী দিচ্ছে। সঙ্গে থাকছে ইনস্যুরেন্স। এটা নৈতিকতার প্রশ্নে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত পন্থা। কাউকে ট্রায়ালে অংশ নিতে বাধ্য করা যায় না। স্বেচ্ছায় অংশ নেওয়ার পরও কোনো ক্ষতি হলে বা মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই গরিব দেশের লোকজনের ক্ষেত্রে তা করে না। কৌশলে শুধু পরীক্ষার ফলাফলটা নিয়ে যায়।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ প্রথম আলোকে আইসিডিডিআর-বির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট কে জামান বলেছেন, আমাদের গবেষণায় আমরা যে টিকাটি ব্যবহার করব, তা একটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভাইরাসনির্ভর টিকা, পদ্ধতিটি দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এবং বহুল ব্যবহৃত। এ পদ্ধতিটি নিরাপদ বা খুবই কম ঝুঁকির বলেই মনে করা হয়। আমাদের গবেষণায় ব্যবহৃত টিকাটি ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আওতায় হাজার হাজার মানুষ গ্রহণ করেছে এবং অনেক চীনা নাগরিককে জরুরি ব্যবহারের অধীনে ইতিমধ্যে এই টিকা দেওয়া হয়েছে।
কে জামান এই টিকার ঝুঁকি কম বললেও একেবারে যে ঝুঁকিমুক্ত তা কিন্তু বলেননি। তাই যতটুকুই ঝুঁকি থাকুক, তাও বিবেচনায় নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। কারও কোনো ধরনের ক্ষতি হলে তার দায়ও নিতে হবে আইসিডিডিআর-বিকেই। পাশাপাশি অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও স্বেচ্ছাসেবীদের যাতে আর্থিক সম্মানী দেওয়া হয়, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা উচিত।
স্বেচ্ছাসেবীরা তো আর চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের সঙ্গে চুক্তি করছে না। যদি একটা লোকেরও ক্ষতি হয়, তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। সরকারকেই আইসিডিডিআর-বিকে বলতে হবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে তারা দাঁড়ায়, সব দায়িত্ব নেয়। কিন্তু সে আইনি ধারই যদি না থাকে, অর্থাৎ কোনো ইনস্যুরেন্সই যদি না থাকে, তবে কীসের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আইসিডিডিআর-বির কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবে?
লেখক
চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বায়তুস সালাত জামে মসজিদে গ্যাস লাইনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ইমাম ও মুয়াজ্জিনসহ ৩১ জন মুসল্লির নিহত হওয়ার ঘটনায় তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন লাইনে লিকেজ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকির কথা নতুন করে সামনে আসে। মসজিদ ট্র্যাজেডির পর দুর্ঘটনার আতঙ্কে পুরো নারায়ণগঞ্জজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় তিতাসের সঞ্চালন লাইনে অগুনতি লিকেজের কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। এসবের সূত্র ধরে উঠে আসে নারায়ণগঞ্জে তিতাস গ্যাসের বিপুল সংখ্যক অবৈধ সংযোগের বিষয়টিও। বিগত কয়েকদিনে তিতাসের অবৈধ সংযোগ ও নিম্নমানের সঞ্চালন লাইনে লিকেজ নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলোতে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। দেশ রূপান্তরসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের সদর, বন্দর, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লাসহ বিভিন্ন থানা এলাকায় তিতাস গ্যাসের অন্ততপক্ষে ২ লাখের মতো অবৈধ সংযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও তিতাসের কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায় অচিরেই আবার পুনসংযোগ পেয়ে যান অবৈধ সংযোগগ্রহীতারা। এসব অবৈধ সংযোগের কারণে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিপুল অপচয় হচ্ছে এবং সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনি নিম্নমানের পাইপ আর লিকেজের কারণে প্রতিদিনই দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
বুধবার দেশ রূপান্তরে ‘অবৈধ গ্যাসের ফাঁদ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জজুড়ে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় এসব অবৈধ সংযোগের ৯০ ভাগই নেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পাইপ ও সামগ্রী দিয়ে। জরাজীর্ণ লোহার পাইপ, এমনকি মাটির ওপর দিয়ে প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমেও নেওয়া হয়েছে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সংখ্যার হিসাবে রূপগঞ্জে অন্তত ২০ হাজারের বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস সংশ্লিষ্টরা। কয়েক বছর আগে তিতাস গ্যাস আবাসিক সংযোগ দেওয়া বন্ধ করার পর থেকেই বেড়ে যায় অবৈধ সংযোগ নেওয়ার তোড়জোড়। রাতের আঁধারে রাস্তা কেটে হাইপ্রেসার লাইন ছিদ্র করে ২-৩ ইঞ্চি ব্যাসের নিম্নমানের লোহার বা প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে নেওয়া হয়েছে এসব অবৈধ গ্যাস সংযোগ। অবৈধ গ্যাস সংযোগ সহজলভ্য হওয়ায় নতুন বাড়িঘর ও বহুতল ভবনগুলোতেও অবৈধ সংযোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব সংযোগের জন্য কোনো ধরনের মাসিক বিল দিতে হয় না গ্রাহককে। এই চিত্র কেবল রূপগঞ্জেরই নয়, শহর-বন্দর ও পাশর্^বতী এলাকাগুলোসহ পুরো নারায়ণগঞ্জের। তিতাস গ্যাস সূত্রে জনা যায়, ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হলেও গত ১০ বছরে পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রায় ১৭৯ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে। যার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। গত বছরের নভেম্বরে তিতাস কর্র্তৃপক্ষ বন্দর ও রূপগঞ্জ উপজেলায় ১০ দিন অভিযান চালিয়ে ১১ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে বন্দরের বিভিন্ন ইউনিয়নে ১৫ হাজার এবং আগস্টে বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নেই ৬ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে বিচ্ছিন্ন করা সংযোগের সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় সারা জেলায় কত সংখ্যক অবৈধ সংযোগ রয়েছে তিতাসের। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে যে, তিতাস গ্যাস কেন বিপুল সংখ্যক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় আরও উদ্যোগী হচ্ছে না।
