
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, গত আগস্ট মাসে বিশ্বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বনিম্নে। এটি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সংস্থাটি বলছে, এ সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। তবে পুরো উল্টোচিত্র বাংলাদেশে। বিশ্বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভোক্তা মূল্য ও মজুরি সূচক (সিপিআই) ইনডেক্সের আগস্ট মাসের তথ্য অনুযায়ী, গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের কোনো নীতিই কাজে আসছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়াটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সুদহার বাড়িয়ে যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছে সেখানে বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে এখনো কৌশলে সুদহার কমিয়ে রাখা হয়েছে। তাছাড়া বাজার অব্যবস্থাপনার কারণেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
যদিও সরকার দাবি করছে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে তারা সদা সচেষ্ট। কিন্তু বাজারের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ সত্ত্বেও, আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশের উচ্চতা ছুঁয়েছে। এতে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে গেছে।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা আছে। উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এ বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা প্রকট। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার ব্যবস্থাপনায় যে নজরদারি ও খবরদারি দরকার সেগুলো ঠিকমতো করতে পারছে না বলেই মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, নজরদারির ক্ষেত্রে আমদানি কত, উৎপাদন কত, গ্যাপ কত এসব তথ্য-উপাত্ত নির্ভর নীতিমালা দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দুর্বলতার কারণে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ। রিজার্ভের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাটা সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করছে।
সরকারের হিসাবে শহরের চেয়ে গ্রামে খাবারের দাম বেশি বেড়েছে। আগস্টে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ। শহরে ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। আগের মাস অর্থাৎ জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে মূল্যস্ফীতি। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এটি আরও বেশি বেড়েছে। এটাকে চিন্তা করতে হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ওপরে আবার মূল্যস্ফীতি হিসেবে। চাল ১০০ টাকারটা ১১০ টাকা হয়েছে, তারপরেও আবার ১১২ টাকা হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষকে খুবই যাতনা দিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ নামকাওয়াস্তে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মুদ্রানীতিতে ১০ শতাংশের কিছু বেশি ধরা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এটিও যথেষ্ট নয়।
বিবিএসের হিসাবে, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে জানুয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এরপর থেকেই সূচকটি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করে এবং চলতি বছরের মে মাসে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উন্নীত হয় সার্বিক মূল্যস্ফীতি। এ সময়ে অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলেও গত আগস্টে বাংলাদেশে সামান্যই কমে। তবে আগস্টে খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে, আগের মাস জুলাইয়ে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে বিবিএস খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের যে চিত্র দিয়েছে, তার সঙ্গে বাজারের কোনো মিল নেই। বেশিরভাগ খাদ্য-বহির্ভূত পণ্যেরই দাম লাগামের বাইরে চলে গেছে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, একেক প্রতিষ্ঠান একেক রকম তথ্য দেয়। যার ফলে নীতিনির্ধারকরা কখন আমদানি করতে হবে, কতটুকু করতে হবে এটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। এটাও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার বড় একটি কারণ। তিনি বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। টাকার মান যত কমছে সেটিও আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়াতে অবদান রাখছে।
তবে মূল্যস্ফীতির সার্বিক অবস্থার চেয়ে মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশের নিম্ন-অবস্থানে ছিল আগস্টে। অবশ্য এই হার আগের মাসের তুলনায় দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেড়েছে।
গত আগস্টে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থার বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যসারণী দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন অবস্থানে আসে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মূল্যসারণীতে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় এমন খাদ্যপণ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আগস্টে মূল্যসারণীর গড় ছিল ১২১.৪ পয়েন্ট, যা আগের মাসে ছিল ১২৪ পয়েন্ট। ২০২১ সালের মার্চের পর গত আগস্টেই সর্বনিম্ন ছিল জাতিসংঘের খাদ্য মূল্যসারণীর গড়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের মার্চে এটি সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়, আগস্টে এর চেয়ে ২৪ শতাংশ কমেছে।
