
ভারত কেমন করে বাংলাদেশকে গিলে খাবে?
তেহরানের দৈনিক কিয়ান আওয়ামী লীগপ্রধানের যে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তার ওপর ভিত্তি করে করাচির ডন পত্রিকায় ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশ :
তেহরান, ১৯ ফেব্রুয়ারি : যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ফেডারেল পাকিস্তান হওয়ার কারণে ভারত না আবার বাংলাদেশকে ‘খেয়ে ফেলে’ মুজিব হেসে ওঠেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন, ‘আজকাল কেউ কাউকে খেয়ে ফেলতে পারে না। ভারত তো তাদের বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হিমশিম খেয়ে যায়, আমাদের দরিদ্র লোকরা ভেঙে পড়ার পর্যায়ে এলেও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে।’
তিনি বলতে থাকলেন, ‘ভিয়েতনামের দিকে তাকান, আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ তার ইচ্ছে চাপাতে গিয়ে গরিব কৃষকের মাতৃভূমিতে কত অসহায় হয়ে পড়ছে। আমেরিকা যদি ভিয়েতনামকে খেয়ে ফেলতে না পারে, ভারত কেমন করে বাংলাদেশকে খাবে?’
তিনি বলেন, শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নয়, ফেডারেল কাঠামোর আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের অধিকার তিনি নিশ্চিত করতে চান।
তেহরানের দৈনিক কিয়ানের প্রতিনিধিকে ঢাকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা চাই সুবিচার ও ঐক্যের ভিত্তিতে সমগ্র জাতি উন্নতি লাভ করুক। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পাকিস্তানই হবে শক্তিশালী পাকিস্তান। তার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ কিন্তু পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে সক্রিয় বন্ধুত্ব থাকবে।’
শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, যারা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে, তারা কুৎসা রটনাকারী। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে যেসব ভুল করা হয়েছিল তা সংশোধন করতে পারলে পাকিস্তান শক্তিশালী হয়ে উঠবে, অন্যদিকে বর্তমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান এত দুর্বল হয়ে পড়বে যে, তা থেকে আর উত্তরণ সম্ভব হবে না।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ আর পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের নির্দেশনা দিতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের কর্মসূচি শুধু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নয়। ফেডারেল কাঠামোর আওতায় আমরা চাই পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিকারও সুরক্ষিত হোক।
বাংলাদেশকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে রাখা পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদেরও প্রকৃত স্বার্থের পরিপন্থী। এখন যা স্থানীয় দারিদ্র্য, দীর্ঘ মেয়াদে তা-ই সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা চাই ধনবাদী পদ্ধতির যে একচেটিয়াবাদ ও ট্রাস্ট লাখো মানুষের দারিদ্র্যের বিনিময়ে কিছু মানুষকে মোটাসোটা করছে, তার অবসান ঘটুক।
অর্থনৈতিক নীতিমালা : সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতিমালায় প্রধান সেক্টরসমূহ ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, ভারী শিল্প, বিদেশ-বাণিজ্য, পাট, তুলা, যানবাহন বিশেষ করে জাহাজ পরিবহন পুরোপুরি জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, এতে কোটারি শক্তি ভেঙে যাবে এবং দেশের ফেডারেল ইউনিটগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যার যার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারবে এবং জনগণ রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাবে।
বিদেশি ঋণ : তার অর্থনৈতিক নীতিমালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উদারীকরণ, ‘বৈদেশিক ঋণের অভিশপ্ত বোঝা’ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা ‘আমরা অতীতে উন্মত্তের মতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছি, আমাদের গ্রহণ করা ঋণে কিছুসংখ্যক পুঁজিবাদী এবং প্রশাসনে তাদের এজেন্টরা পুষ্ট হয়েছে আর ঋণের বোঝা ও ঋণের সুদের বোঝা বহন করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।
তিনি চান ফেডারেল সরকার পূর্ণ কর্মসংস্থান, খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং ইরানের ‘লিটারেসি কোর’-এর মতো সংগঠনের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের গ্যারান্টি দিক। তার পররাষ্ট্রনীতি জোটনিরপেক্ষ থাকার এবং পৃথিবীর সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার এবং আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা নিষ্পত্তি করার।