শুধু নারায়ণগঞ্জেই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেই তিতাস গ্যাসের বিপুল সংখ্যক অবৈধ সংযোগ থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের পুরনো। তিতাসের একশ্রেণির কর্মকর্তা ও ঠিকাদার, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের যোগসাজশে সব সরকারের আমলেই তিতাস গ্যাসের হরিলুট চলছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিপুল অপচয় ও রাজস্ব বঞ্চিত হওয়া রোধ করতে কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রসঙ্গত, সারা দেশে তিতাসের মোট সঞ্চালন লাইন রয়েছে ১২ হাজার ২৫৩ কিলোমিটার। বৈধ গ্রাহক সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। কিন্তু এসব পাইপলাইনের বেশিরভাগ অংশই ইতিমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যা থেকে বিভিন্ন স্থানে লিকেজ আর মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অথচ তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পাইপলাইন প্রতিস্থাপনে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে দুবছর ধরে ফাইল চালাচালি হলেও তা আলোর মুখ দেখছে না। এমতাবস্থায় অবিলম্বে তিতাসের সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং এসব সংযোগ প্রদানে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি সারা দেশে তিতাসের মানসম্মত ও নিরাপদ গ্যাস সঞ্চালন লাইন নিশ্চিত করা আবশ্যক। সরকার এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেবে সেটাই কাম্য।
করোনার এই ক্রান্তিকালে লকডাউন অবস্থা উঠে যাওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্রুত প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন; স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড লি বাংলাদেশে ভি (V) ধাঁচের অর্থাৎ খাড়া গড়নের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রাক্কলন করেছেন। বর্তমানে দৃশ্যমান রপ্তানির প্রবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এই ধরনের আশা-জাগানিয়া প্রাক্কলনে অর্থবহ প্রতীতি জোগায়। সরকারও সংকট মোকাবিলায় অগ্রভাগে লক্ষাধিক কোটি টাকার স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এগুলো ঠিকভাবে কার্যকর করা গেলে আমাদের মতো পরিশ্রমী ও ঘুরে দাঁড়ানোর যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে স্বল্প সময়ে আগের অবস্থায় ফিরে আসা তেমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। তবে সামনে চ্যালেঞ্জ আছে অনেক।
দেশে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও করোনার সংক্রমণ এখনো অব্যাহত আছে, এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা ঢেউ এলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা কেউ জানে না। সামনের শীতকাল এই ব্যাধির কোনো অনুঘটকের ভূমিকায় কাজ করবে কি না, তাও আমাদের অজানা। আমাদের রপ্তানির গন্তব্যগুলো কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে, তার ওপর সেই সব জায়গায় আমাদের পণ্য-চাহিদা ও শ্রমবাজারের অবস্থা নির্ভর করছে। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় এখন হয়তো আগের বাতিল হয়ে যাওয়া কার্যাদেশগুলো আসতে শুরু করেছে। চীনের সঙ্গে আংকেল শ্যামের বাণিজ্যযুদ্ধও হয়তো এক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আগামী বৈশ্বিক পরিস্থিতি যে অবধারিতভাবে সব সময় আমাদের অনুকূলে যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আমরা এখনো আমাদের রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি; ৮৫ শতাংশের মতো আয় আসে ডিমভরা ঝুড়ির মতো ঝুঁকিপূর্ণ একটি মাত্র পণ্য তৈরি-পোশাক থেকে, সেটাও আবার শুধু সস্তা মৌলিক পণ্য উৎপাদনের চক্রে আবদ্ধ; উচ্চমূল্য বা ম্যান-মেইড-ফাইবার পণ্য উৎপাদনে আমরা আজও যে তিমিরে সেই তিমিরেই পড়ে আছি। এই ফাঁকে বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে চীন থেকে তৈরি-পোশাকের স্থানান্তরিত কেকের বড় টুকরাটা ভিয়েতনাম পকেটস্থ করে ফেলেছে। উচ্চমূল্য পণ্য তৈরিতে এগিয়ে থাকাসহ আরও বেশ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা থাকায় ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে আমাদের অতিক্রম করে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে গিয়েছে। এ বছর এ খাতে প্রথম ছয় মাসে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ১৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য, আর এ সময়ে বাংলাদেশ করেছে ১১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। প্রথম চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি ৪৬ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের রপ্তানি মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার; অথচ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি হয় মাত্র ২ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার মূল্য মানের পণ্য। ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আশিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিপত্র (FTA) সম্পাদন করেছে। সামনের গ্রীষ্মে সেগুলো কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। সেটা হলে তাদের রপ্তানির ভিত্তি আমাদের চেয়ে আরও শক্তিশালী হবে। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কোনো প্রস্তুতি দৃশ্যমান নয়; ২০২৭ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যাবে, আমরা শুধু সেই দিকে তাকিয়ে অলস সময় পার করছি। এই প্রেক্ষাপটে সতত প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের সম্মান নিয়ে বাঁচতে এবং উন্নয়ন-লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাড়াতে হবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, করতে হবে কর্মসৃজন, তৈরি করতে হবে দক্ষ কর্মীবাহিনী, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলতে হবে দেশ-বিদেশে নতুন নতুন চাহিদা মেটানোর কারিগর তৈরির সূতিকাগার হিসেবে। আমরা যাতে পিছিয়ে না পড়ি এবং উদ্ভাবনী শক্তির সদ্ব্যবহার করে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারি, তার জন্য আরও থাকতে হবে উন্নয়ন ও গবেষণায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও প্রণোদনা। কাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। কিন্তু সরকার যাদের দিয়ে এই কাজগুলো করাবেন, তাদের অধিকাংশের দক্ষতা, যোগ্যতা ও প্রেষণা বড়ই করুণ। তাদের ব্যবস্থাপনা ও পদায়ন যতটা না হয় মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে, তারচেয়ে ঢের বেশি হয় নৈকট্য, সংযোগ ও স্তাবকতার নৈবেদ্যে যেটা তাদের পেশাদার ব্যবস্থাপক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আদৌ অনুকূল নয়; কারণ, যোগ্যরা সাধারণত শক্ত মেরুদন্ড সম্পন্ন হন, তদবির ও স্তাবকতা তাদের ধাতে তেমন একটা থাকে না।
বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার সূচক ২০২০-এ বাংলাদেশ আগের বছরের চেয়ে ৮ ধাপ এগিয়ে ১৬৮তম অবস্থানে পৌঁছেছে। এটাকে অনেক কর্তা আমাদের অগ্রগতির উলম্ফন বলে দাবি করলেও প্রকৃত অবস্থা হলো এই উপমহাদেশে আমরা শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের যৎসামান্য ওপরে আছি, বাদবাকি সবাই আমাদের ওপরে চলে গিয়েছে। ২০১৪ সালে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪২, এখন ৬৩; শুধু ২০১৮ সালেই এক লাফে ১৪ ধাপ ডিঙিয়ে আজ তাদের এই অবস্থান। আমাদের এই অধোগতির কারণ সিরিয়াসলি খুঁজে বের করে দ্রুত তার প্রতিকার করতে হবে। মনুষ্য-স্পর্শবিহীন সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রবর্তন করায় ভারতে আমদানিকৃত পণ্যের ৪০ শতাংশ চালান ছাড় করার সময় ১২ ঘণ্টা থেকে ১২ মিনিটে নেমে এসেছে। আর আমাদের এখানে এখনো কাস্টম ক্লিয়ারেন্সে আমদানির ক্ষেত্রে গড়ে ৮ দিন এবং রপ্তানিতে গড়ে ৫ দিন সময় লাগছে। তবে আশার কথা হলো এই যে, এ কাজে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ‘জাতীয় একক বাতায়ন’(National Single Window) চালু করতে যাচ্ছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (BIDA) ওয়ান স্টপ সার্ভিস শক্তিশালী করতে যাচ্ছে। এগুলো কাজ করলে পরিস্থিতির কী উন্নতি হয়, আমরা এখন তা দেখার অপেক্ষায় আছি।
তবে দু’একটি ক্ষেত্রে খণ্ডিতভাবে সেবা দিয়ে দেশের বিনিয়োগ-পরিবেশের বাঞ্ছিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিদেশি বিনিয়োগ পর্যাপ্ত পরিমাণে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি দেশি বিনিয়োগেও গতি সঞ্চার করতে দরকার দেশের সার্বিক পরিবেশের উন্নতি। বিনিয়োগ পরিবেশের অভাবে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ কম নয়; Global Financial Integrity (GFI) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের পরিমাণ গড়ে বছরে ৬ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। দেশে বিনিয়োগ-পরিবেশের অপর্যাপ্ততা যে এই অর্থপাচারের অন্যতম একটি কারণ, তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া দেশের নাগরিকরাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে দ্রুত সেবা প্রত্যাশা করে। কিন্তু নাগরিকদের সেবাদান পরিস্থিতি আরও নাজুক।
এ প্রসঙ্গে দু’একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বলে পারছি না। অবসর নেওয়ার পর অপেশাদার চালক হওয়ার শখ হলো। এ জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের ২ তারিখে শিক্ষানবিসের ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করলাম। কিন্তু দেখলাম তাতে ড্রাইভিং পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ। সুদীর্ঘকাল পার করে দিলাম পরীক্ষা, পাসও করলাম। ডিসেম্বর মাসের ২৩ তারিখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদনপত্র জমা রাখা হলো। পরের দিন এ কাজে ছবি ওঠালাম ও আঙুলের ছাপ দিয়ে এলাম। মাস তিনেক পর লাইসেন্স সরবরাহের তারিখ নির্ধারিত হলো। সেদিন কাউন্টারে উপস্থিত হলে লাইসেন্স না দিয়ে ২০২০ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ লাইসেন্স প্রদানের সম্ভাব্য পরবর্তী দিন ধার্য করা একটি সিল আমার আবেদনের কপিতে বসিয়ে বিদায় করা হলো। দীর্ঘদিন পর নির্ধারিত তারিখে যখন আবার উপস্থিত হলাম, তখনো লাইসেন্স নয়, আগের মতো আরেকটা ছাপ পেলাম। এবার সময় বাড়ানো হয়েছে পুরো এক বছর, অর্থাৎ ২৩ আগস্ট ২০২১ সাল পর্যন্ত। এখন বুঝুন ঠেলাটা; যে দেশে একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে তিন বছরের বেশি সময় ক্ষেপণ হয়, সেখানে কোন আহাম্মক টাকা বিনিয়োগ করে বিপদে পড়তে চাইবে?
এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর জন্য ব্যবস্থাপনার খোলনলচে বদলাতে হবে; ঘটাতে হবে তার প্রকৃত অর্থে রূপান্তর। অতি কদাকার শূককীট-মূককীট থেকে যেমন অতি মনোহর প্রজাপতি পয়দা হয়, সে রকম কিছু; সেটাকে করতে হবে গুণতন্ত্রে (meritocracy) পরিণত; শুধু ওপরে ওপরে চুনকাম করে পরিবর্তনের চেষ্টা নিলে হবে না। নির্মোহভাবে কাজের মূল্যায়ন করে হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের (hire and fire) ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে; বদলি তার কোনো দাওয়াই হতে পারে না। যেখানে কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে, সেখানে দরকার শল্য চিকিৎসা আর কেমোথেরাপি। তদবিরকারীদের নয়, যারা তদবির করেন না, তেমন যোগ্য লোককে খুঁজে বের করে প্রাপ্য সম্মান ও সুবিধা দিয়ে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন করতে হবে, হতে পারেন তিনি সরকারি কর্মকর্তা, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কুশীলব। যিনি যে কাজ জানেন, বোঝেন ও কর্ম সম্পাদনে সক্ষম, তাকে সেই কাজে অভিষিক্ত করতে হবে। ‘বিডা’র মতো প্রতিটা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে। ইতিহাসে এর নজির রয়েছে।
সিঙ্গাপুরে যে ব্রিটিশ নৌঘাঁটি ছিল, ১৯৭০ সালের দিকে তা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসার আশঙ্কা তৈরি হয়; এতে সরাসরি ৩০ হাজার চাকরি ও জিডিপির ২০ শতাংশ হ্রাসের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই প্রেক্ষাপটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ ১৯৬৯ সালে স্বল্প পুঁজি-নির্ভর শ্রমঘন পর্যটন শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ নেন এবং গঠন করেন Singapore Tourist Promotion Board। এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি কোনো আমলাকে নিয়োগ দেননি; দিয়েছিলেন সিনেমা জগতের এক নক্ষত্র Runme Shaw যিনি এই কাজ ভালো বুঝতেন। সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক বেকার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এই প্রতিষ্ঠান বিশেষ অবদান রাখে। শুধু তাই না, দেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে দ্রুত পরিপুষ্ট করার লক্ষ্যে তিনি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে অধ্যয়নরত দেশীয় এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মেধাবী ছাত্রদের সিঙ্গাপুরে আসতে এবং চাকরি গ্রহণ করতে বৈদেশিক মিশনগুলোর মাধ্যমে তৎপরতা চালান। অতি মেধাবীদের জন্য মার্কিন করপোরেট রীতির আদলে তিনি ‘Green Harvest’ প্রকল্প চালু করেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চূড়ান্তভাবে পাস করার আগেই তাদের চাকরিতে নবিস হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয়।
উন্নয়নের একপর্যায়ে সত্তরের দশকে সুপ্রজনন বিদ্যার (Eugenics) সাধারণনীতি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মেধাবী জাতি গঠনের প্রয়োজনে তিনি নিজের দল, বিরোধী দল ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কড়া সমালোচনার মধ্যেও তার ‘মহা বিবাহ বিতর্ক’ এর সূত্রপাত করেন। সার্বজনীন শিক্ষার সুবাদে লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই শিক্ষিত হয়ে উঠছিল। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে করছিল না। এশীয় সংস্কৃতিতে স্ত্রীর মর্যাদা আর শিক্ষা বরের চেয়ে নিচে না হলে পরিবারে ও সমাজে অস্বস্তি বাড়ে। এইভাবে মেধাবী উচ্চশিক্ষিত ছেলেদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে হওয়াতে সমাজে উঁচুমানের মেধাবী পরবর্তী প্রজন্মের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছিল। এই সমস্যা নিরসনকল্পে মেধাবী পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে লি উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মেলামেশার মাধ্যমে বিয়ে বাড়াতে Social Development Unit গঠন করেন। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে এবং তাদের সন্তান সংখ্যা বাড়াতে তিনি নানা রকম সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থাও প্রবর্তন করেন।
আমরা বিশ্বাস করি যে, ব্যবস্থাপনায় গুণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। সিঙ্গাপুরের মতো সরকারি সেবাদান কাজে জবাবদিহি ও গুণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা গেলে আমাদের বিনিয়োগ যেমন বাড়বে, তেমনি নাগরিকরাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে দ্রুত সেবা পাবে; ত্বরান্বিত হবে আমাদের প্রত্যাশিত উন্নয়ন, বাড়বে সেবার মান।
লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক
আমাদের দেশের অনেকেরই হাবভাব আর গা-ছাড়া চলাচল দেখে ভাবা ঠিক হবে না যে করোনাভাইরাস ঝুঁকি থেকে আমরা মুক্ত। সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনাবলি মেনে চলে আমাদের নিজে সুস্থ থাকতে হবে, অন্যকেও নিরাপদে রাখতে হবে। সবাই নিরাপদ না হলে আমরা কেউই বিপদমুক্ত নই। মনে রাখতে হবে আমার হাতেই আমার সুরক্ষা। খুব কষ্ট পাই যখন দেখি আমাদের চারপাশে অনেকেই যত দ্রুত সম্ভব স্কুল খুলে দেওয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী! কিন্তু কেন? চিকিৎসাবিজ্ঞান আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। মেঘলা আকাশে সূর্য উঁকি দিল বলে। আমরা আশা করতে পারি নতুন বছর আমরা নতুন সম্ভাবনা ও শঙ্কামুক্তভাবে শুরু করতে পারব। একটা বছরের যদি ৭ থেকে ৮টা মাসই বাসায় থাকা গেল আর ২/৩টা মাস কি একটু সহ্য করা যায় না? নাকি এই সময়ে শিশুরা পুরো বছরের পড়া একবারে স্কুল থেকে শিখে নেবে! নিঃসন্দেহে পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে সবারই, অনেক অভিভাবকের অভিযোগ শিশুরা বাসায় থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে গেছে, চঞ্চলতা বেশি করছে, দুরন্তপনা বেড়ে গেছে, বাসা থেকে কোথাও যেতে পারছে না বলে বিরক্ত করছে ইত্যাদি। তাই বলে এই মুহূর্তে স্কুল খুলে দিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করাটাই কি একমাত্র সমাধান? দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেওয়ার মতো সচেতন এখনো হতে পারিনি। স্কুল খুলে দিলে শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হবে। যেখানে বাসের যাত্রী কমানোর জন্য ভাড়া বাড়িয়েও আমরা বড়রা নিয়ম মানতে পারি না, সেখানে কীভাবে শিশুদের কাছে আমরা আশা করব যে ওরা সব নিয়ম পালন করবে। দেখুন, শিশুরা অবুঝ ও নিষ্পাপ, ওরা বড়দের মতো করে বুঝতে পারবে না। কী ঘটতে পারে যদি বড়রা এক্ষেত্রে সচেতন না হয়? শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, অনুসরণ প্রিয় নয়। আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে যেখানে আমাদের পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ার পথে, আমরা কি পারি না এই সময়ে কোমলমতি শিশুদের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্যালয় ‘পরিবারের’ গুরুত্ব আরেকটু ভালো করে বোঝাতে?