কিন্তু, বাংলাদেশে বৈশ্বিক এই অবস্থার প্রতিফলন হয়নি। বরং, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দরিদ্র্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারের খাদ্য সহায়তার মাত্রা কমায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি চড়া হয়েছে, বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে কী অর্জন হলো এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা যত না, তার চেয়ে বেশি বাইডেনের সেলফি নিয়ে। এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে অন্য যুক্তি তুলে ধরে আওয়ামী লীগের শীর্ষসারির নেতারা দাবি করেন, নির্বাচনের আগে ভারত সফর বিশ্ব রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চাপমুক্ত করতে পেরেছে। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধু ভারতই করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সমাধান করতে হবে। এগুলো বিদেশিদের সামনে এনে সমাধান হবে না।
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলার ঘটনা প্রচার করে আওয়ামী লীগ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আদতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের নড়চড় হয়নি।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতিতে জটিলতা চলছে। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রী ও সরকারি দল, বিরোধ দল ও মাঠের বড় দল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে এক দফা দাবিতে অনড়। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে রাজি নয়। এ অবস্থায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চাপে রয়েছে, এমন খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কয়েকজন মন্ত্রী নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের মোদি সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূতিয়ালি করছে বলে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
এ প্রেক্ষাপটে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার ও আওয়াম লীগ। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা ও সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালি হাতে ফেরেননি। ভারত সফরে গিয়ে ভারত জয় করে এসেছেন তিনি।
তারা দাবি করছেন, ভারতকে যেমন ‘মুঠোবন্দি’ করেছেন তেমনি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব দূর করার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল তাতে হোঁচট খেতে হলো দলটিকে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী তা পূরণ হয়েছে। এর প্রকাশ ঘটতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সাধারণ মানুষকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেষ কথা হলো বাংলাদেশের জন্য পরম মর্যাদা নিয়ে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।’
কূটনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এমন এক নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব নেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই দেশটির সবচেয়ে কাছের মিত্র। তিনি এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে।’ এর সঙ্গে দুটি ঘটনা তুলে ধরে এ নেতা আরও বলেন, ‘প্রথমত দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশ জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। ভারত বাংলাদেশকে যে গুরুত্ব দেয়, এটি তার প্রমাণ। আরেকটি বিষয় হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খাওয়ানো। সেখানে অন্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান থাকলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু তার দৃষ্টান্ত দেখালেন মোদি। তিনি বোঝালেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক নিয়ে নানা গুজব থাকলেও সেটি মিথ্যা। প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবে ভারত সরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান জো বাইডেন সেলফি তোলায় রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র জয় করার যে উত্তাপ দেখাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলী ও সম্পাদকম-লীর দুজন সদস্য। তারা বলেন, সেলফি বড় কোনো বিষয় নয়। এ সেলফি নিয়ে যারাই যে ব্যাখ্যা দিয়ে বেড়াক, সেটা গুরুত্বহীন। কারণ এ ধরনের অনুষ্ঠানে সেলফি তোলাতুলি হয়ই। তবে এ অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের যে কথোপকথন হওয়ার সুযোগ মিলেছে, সেলফির চেয়েও সেটা বড় ঘটনা। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ দুই নেতা আরও বলেন, জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মকান্ডে এ দাবি করা যায় যে, ভারত জয় করেই ফিরেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক নেতা দাবি করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখনকার চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষমতাশালী ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশটির বিরোধিতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। শক্তির বিবেচনায় তখনকার তুলনায় এখন যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এ নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। এর অন্যতম হলো খাদ্যদ্রব্যের দাম জনগণের নাগালে রাখা। জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা। মোটামুটি অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, সেখানে ৫০ ভাগ ভোটার ভোট দেয় তাতেই সব ঠিক করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে যেকোনো কৌশলে সব দলকে নির্বাচনে আনতে পারলে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিই ‘ওভারকাম’ (জয়) করা সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে এ নেতা বলেন, ‘এসব অনুষ্ঠান ফরমাল। এখানেই সব ডিলিং হয়ে যাবে ব্যাপারটা এরকম ভেবে নিলে হবে না। তবে এ সফরের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হলে সবচেয়ে বড় সফলতা এসেছে, সেটি মানতেই হবে।’
তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তিনি মূলত বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। এ বিষয়টি বাংলাদেশের উত্তাল রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ফেবার (সুবিধা) দেবে।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য ঠিক এমন বোঝাপড়ার কথা তুলে ধরে দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে প্রতিবেশী দেশটি নিয়ে যেসব গুঞ্জন মাঠে ছিল, সেটা আর ধোপে টিকবে না।
ভারত সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মি আহমেদ কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কেও টানাপড়েন কখনো ঘটেনি, সামনেও ঘটবে না সে বিষয়টা বিশ্ববাসীকে বুঝতে সুবিধা করে দিয়েছে এই জি-২০ সম্মেলন।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে মাঠে আন্দোলনরত বিএনপি বুঝলে তাদের জন্য ভালো হবে। না বুঝতে পারলে যা হওয়ার কথা তাই হবে মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এ নেতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত পরমবন্ধু তা সর্বজনবিদিত। গত ১২-১৩ বছরে সম্পর্কের উষ্ণতা উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে সেটাও সবাই দেখেছে। তবে সর্বশেষ সফরে কী নিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গেলে আমি বলব, আরও সময় নিয়ে বলা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এ সফরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে যা এসেছে, দেখেছি ও পড়েছি; তাতে এটুকু বলতে পারি। এখানে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার দেখা যায়নি। সম্পর্ক স্বাভাবিকই রয়েছে। এজ ইট ইজ।’
সম্পর্ক ঠিকই আছে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত একে অন্যের অকৃত্রিম বন্ধু। সে সম্পর্কে কোনো হোঁচট খেয়েছে এটা বলা যায় না।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এসব বিষয়গুলো জি-২০ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আর এ বিষয়গুলো নিয়ে যেহেতু সরকার কাজ করেছে এ ধরনের বিশ্বসভায় সেসব বিষয়ে আলোচনা হওয়া খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটা বিশ্বসভায় বিশ্বের বহু নেতার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় বৈঠক হবে এটাই স্বাভাবিক। সে অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে আমার মনে হয় না। হলেও খুব সামান্য সময়ের জন্য হয়েছে। সেটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।’
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ যেসব সমস্যা রয়েছে, সেসব দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সমাধান করতে হবে আমাদের। এটাই প্রধান সোপান। অহেতুক যুক্তরাষ্ট্র বলেন, ভারত বলেন বা অন্যান্য দেশকে সামনে এনে এর সমাধান হবে না, বরং জটিল হয়ে পড়ে।’
আওয়ামী লীগকে ‘সেলফি রাজনীতির’ খোঁচা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাইডেনের সঙ্গে একটা সেলফি তুলে এখন ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন, আহা, আমরা জিতে গেছি। জেতাবে তো বাংলাদেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে। সেই ভোটটা ঠিকমতো হওয়ার ব্যবস্থা করেন। তা না হলে কোনো বাইডেনেই আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না, সেলফিও রক্ষা করতে পারবে না।’
ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন শেষে দুদিনের সফরে ঢাকা এসেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। প্রায় ৩৩ বছর পর কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এলেন। গতকাল রবিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে মাখোঁকে বহনকারী বিমানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরাসি প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে মাখোঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
সফরসূচি অনুযায়ী, গতকাল রাতে রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ নেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। এ সময় তিনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। এরপর রাতের ঢাকা দেখার অংশ হিসেবে মাখোঁর ধানমণ্ডি লেক পরিদর্শন এবং ধানমণ্ডিতে গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দের স্টুডিওতে যাওয়ার কথা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট সফরের দ্বিতীয় দিন আজ সোমবার সকালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি স্যাটেলাইট এবং উড়োজাহাজের বিষয়ে এয়ারবাসের সঙ্গে দুটি এবং স্থানীয় সরকার প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য একটি সম্মতিপত্র সই হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতা, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ফ্রান্সের আগ্রহ এবং আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে ফরাসি প্রেসিডেন্টের এ সফর গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত চাপের বিষয়ে প্যারিস কী বার্তা দেয়, সেটাই দেখার বিষয়। কারণ কয়েক দিন আগে ঢাকা সফর করে গেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। ঢাকার সঙ্গে মস্কোর রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারের বার্তা দিয়ে গেছেন তিনি। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা ছাড়ার দুদিন পর মাখোঁর ঢাকা সফর নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালি উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ফ্রান্স। ভূরাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াও নানা কারণে মাখোঁর এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সফরে ঢাকা-প্যারিস রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদারের সুযোগ রয়েছে।’