তিনি চান পাকিস্তান ‘সেন্টো’ এবং ‘সিয়োটো’ থেকে বেরিয়ে আসুক, তবে তিনি চান পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের একত্রে থাকার আরসিডি গ্রুপ থাকুক এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণে তো আরও বড় হোক।
কাশ্মীরবিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একনায়কত্বের দোহাই দিতে এবং সমরাস্ত্রের জন্য বিপুল ব্যয় করতে সামরিক বাহিনী ও পুঁজিবাদীরা কাশ্মীরকে ব্যবহার করছে। ‘তবুও’ জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’
মুজিব ভারতের সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক রক্ষা করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমরা একই উপমহাদেশের ভাগীদার। পছন্দ হোক বা না হোক আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব : চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব মুজিবের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং নীতিই বন্ধু নির্ধারণ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু তার মানে এই নয় আমাদের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমরা মুসলমান এবং আমরা কখনো কমিউনিজম গ্রহণ করব না।’ ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুজিব বলেন, ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক এবং আবেগময় বন্ধনে দুদেশ এমন দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ যে এ নিয়ে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই এবং এই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশকে কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।
শেখ মুজিব পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এর বৈঠকের কার্যবিবরণীর ওপর ভিত্তি করে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ পাকিস্তান অবজারভারের প্রতিবেদন :
শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ডেপুটি লিডার এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি এ এইচ এম কামারুজ্জামান পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন। দিনাজপুরের ইউসুফ আলীকে পার্টির চিফ হুইপ এবং টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান এবং কুষ্টিয়ার আমিরুল ইসলামকে হুইপ নির্বাচিত করা হয়েছে।
জাতীয় পরিষদ সদস্যদের আড়াই ঘণ্টার বদ্ধ-দুয়ার বৈঠকের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দীন আহমদ অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের শুধু পার্লামেন্টারি পার্টিতে নির্বাচিতদের নাম বলেন কিন্তু সভার অন্য কোনো বিষয় সম্পর্কে তিনি মুখ খোলেননি। আওয়ামী লীগ সভার আলোচ্য বিষয় নিয়ে মুখ না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অনুমিত হচ্ছে।
পার্টিপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জাতীয় পরিষদ সদস্যদের অবহিত করেছেন। কায়েমি স্বার্থবাদী মহল শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ভ-ুল করে দেওয়ার যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে প্রেক্ষাপটে তার পার্টির করণীয় সম্পর্কে তিনি পরিষদ সদস্যদের কাছে ব্যাখ্যা করেছেন বলে জানা গেছে।
সভা শেষ হলে শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারের সভায় ভুট্টো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার যে শর্ত আরোপ করেন সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে তার দলের কী অবস্থান হবে, তা তিনি সোমবার জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের যৌথসভায় ব্যাখ্যা করেছেন।
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি খন্দকার মোশতাক আহমেদকে জাতীয় পরিষদের স্পিকার মনোনীত করতে পারে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে মোশতাকের ভক্তদের পছন্দ তার জন্য মন্ত্রীর পদ। তারা মনে করেন, স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন তাকে পার্টি কার্যক্রম থেকে সরিয়ে নেবে।
সম্ভাব্য মন্ত্রীরা
আগামী দিনের মন্ত্রী কারা হবেন তা নিয়ে দলের ভেতরের অনুমান এখন প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আসছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ দেওয়া হবে বলেই পার্লামেন্টারি পার্টিতে তাকে কোনো পদে বসানো হয়নি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আর যারা স্থান পেতে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছেন কর্নেল ওসমানী, মশিউর রহমান, কামারুজ্জামান, এম আর সিদ্দিকী, ডক্টর কামাল হোসেন এবং মোহাম্মদ ইদ্রিস।