আমরা বা আমাদের অগ্রজরা পরিবার থেকে যে সময়টা পেয়েছি, আসুন আমরা সেই সময়টা আমাদের সন্তানকে দেওয়ার চেষ্টা করি। আধুনিক জীবনের কর্মব্যস্ততার চাকায় আমাদের যে ছুটে চলার প্রতিযোগিতা চলছিল, করোনার জন্য তো তার লাগাম অনেকটাই টেনে ধরতে হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় একবার চিন্তা করুন তো করোনাপূর্ববর্তী সময়ে আমরা কতটা সময় সন্তানকে বা পরিবারকে দিতে পেরেছি। সর্বদা সীমাহীন ব্যস্ততায় সময় পার করেছি। আজ শিশুর যে দুরন্তপনা আর অস্থিরতাতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি, জীবনের কোনো এক মুহূর্তে এই দিনগুলোই আমাদের শ্রেষ্ঠ দিন বলে মনে হবে। তখন হয়তো মনে হবে যদি আরেকটু সময় পেতাম। আমাদের শিশুর অসুস্থতা বা অসুবিধা আমাদেরই সামাল দিতে হবে, অন্য কেউই এর প্রকৃত ভুক্তভোগী হবে না। হোক না পড়াশুনার একটু ক্ষতি, হোক না একটু দুরন্তপনা, তাতে কী? আমাদের শিশুরা তো সুস্থ থাকছে, আমাদের চোখের সামনে আছে, আর কয়দিনই বা থাকবে? সর্বোচ্চ ১০ বছর, ১২ বছর? তারপর যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবে, কর্মক্ষেত্রে যাবে, তখন তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না এখনকার একটা মুহূর্তও। তাই আসুন সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের জীবনে সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য, শিশুদেরও ভয়াবহ যান্ত্রিক জীবনে একটু দম নেওয়ার সময় দেওয়ার জন্য।
আশা করব সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই সবকিছু বিবেচনায় নেবেন, যেমনটা শিশুদের সুরক্ষার কথা ভেবে তারা এখনো বিদ্যালয় বন্ধ রেখেছেন। করোনাকে অভিশাপ দিয়ে নয় বরং এই সময় থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়নের যাত্রায় এখন সময় হয়েছে সঠিক জনশক্তিকে সঠিক জায়গায় রেখে, দক্ষ জনগোষ্ঠীকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানোর। আমরা অনেকেই দেশের জনগণের কষ্টার্জিত করের অর্থে পড়াশুনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাই। আমরা অবশ্যই দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং অবশ্য অবশ্যই কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত বলে মনে করি। আমরা বাবা-মা, ভাইবোন, পরিবারের ঋণ যেমন শোধ করতে পারব না, তেমনি কোনো কিছুর বিনিময়েই আমরা দেশের প্রতিদান দিতে অক্ষম। আবার এটাও দুঃখজনক, যেই সৃজনশীলতাকে ভিত্তি করে উচ্চশিক্ষার প্রয়াস, গবেষণাকে ভালোবাসা, গবেষক হয়ে ওঠা, আমাদের দেশ কি সেসব সম্ভাবনার যথাযথ লালন করছে? আমরা সৃজনশীল জনগোষ্ঠীকে কি প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছি অথবা তাদের চিন্তাশীল প্রজন্ম তৈরিতে কি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি?
স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গঠনে এখন সময় হয়েছে শুধু শিক্ষানির্ভর না থেকে গবেষণার গুরুত্ব বাড়ানোর। ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিক কোলাবরেটিভ কাজের পরিবেশ তৈরির কথা দয়া করে ভাবুন। দেশে যারা প্রশিক্ষিত-যোগ্য গবেষকমণ্ডলী আছেন, দয়া করে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে কার্পণ্য করবেন না। তারা কত রঙিন স্বপ্ন ত্যাগ করে দেশের টানে ফিরে এসেছেন, একটু অনুধাবনের চেষ্টা করুন। দেশের বাইরে দক্ষ যারা আছেন তাদের দেশে ফিরিয়ে কীভাবে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে অবদানে নিয়োজিত করা যায়, সেই লক্ষ্যে বিজ্ঞ গবেষকমণ্ডলীর পরামর্শ নিন। উন্নত দেশের গবেষণা কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, তুলে ধরুন। চীনসহ বিশ্বের গবেষণানির্ভর দেশগুলা যেখানে তাদের উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন সৃজনশীল জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে আনার জন্য পোস্ট-ডক্টরাল পজিশন থেকে গবেষণার সবরকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পূর্ণ অধ্যাপনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে, আমরা সেখানে কোথায় আছি? প্রবাসে সম্মানের পাহাড়ে অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকা একজন গবেষকের কাছে মাটির টানে মাতৃভূমিতে কর্মস্থলে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য সহানুভূতি কামনা করা কতটা লজ্জার, কতটা দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ভাবুন। প্রার্থনা করি, যোগ্য ব্যক্তিরা যোগ্য স্থানে থেকে দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবেন। ফার্মেসির একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যেকোনো কিছু চূড়ায় পৌঁছে গেলে তা নেমে আসবেই। সুদিন আসবেই, আমরা অবশ্যই পারব। স্বপ্ন দেখি, সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন আমরা সর্বস্তরে দূষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ দেখতে পাব। সেজন্য সবার আগে শিশুদের মেধাকে বিকশিত হতে দেওয়ার সুপরিবেশ খুব প্রয়োজন। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ, আমরা যেন তাড়াহুড়ো করে বা অবহেলাভরে শিশুদের সোনালি ভবিষ্যৎকে জেনেশুনে বিপদের মুখে ঠেলে না দিই।
লেখক : ফার্মাসিস্ট ও গবেষক, তয়ামা প্রিফেকচারাল ইউনিভার্সিটি, জাপান