জানা গেছে, আজকে শেখ হাসিনা-মাখোঁর বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণা আসবে। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার সফরে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স একটি প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক সই করে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনায় গুরুত্ব থাকবে এবার। কয়েকটি দ্বিপক্ষীয়ও চুক্তি হতে পারে। এয়ারবাস থেকে স্যাটেলাইট কেনার বিষয়ে একটি চুক্তি হতে পারে। একই কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কেনার যে কথা উঠেছে, সে ব্যাপারে কিছু অগ্রগতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফ্রান্সের সাহায্য সংস্থা এএফডি থেকে ২০ কোটি ডলার সহায়তা নিয়েও একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে মহাকাশ প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ক্রয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার, নির্বাচন ও ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুর মতো বিষয়গুলোতে আলোচনা হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মাখোঁর সফরে নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। দুই শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। গুরুত্ব পাবে রাজনৈতিক বিষয়ও। এ ছাড়া বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ রোহিঙ্গা ইস্যু দুই সরকারপ্রধানের আলোচনায় থাকবে।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আজ দুপুরের পর ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে মাখোঁর। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
বাংলাদেশ সফরে মাখোঁর সঙ্গে রয়েছেন ফ্রান্সের ইউরোপ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ক্যাথেরিন কলোন্না। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকারের আশা, মাখোঁর এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হবে ও নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। ১৯৯০ সালের ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা বাংলাদেশ সফরের পর মাখোঁই প্রথম নেতা যিনি বাংলাদেশ সফর করছেন। মিতেরার ওই সফরের পর থেকে উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়েছে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন থেকে ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে ও ফ্রান্স রপ্তানির ক্ষেত্রে পঞ্চম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের প্রকৌশল, জ¦ালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বিভিন্ন খাতের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাদেশের উন্নয়নে মুগ্ধ ফ্রান্স : মাখোঁ
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের এই উন্নয়নে মুগ্ধ ফ্রান্স। গতকাল রাতে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তার সম্মানে দেওয়া ভোজসভায় যোগ দিয়ে এ কথা বলেন তিনি। মাখোঁ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাত ১০টার দিকে নৈশভোজ শুরু হয়। তার আগে চলে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
ফ্রান্স আমাদের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটি কৌশলগত অংশীদারত্বে পৌঁছাবে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ইন্দো-প্যাসিফিক এবং এর বাইরেও সবার অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য কৌশলগত সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যেতে পারে বলে আমি আত্মবিশ্বাসী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা কৌশলগত সম্পদ ও উন্নত প্রযুক্তিতে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র খুলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশে^ যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের একাধিক সংকট মোকাবিলায় আমাদের অংশীদারত্ব একটি অর্থবহ শক্তি হতে পারে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে ফ্রান্স বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী। আমরা দায়িত্বশীল ব্যবসা পরিচালনার দিকে আলোকপাত করে একটি শক্তিশালী বাণিজ্য অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছি।
শেখ হাসিনা জানান, এই ভোজসভায় ফরাসি প্রেসিডেন্টকে আতিথ্য দিতে পেরে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ও সম্মানিত বোধ করছেন। তিনি বলেন, আমি ২০২১ সালের নভেম্বরে এলিসি প্যালেসে আপনার উষ্ণ আতিথেয়তার কথা স্মরণ করছি। আমি আনন্দিত যে, আপনি আমার ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
‘ফ্রান্স আমাদের হৃদয় এবং কল্পনায় একটি বিশেষ স্থানে রয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকারপ্রধান জানান, তারা ফরাসি প্রেসিডেন্টের জন্য বাংলাদেশের অদ্বিতীয় জনপ্রিয় খাবার কাচ্চি বিরিয়ানির স্বাদ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের উভয় জাতিই আমাদের রন্ধনপ্রণালি, সংস্কৃতি এবং ভাষাগত ঐতিহ্যের জন্য অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের দুই জনগোষ্ঠীকে একে অন্যের কাছাকাছি আনতে আমাদের দুটি সংস্কৃতির মধ্যে আরও পদ্ধতিগত পন্থা এবং সংমিশ্রণকে উন্নীত করার সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, আমি কি আমাদের আরেকটি সুস্বাদু খাবার স্থানীয় জনপ্রিয় ফল আমড়ার জুস দিয়ে টোস্ট করার কথা বলতে পারি!