সিদ্দিকী এবং ইদ্রিস উভয়েই চট্টগ্রামের বলে তাদের একজনকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হতে পারে। মন্ত্রী পদপ্রত্যাশী অন্যদের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় রাখার কিংবা বিদেশে, করপোরেশনে, ব্যাংক বা কমিশনে পদায়নের আশ^াস দেওয়া হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে বিরোধীদলীয় সাবেক নেতা আবদুল মালেক উকিলকে জাতীয় পরিষদে ডেপুটি স্পিকারের পদটি দেওয়া হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সমঝোতার পথ খোলা নেই
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রদান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৭ ফেব্রুয়ারি করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে যে বিবৃতি দেন এবং যেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে ১৮ ফেব্রুয়ারি করাচির ডন-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুবাদ :
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জেড এ ভুট্টো গতকাল আবারও বলেছেন, দেশের জন্য উপযোগী একটি সংবিধান যদি প্রণয়ন করতে হয় তাহলে সংবিধান প্রণয়নে সবার অংশ থাকতে হবে।
করাচিতে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ৩ মার্চ থেকে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে পিপলস পার্টি যোগদান অর্থহীন হবে। যে সংবিধান প্রণয়নে জাতীয় পরিষদ সদস্যদের কোনো ভূমিকা নেই, সেখানে নির্বাচিত সদস্যরা ঢাকা পর্যন্ত গিয়ে এরই মধ্যে তৈরি করা সংবিধানে শুধু সম্মতি জানিয়ে আসতে পারেন না।’
তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রতি ভারতের যুদ্ধংদেহী মনোভাব পশ্চিম পাকিস্তানের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। লাহোর সীমান্ত এবং পাশর্^বর্তী অঞ্চলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী চলাচল করছে এবং ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণের জন্য বক্তব্য প্রদানে একটি অন্যটিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ভুট্টো বলেন, অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধেছে। শুধু দেশের ভেতরেই যে সংকটাপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হবে তা নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ করে লাওসের অবস্থা বিবেচনা করলে পরিস্থিতি জটিলতা অনুধাবন করা যাবে।
ভুট্টো বলেন, তার পার্টির প্রকাশ্য যে অভিমত তার প্রেক্ষাপটে দলের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকা যাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। এ অবস্থায় পার্টির সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব তাদের জনগণের পাশে দাঁড়ানো। ভুট্টো বলেন, তার পার্টি ছাত্রদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। ১১ দফার ১০টি দফাই মেনে নিয়েছে। একাদশ দফা আসলে ছয় দফার অংশ।
তিনি বলেন, তার দলের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্তে বর্তমান সরকারের কোনো আশীর্বাদ নেই। ‘দৃশ্যের আড়ালে’ তার সঙ্গে অন্য কারও কোনো চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় সংসদ ‘কসাইখানায়’ পরিণত হবে। আওয়ামী লীগের ছয় দফার মধ্যে সবচেয়ে জটিল বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সহায়তা প্রাসঙ্গিক অংশ।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমার সূচনা ও মূলে রয়েছে একুশের আত্মদান। যার প্রতীক শহীদ মিনার। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকর্মীদের শহীদ হওয়ার ঘটনা এবং শহীদ মিনার বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের সব সংগ্রামের অনুপ্রেরণার অসীম উৎস। এ কারণেই শহীদ মিনার শত্রুপক্ষ তথা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছে বারবার।
২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদদের লাশ তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। লাশগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলে এবং গভীর রাতে গোপনীয়তার সঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে পুলিশ। শহীদের লাশকে কেন্দ্র করে যেন আন্দোলন আরও তীব্রতা না পায় এবং রক্তাক্ত অধ্যায়ের প্রামাণ্য (ঊারফবহপব) দ্রুত আড়াল করাই ছিল এর লক্ষ্য। তখন বাংলাভাষার দাবির আন্দোলনকারীদের মধ্যে আওয়াজ ওঠে ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। এই আওয়াজ ও প্রাণ বিসর্জনের শোককে আরও নির্দিষ্ট করা এবং শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাকে মূর্ত রূপ দিতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১২ নম্বর ব্যারাক সংলগ্ন ছাত্রদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করেন মেডিকেলের ছাত্ররা। প্রথম শহীদ মিনারের প্রথম নকশাটি করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র বদরুল আলম। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখায় জানা যায়, মেডিকেলের ছাত্ররা শহীদ মিনারের নকশা করার জন্য দায়িত্ব দেন তখনকার ছাত্র ডা. বদরুল আলমকে। কারণ বদরুল আলম ভালো আঁকতে পারতেন। বদরুল আলম ২২ ফেব্রুয়ারি একটি নকশা করেন। ওই নকশাটি বাস্তবায়ন করা ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ওই মুহূর্তে অত সময় নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিবেশ ছিল না। তাই নকশাটি সংশোধন করার জন্য নেতস্থানীয় ছাত্র গোলাম মাওলা, শরফুদ্দিন আহমদ, আলীম চৌধুরী এবং সাঈদ হায়দার বদরুল আলমকে পরামর্শ দেন। তখন বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার মিলে আরেকটি নকশা তৈরি করেন। দ্বিতীয় নকশাটি সবার অনুমোদন লাভ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি এটি নির্মাণ করা হয়। (প্রথম আলো, ২১.০২.২০১২)
১৯৯০ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘শহীদ মিনারের ইতিকথা’ শীর্ষক এম আর আখতার মুকুলের লেখায়ও একই মত পাওয়া যায়। সেখানে তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ মিনার নির্মাণকাজে অংশগ্রহণকারী মেডিকেল ছাত্রদের সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন। তাই দেখা যাচ্ছে, প্রথম শহীদ মিনারের নকশাটি বদরুল আলম এবং সাঈদ হায়দারের যৌথ শ্রমের ফসল। এই তথ্যের অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায় প্রথম আলো’তে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত সাঈদ হায়দারের ‘প্রথম শহীদ মিনার’ শীর্ষক লেখায়ও।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে তখন নির্মাণকাজ চলছিল। কাজের ঠিকাদার ছিলেন মোত্তালেব ও পিয়ারু সরদার। কলেজ ক্যাম্পাসের গুদামঘরে ছিল নির্মাণ সামগ্রী। ছাত্রদের দাবিতে গুদামঘরের চাবি দিয়ে দেন ঠিকাদার। ছাত্ররা তখন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাত করে ইট এবং বালতিতে করে পানি আনেন। রোগীর স্ট্রেচারে করে আনা হয় বালি ও সিমেন্ট। এভাবেই মেডিকেল ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে ১২ নম্বর ব্যারাকের সামনে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। মিনারের ওপরের অংশে কাগজে বড় অক্ষরে এর পরিচয় লেখা হয় ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’।
এরপর শহীদ শফিউর রহমানের বাবা পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা মৌলভী মাহবুবুর রহমানকে এনে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করা হয়। পরে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে তৎকালীন আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে দিয়ে শহীদ মিনারকে আরেকবার উদ্বোধন করানো হয়। বদরুদ্দীন উমরের মতে, শহীদ মিনারে একটি সমাবেশ করার প্রয়োজনীয়তার কারণেই খুব সম্ভবত দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি করা হয়। এম আর আখতার মুকুলের মতে, আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করার ঘটনায় ছাত্রসমাজ খুব উৎসাহিত হয়। এ কারণে তাকে দিয়ে দ্বিতীয়বার শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়। শহীদ মিনার ভাঙতে ব্যাপক প্রস্তুতি ও শক্তিমত্তা ব্যবহার করা হয়। ভাঙা শুরুর আগে মেডিকেল কলেজ এলাকা ঘেরাও করা হয়। এরপর ট্রাকভর্তি সশস্ত্র পুলিশ আসতে থাকে। একটি ট্রাকে আনা হয় বড় আকারের কাছি, বেলচা, শাবল এবং গাইতিসহ অন্যান্য সরাঞ্জামাদি। এ যেন রণযাত্রা। শহীদ মিনারের চারপাশে মোটা রশি লাগিয়ে পুলিশ সম্মিলিতভাবে টানতে শুরু করে। মিনারের ইট-সিমেন্ট ও বালির গাঁথুনি তখনো ভালোভাবে মজবুত হয়নি। তাই ব্যাপক শক্তি প্রয়োগে এটি ভেঙে পড়ে। ভিত্তি ৭ ফিট পর্যন্ত গভীর ছিল। পুলিশ গাঁইতি দিয়ে সেটি তুলে ফেলে। গর্তটি মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। পরে দুরমুশ দিয়ে পিটিয়ে স্থানটি সমান করা হয়। অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে শহীদ মিনার ভাঙার এই তথ্য জানা যায় এম আর আখতার মুকুলের দেশ পত্রিকায় লেখা সেদিনকার প্রত্যক্ষদর্শী ও মেডিকেল ছাত্র কর্নেল (অব.) এ ডি আহাদের স্মৃতিসাক্ষ্যে।
প্রশাসন এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যাপকহারে গ্রেপ্তারাভিযান চালায়। ৪ জন অধ্যাপক এবং ২৮ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত অধ্যাপকরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মৈত্রী বিভাগের ড. পৃথ্বীশ চক্রবর্ত্তী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহ। গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্ররা ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্র। নির্মাণের তৃতীয় দিনের মাথায় প্রথম শহীদ মিনারকে দৈহিকভাবে ধ্বংস করা হয়। ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক জানাচ্ছেন তখন রাজশাহী, নড়াইল, বগুড়া প্রভৃতি শহরে ছাত্ররা ছোটখাটো শহীদ মিনার তৈরি করে। সবগুলোই পুলিশ ভেঙে ফেলে। (দেশ রূপান্তর ২১.০২.২০২০)