১৯৩৪ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন কবি বিনয় মজুমদার। তার বাবার নাম বিপিনবিহারি মজুমদার ও মা বিনোদিনী। ১৯৪২ সালে তাকে বাংলাদেশের একটি স্কুলে ভর্তি করা হয় এবং ১৯৪৬ সালে গোপালগঞ্জের বৌলতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৮ সালে দেশভাগের সময় তারা সপরিবারে ভারতের কলকাতায় চলে যান। ১৯৪৯ সালে তাকে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৫১ সালে আইএসসি পড়ার জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। তিনি শিবপুর বিই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হোন। শোনা যায়, তার পাওয়া নম্বরের রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে গ্রন্থজগৎ থেকে বের হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নক্ষত্রের আলোয়’। কর্মজীবনে ১৯৫৮ সালে বিনয় মজুমদার অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন এবং পাবলিক হেলথে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে স্বল্পদিন চাকরি করেন। ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট কলেজেও তিনি অধ্যাপনা করেন। দুর্গাপুরে স্টিলপ্ল্যান্টেও কিছুদিন কাজ করেন। একসময় তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কাব্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। লেখা শুরু করেন ‘ফিরে এসো চাকা’। ১৯৬৬ সালে লিখতে শুরু করেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ’। ২০টির মতো কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। এর মধ্যে ‘ফিরে এসো চাকা’ তাকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে। ১৯৬২ সালে তিনি হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন। পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে একটি আলাদা হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করে কলকাতা কফি হাউজে বিলি করেন এবং হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন। রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। ২০০৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
চার বছর পর পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ খান। ইতিমধ্যে ভারতে শুরু হয়েছে 'পাঠান' ঝড়। তিন দিনেই বক্স অফিসে ৩০০ কোটির ঘর পেরিয়েছে সিনেমাটি।
পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম দিনেই বিশ্বজুড়ে রোজগারের অঙ্কে ১০০ কোটির গণ্ডি পার হয় 'পাঠান'। এর মধ্যে শুধু ভারতেই আয় হয় ৫৫ কোটি রুপি। দ্বিতীয় দিন ভারতের বাজারে ৭০ কোটি রুপির ব্যবসা করে 'পাঠান'। এ দিন শেষে সিনেমার আয় ছাড়িয়ে যায় ২০০ কোটির গণ্ডি। তবে তৃতীয় দিনে ভারতের বাজারে 'পাঠান'-এর আয় কিছুটা কমে ৩৯ কোটি রুপি হয়। তবে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের বক্স অফিসে এদিন মন্দা ছিল না। তিন দিনে সিনেমাটির বিশ্বব্যাপী আয় পৌঁছেছে ৩১৩ কোটি রুপিতে।
প্রসঙ্গত, যশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে 'পাঠান'-এ শাহরুখের সঙ্গী দীপিকা পাড়ুকোন। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন জন আব্রাহাম আর ডিম্পল কাপাডিয়া। ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করেছেন 'বলিউড ভাইজান' সালমান খান।
জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা-২০২০, ২০২১ পুরস্কার বিতরণ করবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন তিনি।
বিকেল সোয়া চারটায় এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাষ্ট্রপতি। এতে সভাপতিত্ব করবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান লাকি ইনাম। আলোচনায় অংশ নেবেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল।
এ উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়ে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাণীতে তিনি বলেন, শিশুদের সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ, তাদের অধিকার রক্ষা এবং শিশুবান্ধব এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটি অবশ্যই মন্ত্রণালয়ের একটি বাস্তবোচিত উদ্যোগ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের পথ অনুসরণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার জন্য শিশুরা আগামী দিনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমি আয়োজিত ২০২০ এবং ২০২১ সালের জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতাটি সারাদেশের উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ এবং বিভাগ থেকে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী শিশুদের অংশগ্রহণে ৩০টি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ শিশু অংশগ্রহণ করে।
প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৪৭৪ জন শিশু এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। ২০২০ সালের ছয়জন ও ২০২১ সালের ছয়জনসহ মোট ১২ জন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবে।
অনুষ্ঠানে শিশুর উন্নয়ন, বিকাশ ও সুরক্ষা বিষয়ে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হবে। এ উপলক্ষে স্মারকগ্রন্থ ‘আলোর ফুল’ প্রকাশিত হবে। অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে মেহেদী হাসান বাবু (২৫) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন অলিউর রহমান(২৪) নামের আরও একজন। আজ শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় মুন্সিগঞ্জের ধানখালী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত মেহেদী হাসান রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চী গ্রামের মাজেদ গাজী ও সাবেক ইউপি সদস্য আকলিমা বেগমের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে শ্যামনগর থানার ওসি নুরুল ইসলাম বাদল জানান, ট্রাকটি একপাশে দাঁড়িয়ে ধানক্ষেত থেকে ধান লোড করছিল। এ সময় মেহেদী হাসান মুন্সিগঞ্জ থেকে শ্যামনগরের দিকে দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। অন্ধকারে আলো কম থাকায় ট্রাকটি তিনি দেখতে না পেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেন। ঘটনাস্থলেই মেহেদী হাসান মারা যান। এ সময় আরোহী অলিউর রহমান (২৪) গুরুতর আহত হন। তাদের উদ্ধার করে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক অলিউর রহমানকে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। তার অবস্থাও আশংকাজনক বলে জানা গেছে।
ওসি বাদল আরও জানান, পুলিশ ট্রাক ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে। নিহতের পরিবারের মৌখিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ে অর্থের প্রলোভন দিয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে হারুন নামে এক রিকশাচালককে আটক করেছে এলাকাবাসী। শনিবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রাম থেকে তাকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে রাতে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। আটক হারুন নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মনু মোহাম্মদের ছেলে।