শেখ হাসিনা বলেন, আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরাসি বিপ্লবের চেতনায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধের প্রসারে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে)’-এর প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার আহ্বান আন্দ্রে মারলোর মতো বিশ্ব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল যারা আমাদের উদ্দেশ্যে সাধনে লড়াই করার জন্য অনেক তরুণকে সংগঠিত করেছিলেন।
তিনি বলেন, এটা প্রায়ই আমার মনে হয় যে, প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তার ফরোয়ার্ড মার্চ আন্দোলনের মাধ্যমে মারলো ও তার অনুসারীদের গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করছেন। তিনি আরও বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট, ফ্রান্সে আপনি যে সাহসী সংস্কার করেছেন তার জন্য আমরা আপনাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আপনাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশুদ্ধ বাতাসের নিঃশ্বাস হিসেবে দেখি। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপনার (ফরাসি প্রেসিডেন্ট) গুরুত্ব আরোপ মূলত আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভোজ সভাস্থলে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফুলের তোড়া দিয়ে মাখোঁকে স্বাগত জানান। এ সময় জাতির পিতার ছোট মেয়ে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।
পেঁয়াজুসহ ধূমায়িত ইলিশ এবং সমুচা, স্যুপ, রুটি এবং মাখন দিয়ে মাখোঁকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয়। খাদ্য তালিকায় প্রধান উপাদান ছিল খাসির মাংসের কাচ্চি বিরিয়ানি, গরুর কাবাব, চিকেন কোর্মা, ঐতিহ্যবাহী লুচি ও রোস্টেড লবস্টার। ডেজার্ট আইটেমের মধ্যে ছিল পাটিসাপটা পিঠা, মিষ্টি দই, রসগোল্লা, তাজা ফল, পানীয় এবং আনারের জুস, তাজা জুস, কোমল পানীয়, চা ও কফি।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে রাজধানীর শাহবাগ থানায় নিয়ে বেধড়ক পিটুনির ঘটনায় আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে ঢাকা মহানগর পুলিশ থেকে (ডিএমপি) সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার রাতে শাহবাগ থানায় নিয়ে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে মারধরের পর ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনারের দায়িত্বে থাকা হারুন অর রশিদকে গতকাল রবিবার দুপুরে প্রথমে ডিএমপির পিওএম (পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে) উত্তর বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এক প্রজ্ঞাপনে
তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করার কথা জানানো হয়। এর আগে শনিবার রাতে পুলিশের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুনের আড্ডা দেওয়া নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়। পরে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। মারধরের শিকার ছাত্রলীগ নেতারা হলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ। তাদের দুজনকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দুদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের কঠোর শাস্তি দাবি করেছে ছাত্রলীগ। আর খোঁটার সুরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার বিচার চেয়েছে ছাত্রদলও।
জানা গেছে, শাহবাগ থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে পুলিশের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য মিলে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। এ খবর পেয়ে রাতেই শাহবাগ থানার সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভিড় করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও পুলিশের কর্মকর্তারা থানায় গিয়ে মধ্যরাতে ঘটনার প্রাথমিক মীমাংসা করেন।
রাজধানীর মগবাজারে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আহত ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন নাঈম। তিনি গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানান, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক তার এলাকার বড় ভাই। তাদের দুজনেরই বাড়ি গাজীপুরে। আজিজুল শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে তাকে ঢাকার শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে যেতে বলেন। রাত ৮টার দিকে তিনি সেখানে যান। পরে আজিজুল বারডেম জেনারেল হাসপাতালে আছেন জেনে সেখানে ছুটে যান। হাসপাতালের চারতলায় গিয়ে তিনি দেখেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা চলছে। এ সময় আনোয়ারসহ ছাত্রলীগের আরও দুই নেতা মিলে তাদের নিবৃত্তের চেষ্টা করেন।