শুধু শহীদ মিনার ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি প্রশাসন। মানুষের হৃদয় থেকে স্মৃতির মিনারকে মুছে ফেলারও একটা প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ঐতিহাসিক এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি জানা যায়, শহীদ মিনারের অন্যতম নকশাকার প্রয়াত বদরুল আলমের ছেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আশফাক স্বপনের লেখায়। ঘটনাটি হলো, ২৪ ফেব্রয়ারি ১৯৫২, প্রথম শহীদ মিনারের ছবি তোলেন মেডিকেলের ছাত্র ডা. আব্দুল হাফিজ (যিনি পরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় স্থায়ী হন)। তার ছবি তোলার খবরটি কোনোভাবে জেনে যায় পুলিশ। এরপর নেগেটিভ ও ছবির খোঁজে তৎপরতা চালায় গোয়েন্দা বিভাগ। তখন স্বজনরা আব্দুল হাফিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যার পরিপ্রেক্ষিতে আব্দুল হাফিজ নেগেটিভগুলো নষ্ট করে ফেলেন।
১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু করা হয়। মিনারের স্থাপত্য নকশার দায়িত্ব পান শিল্পী হামিদুর রহমান ও নারী-ভাস্কর নভেরা আহমেদ। পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে কাজ শুরু করা হয়। ’৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ’৫৮ থেকে ’৬২ এ পাঁচ বছর মিনারের জন্য নির্মিত মঞ্চ ও অসম্পূর্ণ স্তম্ভেই শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাঙালিরা। ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে হয়েছিল অভূতপূর্ব গণসমাবেশ। গণআন্দোলনের তোপে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার আসামিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সামরিক জান্তা আইয়ুব খান সরকার। পরে ১৯৭০ সালে নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে এই মিনার বাঙালিকে দেয় দুর্বার সংগ্রামের প্রেরণা ও সাহস।
স্বাধীনতার পর একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে ’৭২-এর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে শহীদ মিনারের ভাঙা বেদি ও এর আশপাশ ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সোমবার, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মিনারবিহীন বিধ্বস্ত শহীদ চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। দৈহিক অস্তিত্ব বারবার ধ্বংস বা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও বাঙালি হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায়নি একুশের আত্মদানের স্মৃতির মিনারকে। শেকড়ের টানে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে গেছে যথাসময়ে, টিকে আছে এবং থাকবে। লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক
১৯৯৫ সাল। তখন কাজ করি ভোরের কাগজে। সম্পাদকীয় বিভাগে। আবদুল কাইয়ুম মুকুলের সহযোগী হিসেবে। বসতাম সম্পাদকীয় বিভাগে। এ ছাড়া মুখোমুখি বসতেন, বর্তমানে দুজন প্রথিতযশা সাংবাদিক সাজ্জাদ শরীফ ও আনিসুল হক। এই তিনজনই বর্তমানে উচ্চপদে আছেন প্রথম আলোতে।
মুকুল ভাইয়ের সহযোগী হিসেবে পত্রিকার অন্য কাজের বাইরে বিভিন্ন লেখকের লেখা নিয়ে আসতে হতো। তাদের মধ্যে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখতেন, প্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ।
অকৃতদার এই মানুষটি ছিলেন, খিটখিটে মেজাজের। তিনি আবার নিজে লিখতেন না। অনুলিখন করতে হতো। সহজে কেউ তার অনুলিখন করতে চাইতেন না। সম্পাদক মতিউর রহমান, এই অনুলিখনের জন্য বাড়তি অর্থ দিতেন ১০০ টাকা। লেখা জমা দেওয়া মাত্র, মুকুল ভাই নিউজপ্রিন্টের একটা স্লিপ প্যাডে টাকার পরিমাণ লিখে দিতেন। টাকা পেয়ে যেতাম। ফয়েজ আহমদের মনটা ছিল ভীষণ রকমের নরম। তিনি ক্যানক্যানে কণ্ঠে, খটরমটর করলেও দুপুরে তার সঙ্গে ভাত না খাইয়ে ছাড়তেন না। এভাবে চলছিল...।
তখন ভোরের কাগজের ‘মেলা’ পাতা বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে, তরুণদের কাছে। প্রতিদিন না হলেও ৩০-৪০ জন ছেলেমেয়ে আসতেন। তাদের লেখা নেওয়া, আড্ডাবাজি, হাসাহাসিতে ফিচার-সম্পাদকীয় বিভাগ গমগম করত। এর মধ্যমণি ছিলেন-সঞ্জীব চৌধুরী। তিনি দেখতেন ‘মেলা’ পাতা। কিন্তু ফিচার বিভাগ খোলামেলা থাকলেও সম্পাদকীয় বিভাগ ছিল, একটি রুমের ভেতর। এমনি এক আড্ডাবাজির সময়, পড়ন্ত বিকেলে অফিসে এলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি মুচকি হেসে বললেন চলো, তোমাদের রুমে যাই। গল্প দিতে হবে। সাজ্জাদ আছে তো?