স্থানীয়রা জানায়, দুপুরে ওই শিশুর অভিভাবক বাসায় না থাকার সুযোগে টাকার প্রলোভন দিয়ে টাঙ্গন নদীর ওপারে নিয়ে যায়। সেখানে ভুট্টাক্ষেতে নিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিশুটিকে ধর্ষণ করে। বাড়িতে এসে ওই শিশু তার মাকে বিষয়টি জানালে এলাকাবাসী উত্তেজিত হয়ে সন্ধ্যায় ধর্ষককে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে।
গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, আটক হারুনের তিনটা বিয়ে হয়েছে। তার ঘরে স্ত্রী থাকে না। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একই গ্রামের এক গৃহবধূ বলেন, আমাদের মেয়ে, ভাতিজি যদি নিরাপদ না থাকে তবে আমরা যাব কোথায়? এ ঘটনায় আটক হারুন গ্রামবাসীর কাছে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন।
পৌসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডেও কাউন্সিলর রমজান আলী বলেন, আমি শুনেছি, আটক হারুন দুপুরে ওই শিশুকে ধর্ষণ করেছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানায় পুলিশ।
অন্নচিন্তা বড় চিন্তা। তা মাসকাবারি আমজনতা হোক আর মহাপরাক্রমশালী সরকারই হোক। চালের চিন্তায় সবারই কপালে ভাঁজ পড়ে। গরিবের মোটা চাল হোক আর বিয়েবাড়ির সুগন্ধি চাল কোনো চালেরই দাম স্থির ছিল না গত বছরগুলোয়। আটার দামের দমও ধরা যায়নি। সাধনা করেও চাল-আটার চালচিত্র বুঝতে পারেননি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
বুঝতে পারেননি বলেই একের পর এক উদ্যোগ। দেশের ঘুপচিঘর মাড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিদেশের আলিশান বাজারও। তাতেও স্বস্তি মেলেনি। চালের দর নিয়ে চার বছর চিন্তায় ছিলেন। এখন মহাচিন্তায়। নির্বাচনী বছরটা অন্তত স্বস্তিতে রাখতে চান ভোটারকে, দলীয় নেতাদেরও।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছিল। পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের জোগান দেওয়া ছিল ইশতেহারের অন্যতম লক্ষ্য। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সফল ধারা অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে। এর কোনোটাই হয়নি। স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা একদিকে বলা হয়েছে অন্যদিকে আতপ আর সিদ্ধ চালের জন্য মন্ত্রী সচিব হন্যে হয়ে ছুটেছেন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম আর কম্বোডিয়ায়। হাত বাড়িয়েছেন প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতে। রাশিয়া থেকে গম আনতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের লবিং লেগেছে।
গত ৭ জানুয়ারি ছিল বর্তমান সরকারের চার বছর পূর্ণতার দিন। সচিবালয়ে দপ্তরে বসে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নিজে নিজে চার বছরের হিসাব মেলাচ্ছিলেন। এ হিসাব মেলানোর মধ্যেই দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদক হাজির হন তার সামনে। প্রতিবেদকও জানতে চান কেমন করলেন চার বছর, সময় তো শেষ হয়ে আসছে। নির্বাচন হাতছানি দিচ্ছে।
পৌষের সূর্য তেরছাভাবে দক্ষিণ দিকে হেলে খাদ্যমন্ত্রীর রুমে আরামের উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। সূর্যের উত্তাপ আর চাদরের ওমে মন্ত্রী আরামেই ছিলেন। নির্বাচনের কথা শুনে চাদরের ওম আর আরামদায়ক হয়নি মন্ত্রীর কাছে। চাদরখানা সরিয়ে চেয়ারের হাতলে রাখার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাচ্ছিল মূল্যায়নের জেরার মধ্যে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মন্ত্রী।
প্রসন্নমুখে মন্ত্রী বললেন, ‘বলুন কী শুনতে চান।’ চার বছর কেমন কাটল দেশ রূপান্তরের প্রশ্ন। সেটা তো গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে আপনার কাছে শুনতে চাই, মন্ত্রীর জবাব।
মন্ত্রী হিসেবে আপনার নিজস্ব মূল্যায়ন কী? জবাবে তিনি তার চেষ্টার কথা জানান। মন্ত্রীর মতে, যখন বাজারদর চড়ে গেছে তখনই তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করে বা বিদেশ থেকে আমদানি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন বেশি সংকট দেখা দেয় তখন বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি উন্মুক্ত করা হয়। খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি করে (ওএমএস) নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তিতে রাখার চেষ্টাও ছিল। অতিদরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারের কাছে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল-আটা কালোবাজারে বিক্রি হয়েছে। বিশেষ করে মহামারীর সময় যখন ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূলের নেতাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর কথা তখন কিছু ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বার সরকারের চাল কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘অভিযোগ উঠেছে সত্য, কিন্তু সরকারও ব্যবস্থা নিয়েছে। এর দায় শুধু খাদ্য অধিদপ্তরের নয়, ব্যবসায়ীরাও এর জন্য দায়ী।’
দেশ রূপান্তরের প্রতিনিধি জানতে চান, গত চার বছরই বাম্পার ফলন হয়েছে। এ সময়ে চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে হটিয়ে তৃতীয় হয়েছে বাংলাদেশ। তারপরও চার বছরের কোনো সময়ই বাজার স্বস্তিদায়ক ছিল না। প্রতিটি আমন ও বোরোর ভরা মৌসুমে বাজারে চালের দাম বেশি ছিল। এ অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, অন্যান্য নিত্যপণ্য বাজারের তুলনায় চালের বাজার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিল। বলা হয়েছিল, করোনাকালে দুই লাখ লোক না খেয়ে মারা যাবে, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা বলেছিল দুর্ভিক্ষ হবে। তা কিন্তু হয়নি। চালের বাজার বিভিন্ন পলিসি দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মনিটরিং করা হয়েছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য দিয়ে ঠিকমতোই এ সেক্টর চলেছে বলে মনে করেন খাদ্যমন্ত্রী।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কি এককভাবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব জানতে চাইলে মন্ত্রী না-সূচক জবাব দেন। চাহিদা ও জোগান খাদ্য মন্ত্রণালয়কে দেখতে হয়। কীভাবে বাজারটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সবকিছু মিলেই সাফল্যের সঙ্গে কাজটি করার দাবি মন্ত্রীর।