তিনি আরও জানান, এডিসি হারুন একপর্যায়ে শাহবাগ থানার ওসিকে (তদন্ত) ফোন করে হাসপাতালে ডেকে নেন। পুলিশ গিয়ে আজিজুল, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে মারধর করে। পরে হাসপাতাল থেকে পুলিশ জোর করে আজিজুলসহ তিন-চারজনকে গাড়িতে থানায় নিয়ে যায়।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ফোনে রমনা বিভাগের উপকমিশনারকে (মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন) মারধরের ঘটনাটি জানিয়ে শাহবাগ থানায় যাই। গিয়ে দেখি ওসি তদন্তের কক্ষে সবাইকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। এডিসি হারুন ও ওসিও মারধর করছেন। ওসির কক্ষের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকতেই ১০ থেকে ১৫ জন আমার ওপর হামলা করেন। আমার মুখে কিল-ঘুসি মারেন। একপর্যায়ে আমাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে লাথি মারেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নির্যাতনের এ ঘটনার বিষয়ে গতকাল আফতাবনগরে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস উদ্বোধনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘এটা যে করেছে, সে পুলিশের হোক বা যেই হোক না কেন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। কেন করেছে, কী করেছে, আমরা জিজ্ঞাসা করব। তার ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের প্রতিবাদ : পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের বিচার দাবিতে ফুঁসে উঠেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাকে শুধু প্রত্যাহার নয়, কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন ছাত্রলীগের বর্তমান-সাবেক নেতাকর্মীরা। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সমালোচনা করেছেন অনেকেই।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এ সময় তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তাসহ নির্যাতনে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান। তা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
এদিকে অনেকটা খোঁটার সুরে ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর হামলার বিচার চেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদল বলেছে, ‘ছাত্রলীগের মদদে ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের কলঙ্কজনক সংস্কৃতির শিকার এখন খোদ ছাত্রলীগ। গত ১৫ বছর ধরে পুলিশের সহযোগিতায় ছাত্রলীগ সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করেছে। ছাত্রদলসহ সব বিরোধী ছাত্রসংগঠন এবং সাধারণ ছাত্রদের নির্মম নির্যাতন করেছে। বিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক পুলিশি নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে বুনো উল্লাস করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আজ তাদের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও ছাত্রলীগের কেউ কোনো প্রতিবাদ জানাতে সক্ষম হয়নি। একজন নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার ভয়ে সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্রলীগ তটস্থ। ওই পুলিশ কর্মকর্তা যাবজ্জীবন কারাদ-যোগ্য অপরাধ করার পরও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ন্যূনতম সাহস ছাত্রলীগের নেতারা দেখাতে পারেননি। ছাত্রলীগের মতো একটি পুরনো ছাত্রসংগঠনের এহেন অমর্যাদাকর অবস্থানের কারণে নিন্দা ও হতাশা প্রকাশ করি।’
এর আগেও পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। গত বছর ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সংঘর্ষ থামাতে যাওয়া এক পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারেন হারুন। যার ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে শাহবাগে সমাবেশকারীদের পেটানোর ঘটনা, এমনকি তিনি নিজেই লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন এমন ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। তবে হারুনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রায়েরবাজার স্লুইসগেট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত মোট ১২ কিলোমিটারের ইনার সার্কুলার রোড করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। খরচ প্রায় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন খাতের ব্যয় চোখ কপালে ওঠার মতো। এ প্রকল্পে একজন পরামর্শকের বেতন ধরা হয়েছে মাসে ৮৭ লাখ টাকার বেশি। একটি সাধারণ প্রকল্পের জন্য বিপুল বেতনের পরামর্শক নিয়োগের এমন প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শুধু পরামর্শক নিয়োগ নয়, প্রকল্পটির বিভিন্ন অংশের অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাবও অযৌক্তিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রিটেইনিং ওয়াল ও অন্য ওয়াল নির্মাণে ব্যয় হবে ৪০৬ কোটি টাকা। আর শুধু বিদ্যুতের খুঁটি সরাতে ব্যয় হবে ১২০ কোটি টাকা। অস্বাভাবিক ব্যয় থাকায় ব্যয় পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে।