অথচ তিনি লেখা আনেননি। সাজ্জাদ ভাই লেখা না পেয়ে একটু রুষ্ট হলেন। তবু কষ্ট করে হেসে বললেন হুমায়ূন ভাই, কালকেই কিন্তু গল্প দিতে হবে। তাপস আপনার বাসায় গিয়ে নিয়ে আসবে।
পরদিন গেলাম, ধানম-ির বাসায়। তিনি ছিলেন লুঙ্গি পরা। বললেন বসো। লিখে দিচ্ছি!
মানে কী, ভাই!
আরে মিঞা, গল্প লিখতে ১৫ মিনিট লাগবে। চলো ছাদে যাই। সেখানে সিগারেট টানব আর একটানে লিখে দেব।
তিনি ১০-১২ মিনিটের মধ্যে লিখলেন! বললেন তোমার হাতে সময় আছে?
কতক্ষণ?
তুমি এক কাপ চা খাবে। আর আমি সিগারেট। সিগারেট খেতে খেতে মুখ ফাঁক করে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন শোনো, তোমার বিভিন্ন ফিচার লেখা আমি পড়েছি। গল্প-উপন্যাস লেখো। জনপ্রিয়তা পাবে।
কেউ তো বই প্রকাশ করবে না?
সেটা আমি দেখব। আর তোমার বাসা কোথায়?
মিরপুর শেওড়াপাড়া।
যাতায়াত করো কীভাবে?
পাবলিক বাসে।
গুড। চোখ-কান খোলা রাখবা। দেখবা অনেক মজার চরিত্র আছে সেখানে। ভালো লেখা তৈরি হবে।
হুমায়ূন আহমেদের সেই কথা আজও মনে রেখেছি। অজস্র মজার ঘটনা দেখেছি পাবলিক বাসে।
কিছুদিন আগের ঘটনা। এমন একটি
মহিলা সিটে একজন দম্পতি বসেছেন। কিন্তু সেই সিট নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত। অথচ সেই পুরুষ নির্বিকারভাবে বসে আছেন। গাড়ি চলছে। এমন সময় আরেকজন মহিলা উঠলেন গাড়িতে। তাকালেন, মহিলা সিটের দিকে। দেখলেন একজন পুরুষ বসে আছেন। সেই পুরুষকে উদ্দেশ করে বললেন
এটা তো মহিলা সিট, আপনি বসছেন ক্যান? ওঠেন।
ক্যান উঠব? আমার বউ আছে না? তার লগে বসছি। সমস্যা আছে? আমি বউরে ছাড়া কোথাও যাই না।
এটা তো মহিলা সিট। আপনি কি মহিলা?
আরে, বউ তো আছে? ওইডাই সমান সমান। তার লগেই তো আছি। ভাইবা নেন, আমিও মহিলা। একটু পরই নাইমা যামু তখন বইসেন। আইচ্ছা বসেন!
কীভাবে বসব?
একটু দাঁড়ান।
সবাইকে অবাক করে লোকটি তার বউয়ের উদ্দেশে বললেন, তুমি আমার কোলে বসো! উনি পাশে বসুক!