সাধারণ মানুষের ধারণা এমনকি কিছু মিডিয়া রিপোর্টও করেছে যে, আপনি একসময় চাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মন্ত্রীর নিজের চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতা থাকায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে বলে সাধারণের প্রত্যাশা ছিল। এ প্রত্যাশা কি আপনি মেটাতে পেরেছেন জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ধান-চালের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ১৯৭৩-৭৪-এর সংকটকালে দুই বছর সরকারের এজেন্ট ছিলাম। তখন সরকার বড় বড় জোতদারের ওপর লেভি ধার্য করেছিল। কর্মকর্তারা গিয়ে অর্ডার করে আসত নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান সরকারি গুদামে দেওয়ার। আমি ওই ধানটাই সংগ্রহ করে সরকারের গুদামে দিয়ে আসতাম। এর বেশি কিছু ছিল না। আমি কখনই চাল ব্যবসায়ী ছিলাম না।’
আপনি গত চার বছরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মিলাররা কতটুকু মজুদ করতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে আইনের খসড়া করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে, জাত না থাকার পরও মিলাররা মিনিকেট উল্লেখ করলেই শাস্তি পেতে হবে। খসড়া করলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অনেকে ধারণা করছেন বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের ব্যবসায় নেমে পড়ার কারণে আইনের খসড়াটি আটকে গেছে। খসড়া আইনটি বাস্তবায়ন করতে সমস্যা কোথায় এ প্রশ্নে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, খসড়া আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। তাদের কাছ থেকে এলেই মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।
সরকার যে পরিমাণ চাল কেনে তা মোট চাহিদার মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। এ পরিমাণ চাল কিনে বা আমদানি করে পুরো চালের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ কি আদৌ সম্ভব এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে চাল কিনে রেশন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেওয়া হয়। এসব কর্মসূচিতে যেটুকু দরকার ওটুকুই সরকার কেনে। বাজারে চালের দর যদি আকস্মিকভাবে বেড়ে যায় বা হঠাৎ কমে গিয়ে উৎপাদন খরচ তোলাটাই কষ্টকর হয়ে যায় তখন সরকারের এ কেনাকাটাটুকুই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আপনি কি সফল দেশ রূপান্তরের এ প্রশ্নে হ্যাঁ-সূচক জাবাব দেন মন্ত্রী।
আপনি দাবি করছেন আপনি সফল। অথচ ২০২১ সলে চালের কেজিপ্রতি দর ছিল ৪৮ টাকা। এক বছরের মাথায় সেটা ৫৮ টাকা হয়ে গেছে। তাহলে সফল হলেন কী করে। জবাবে মন্ত্রী বলেন, তখন বেসরকারি আমদানির ওপর কোনো ট্যাক্স ছিল না। এ সুযোগে বেসরকারিভাবে অনেক চাল এসেছিল। কৃষক ন্যায্য দাম পেত না। এর প্রতিবাদে কৃষক ধানের ক্ষেতে আগুন দিয়েছিল। সেই অবস্থায় আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আগের ওই অবস্থা থাকলে দেশে হাহাকার পড়ে যেত চালের জন্য। ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষক অন্য আবাদে চলে যাচ্ছে। অনেক জমি পতিত পড়ে থাকত। একটা কূলকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকটাকে ধ্বংস করা যাবে না। ১০ টাকা দাম বেড়েছে শুধু এটা চিন্তা না করে ভোক্তার কেনার ক্ষমতাও বেড়েছে সেটাও চিন্তা করতে হবে। পণ্যের দাম বৈশি^কভাবে বেড়েছে। শুধু আমাদের এখানেই বাড়েনি। নিম্ন আয়ের মানুষের যেন কষ্ট না হয়, সে জন্যই তো ওএমএস চালু করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
গত চার বছরের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই খাদ্য অধিদপ্তরের জনবল সংকট ছিল। আপনি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেও সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেননি। জবাবে মন্ত্রী বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নিয়োগ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করি। এ নিয়োগ শেষ হলে আরও দেড় হাজার পদে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হবে। সেই প্রক্রিয়াও আমরা এগিয়ে নিচ্ছি।
আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সারা দেশে প্রতিটি পাঁচ হাজার টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ২০০টি পেডিসাইলো (ধানের গুদাম) নির্মাণ করার কথা বলেছিলেন। গত চার বছরে একটি গুদামও নির্মাণ করতে পারলেন না কেন? এ ব্যর্থতার জন্য কি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দায়ী নাকি কারও অদক্ষতা দায়ী এর সরাসরি জবাব না দিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রকল্প পাস হয়েছে। পেডিসাইলো নির্মাণের জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগ হয়ে গেছে। আপাতত ৩০টি গুদাম হবে।
এসব গুদামের জনবলের জন্য কত বছর বসে থাকতে হবে খাদ্য অধিদপ্তরকে, এই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, বসে থাকতে হবে না। নিয়োগের প্রক্রিয়াও আমরা শুরু করে দিয়েছি। পেডিসাইলোগুলো উদ্বোধনের দিন থেকেই জনবল থাকবে।
একজন আমদানিকারক জানিয়েছেন, গত চার বছর চাল ও খোলা আটার বাজার অস্থির ছিল। সেই অস্থিরতা নির্বাচনী বছরে যেন না থাকে সেই চেষ্টা খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ওই আমদানিকারক আরও জানিয়েছেন, সরকারের আয় কমেছে। এ কারণে খাদ্যে ভর্তুকিতেও টান পড়েছে। গরিবের ১০ টাকা কেজির চাল ১৫ টাকা হয়েছে। আটায় কেজিতে ৬ টাকা বেড়েছে। সবকিছু মিলে মন্ত্রী সাধন সাধনা করলেও সাধারণ মানুষ চাল-আটার বাজারে পিষ্ট হয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।