সম্প্রতি প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা (পিইসি) হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের অর্থায়ন ৮৯৮ কোটি টাকা, বাকি ৯৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থায়ন করবে ডিএসসিসি নিজেরাই। কোনো প্রকল্প প্রস্তাব করার নিয়ম হলো, সেটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু প্রকল্পটি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই।
প্রকল্পটি পিইসি সভায় উপস্থাপন করেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী (সিইও) মো. মিজানুর রহমান। পিইসি সভায় তিনি বলেন, এ সড়কটি উন্নয়ন করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-মাওয়া সড়কের আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গাড়ি এ সড়ক ব্যবহার করবে। এখন নিয়মিত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৬টি জেলার যানবাহনগুলো ঢাকায় আসছে।
প্রকল্পটিতে পরামর্শক খাতে ৩০ জন মাসের জন্য ২৬ কোটি ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ প্রতি মাসে একজন পরামর্শকের বেতন হবে ৮৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া পরামর্শকের কার্যপরিধি কী তাও ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ প্রকল্পে রাজস্ব খাতে পরামর্শক রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দক্ষিণ সিটির সিইওকে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সঙ্গে কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। কথাও বলতে পারব না।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ইনার সার্কুলার রিং রোডের রায়েরবাজার সøুইসগেট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত অংশের অর্থাৎ প্রায় ১২ কিলোমিটার উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সড়কের উন্নয়ন কাজটি প্রথম ধাপে রায়েরবাজার স্লুইসগেট থেকে লোহার ব্রিজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন করা হবে এবং দ্বিতীয় ধাপে লোহার ব্রিজ থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন হবে।
এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। কিন্তু ডিপিপিতে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের যে তথ্য যুক্ত করা হয়েছে, তা মূল প্রতিবেদন নয়। ফিজিবিলিটি স্টাডি পরিপত্রে উল্লিখিত ফরম্যাট অনুযায়ী করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয় বলে মনে করছে কমিশন।
ডিপিপিতে কিছু অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে রয়েছেÑ ডিপিপিতে ৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ৩৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে অর্থাৎ ১ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে খরচ পড়বে ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পে তিনটি ভেহিক্যাল ওভারপাস, তিনটি ফুটওভার ব্রিজ, আটটি সøুইসগেটসহ পাইপ কালভার্ট, বাস বে, যাত্রী ছাউনি, ফুটপাত কাম ড্রেন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের জন্য ৪০৬ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে কয় লেনের কী ধরনের রাস্তা নির্মাণ করা হবে, এর ধারণাগত নকশা ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গের সংখ্যা ও পরিমাণ এবং দর প্রাক্কলনের ভিত্তি স্পষ্টভাবে ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়নি।
ডিপিপিতে রাজস্ব খাতে বৈদ্যুতিক খুঁটি এবং টাওয়ার স্থানান্তর খাতে ১২০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শুধু খুঁটি সরাতে এত ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্প প্রস্তাবে অবকাঠামো ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কী ধরনের কতগুলো অবকাঠামোর জন্য এ প্রাক্কলন করা হয়েছে এবং এ প্রাক্কলনের ভিত্তি কী, তাও স্পষ্ট নয়।
এ ছাড়া ডিসম্যানট্যলিং অব স্ট্রাকচার খাতে ৮০ লাখ টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হলেও কী ধরনের কতটি স্ট্রাকচার ডিসম্যানট্যালিং বা সরাতে হবে সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য দেয়নি ডিএসসিসি। এ দুই খাতে কতটি বা কী পরিমাণ বৈদ্যুতিক খুঁটি, টাওয়ার স্থানান্তর করা হবে ও কী ধরনের কতটি স্ট্রাকচার সরাতে হবে এবং এতে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে পিইসি সভায়।