সেই মহিলা ফিক করে হেসে দিলেন। বললেন ঠিক আছে, আপনারা বসেন। আমি পরে বসব।
এবার সেই পুরুষ যাত্রী আরেক ভয়ানক কান্ড করলেন। এবার তিনি বউকে দুই হাতে তুলে কোলে নিয়ে গাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেই সঙ্গে মহিলার উদ্দেশে বললেন ন্যান, এবার বসেন?
এবার সেই মহিলা কোল থেকেই প্রায় চিৎকার করে বললেন আপনার লজ্জা-শরম নাই? মাইনষে কী বলব? এইডা তো পাবলিক বাস! যাত্রীদের উদ্দেশে সেই মহিলা বললেন আপনরা কিছু মনে কইরেন না। তার মাথায় সমস্যা আছে। আমরা হাসপাতালে যাইতাছি। তারে মাফ কইরা দিয়েন। দোয়া কইরেন, উনি যেন সুস্থ হয়। পাগলের লগে সংসার করনের যে কী জ্বালা, যে করে সেই-ই জানে।
এরপর সেই পুরুষটি মহিলাকে কোল থেকে নামালেন। চারদিক তাকিয়ে বললেন আসলে আমি পাগল না। পাগলের ভাব ধরি। হেইডা আমার বউও বুঝবার পারে না। আর ডাক্তাররাও বুঝে না। হুদাই, ট্যাকা নেয়।
গাড়ির কয়েকজন যাত্রী সেই দৃশ্য দেখে হাসছিলেন। আবার কেউ আফসোস করছিলেন। বলছিলেন জীবনডাই এই রকম। কহন যে কার কী হয়!
লেখক : সাংবাদিক
পৃথিবীর মানুষ, দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে আধুনিকতার দিকে। বিভিন্ন বিজ্ঞান চিন্তায়, নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন। বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিজ্ঞানে বিভিন্ন দেশের দক্ষদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। দিন দিন বাড়ছে প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা। সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই, বাংলাদেশও।
দেশে মোবাইল ফোন একসময় ছিল স্বপ্নের মতো। প্রথম মোবাইল ফোনের ব্যবসা শুরু হয় সিটিসেলের মাধ্যমে। নব্বই দশকের শেষের দিকে, বর্তমান সরকারই গণমানুষের জন্য মোবাইল ব্যবহার সহজলভ্য করে তোলে। অল্পদিনের ব্যবধানে, সিটিসেলের পাশাপাশি গ্রামীণফোন এবং একটেল শুরু করে একচেটিয়া ব্যবসা। সেইসময় মোবাইল সেট এবং কলরেট ঊর্ধ্বগামী থাকলেও মানুষের মধ্যে একধরনের উন্মাদনা শুরু হয়। এরপর আসে বাংলালিংক এবং টেলিটক। বর্তমানে মোবাইলের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ মানুষ, দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করছেন। একইসঙ্গে, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল দিচ্ছেন। টাকা পাঠাচ্ছেন, নগদ বা বিকাশে। আবার কেউ ব্যাংকের লেনদেন করছেন। ডাকছেন উবার। করছেন বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা। আবার কেউ, পছন্দের খাবারও অর্ডার করছেন। মানুষের এই মোবাইল নির্ভরতায়, বিভিন্ন অপারেটর যে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে না- তা নয়। কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ কমানোর ক্ষেত্রে, মোবাইল অপারেটরদের উন্নাসিকতা স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহকদের ক্ষুব্ধ করে।
সোমবার দেশ রূপান্তরের শেষ পাতায় প্রকাশিত- ‘সোয়া ২ ঘণ্টায় ৬ কোটি কলে বাধা’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায় মোবাইল ব্যবহারকারীদের ৪২ শতাংশই গ্রামীণফোনের গ্রাহক। গত বৃহস্পতিবার প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কে বিপর্যয় ঘটেছিল। এতে বিভিন্ন স্থানে বন্ধ ছিল কল করা বা কল আসা। ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ ছিল। কোটি কোটি গ্রাহক ভোগান্তিতে পড়েন। মোবাইল সিমের সঙ্গে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান জড়িত, তারাও বিপাকে পড়েন। মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন গ্রামীণফোনে প্রায় ৯০ কোটি কল আসা-যাওয়া করে। প্রতি ঘণ্টায় কল আসা-যাওয়ার পরিমাণ ৩ কোটি ৭৫ লাখ। সোয়া দুই ঘণ্টায় প্রায় ৮ কোটি ৬ লাখ ২৫ হাজার কল আসা-যাওয়ার কথা। যেহেতু কোথাও সোয়া দুই ঘণ্টার আগেই নেটওয়ার্ক ফিরেছে, তাই বৃহস্পতিবার ওই সময়ে কমপক্ষে ৬ কোটি কল বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। আর মোবাইল সিমনির্ভর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কত টাকার লেনদেন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে জানা না গেলেও ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার মতো হবে।
সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- বৃহস্পতিবার গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন গ্রাহকরা। বিভ্রাটের এই সময়টায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণফোন ব্যবহারকারীরা মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাননি। ইন্টারনেট সেবাও পাওয়া যাচ্ছিল না। জরুরি যোগাযোগ করতে না পেরে ভোগান্তিতে পড়েন গ্রাহকরা। অনেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অনেকের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বা পেশাগত দায়িত্ব পালনও বাধাগ্রস্ত হয়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নকাজের জন্য আমাদের দেশের রাস্তাঘাট প্রায়ই খোঁড়া হয়। গত বৃহস্পতিবারের মতো ভবিষ্যতেও ফাইবার কাটা পড়ার আশঙ্কা আছে। এখন মানুষ মোবাইল ফোন কল ও ইন্টারনেটের ওপর অনেক নির্ভরশীল। উন্নয়নকাজের সময় মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সঠিক সমন্বয় করে নেওয়া দরকার। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোরও একাধিক ব্যাকআপ রাখা উচিত। ব্যাকআপেরও বিকল্প থাকা উচিত। ভবিষ্যতের জন্য আরও সতর্ক হতে হবে। আমাদের দেশে রাস্তা কাটাকাটি, নতুন কিছু না। মাটির নিচে খোঁড়াখুঁড়িতে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ, এই মাটির নিচেই রয়েছে- গ্যাস এবং পানির লাইন। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে- মোবাইলের ফাইবার। ফলে, যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
এই ঘটনা শুরু হওয়া মাত্র গণমাধ্যমে তারা উপযুক্ত কারণ দর্শাতে পারতেন। এতে দেশের মানুষ আশ^স্ত হতো এবং তাদের মধ্যে কোনো ধরনের আতঙ্ক তৈরি হতো না। গ্রামীণফোন কর্র্তৃপক্ষ যে ধরনের খামখেয়ালিপনা দেখালেন- তার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রখ্যাত নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, মঞ্চাভিনেতা। ১৮৪৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার বাগবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় বাবা ও মায়ের মৃত্যু হলে তিনি পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে ওঠেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। তবে পরে বন্ধু ব্রজবিহারী সোমের প্রভাবে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করেন। একটি কোম্পানিতে বুককিপার পদে চাকরির পাশাপাশি নানা বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রভাবে গান, কবিতা ও পরে নাট্যমঞ্চের জন্য নাটক লিখতে শুরু করেন। ১৮৬৭ সালে শর্মিষ্ঠা নাটকের গীতিকার হিসেবে নাট্যজগতে প্রবেশ। পরে দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদ চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৮৮০ সালে তিনি পার্কার কোম্পানির চাকরি ছেড়ে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার হন। তার রচিত প্রথম মৌলিক নাটক ‘আগমনী’ (১৮৭৭)। পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিষয়ে রচিত তার নাটকের সংখ্যা মোট ৮০। তিনি শেকসপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’-এর বাংলা অনুবাদ করেন। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মৃণালিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘দুর্গেশনন্দিনী’, মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য ও নবীনচন্দ্রের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের নাট্যরূপ দেন। অনেক নাটকে তিনি নিজে অভিনয় করেছেন এবং অনেক অভিনেতা তৈরি করেছেন। গিরিশচন্দ্র মধুসূদনের চৌদ্দ মাত্রার অমিত্রাক্ষর ছন্দকে ভেঙে অভিনয়ের উপযোগী ছোট ছোট ছত্রে বিন্যস্ত করেন। তার নামানুসারে এ ছন্দের নাম হয় ‘গৈরিশ ছন্দ’। ১৯০৮ সালে তিনি মিনার্ভার নাট্যাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু তাদের সঙ্গেই ছিলেন। ১৯১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।