প্রকল্পের এত বেশি ব্যয় প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ব্যয় বেশি হওয়ায় আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। সড়কের সঙ্গে সমন্বয় করে এ কমিটি করা হয়েছে। তারা দেখে যেটি বাস্তবসম্মত হয় সেটি নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কমিটির সিদ্ধান্তের পর দরকার হলে আমরা আবার এ প্রকল্পের জন্য আরেকটি পিইসি করব।’ তিনি বলেন, ‘তারা তাদের প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আমাদের কাছে বেশি মনে হয়েছে তাই আমরা সেটিকে গ্রহণ করিনি। সড়ক ও জনপথের সঙ্গে সমন্বয় করা জরুরি। তাছাড়া এত ব্যয়ের প্রকল্পটির ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের কোনো অনুমোদন নেয়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।’
‘দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, চাম্পু ও চুম্পু’ এমন সব হরেক নামে পরিচিত চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ভূঁইয়া। তিনি সেখানে আছেন এক যুগের বেশি। শুধু তাই নয়, একই দায়িত্ব পালন করেন মতলব পৌরসভায়ও। যেখানে সার্ভিস রুলে তিন বছর পূর্ণ হলে বদলি হওয়ার কথা। কিন্তু আবুল কালাম চাঁদপুরে কীভাবে খুঁটি গেড়ে আছেন সে নিয়েও আলোচনা আছে। তার দুর্নীতি-অনিয়মে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ তার নাম দিয়েছে ‘আকাম ভূঁইয়া’।
পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে দাবি করেছেন, সর্বোচ্চ ব্যক্তি মেয়র হলেও পৌরসভায় আকাম ভূঁইয়ার কথাই শেষ কথা। মেয়র বললেও অনেক কাজ হয় না। কিন্তু আকাম ভূঁইয়া বললে হয়ে যায় এবং দ্রুতগতিতে হয়।
দেশ রূপান্তরের হাতে আসা নথি অনুযায়ী, তার দুর্নীতির পরিমাণ শতকোটি টাকার কম নয়। জানতে চাইলে চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবুল কালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে আমি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আশা করছি এক দেড় মাসের মধ্যে রিপোর্ট চলে আসবে। তারপরই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি বলেন, সবই হয়েছে তিনি মেয়র পদে আসার আগে।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৌরসভার বিজ্ঞাপন থেকে বড় অঙ্কের টাকা লুটপাট হয়েছে। এ টাকা পৌরসভার ফান্ডে না এসে কারও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অথবা বিকাশে গেছে, এর সত্যতা আছে। মাস্টার রোলের নামে নয়-ছয় করে লোক নিয়োগের অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার সময়ে একজনও অ্যাডহক বা মাস্টার রোলে লোক নিয়োগ দিইনি। পৌরসভার অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছি।’ তার পরিচালনাধীন চাঁদপুর পৌরসভায় মাস্টার রোলে এখন ৭৩ জন কর্মচারী চাকরি করছে বলে স্বীকার করেন।
পৌরসভা থেকে পাওয়া গাড়ি নিজের পরিবারের জন্য ব্যবহার না করা এ মেয়র বলেন, ‘অনেক কিছুর বদলানোর উদ্যোগ আমি নিইনি কেন জানেন, সিস্টেমে চুরির সুযোগ থাকলে চোর চুরি করবেই। সিস্টেমে চুরির সুযোগ না থাকলে চোর কোনোভাবেই চুরি করতে পারবে না। আমি এতে ভীষণ বিশ্বাস করি।’
বদলি প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবর্তন করিনি। এটা করতে গেলে ঝক্কি-ঝামেলাও হয়। আমি চেয়েছি, এগুলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাজ, তারাই করুক।’
মাস্টার রোলে নিয়োগ অবৈধ হলেও নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল কালাম ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মফিজ হালদার ৭৩ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। বিজ্ঞাপন থেকে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ও বিকাশে ১৫ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। জ্বালানি তেলের খরচ দেখিয়ে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনা সবার জানা।
এ বিষয়ে মেয়র জুয়েল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তেল ব্যবহারে প্রত্যেক পৌরসভায় বাজেট থাকে। মাসে ২১০ লিটার। যে হিসাবকে সিলিং বলে। এ পৌরসভায় জ্বালানি তেল ব্যবহারের কোনো সিলিং ছিল না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তা চালু হয়েছে।’
আবুল কালাম ওরফে আকাম সিন্ডিকেটের লোপাটের অন্য ক্ষেত্রগুলো হলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতন দেখিয়ে মাসিক ১৪ লাখ করে ১০ বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। পাশাপাশি ‘সুইপার বিল’ নাম দিয়ে মাসে দুই বা ততোধিকবার প্রায় ৫ লাখ টাকা করে ১০ বছর ধরে তুলেছে চক্রটি। অর্থাৎ এ খাতে ১৫-২০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাল নথি বানিয়ে ২০ বছরে নামে-বেনামে মফিজ হালদার প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এ ছাড়া টেন্ডার/কোটেশন ছাড়াই মফিজ হালদার শতকোটি টাকার কেনাকাটা দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
‘আকাম’ সিন্ডিকেট একটানা গত ১০ বছরে উৎকোচ গ্রহণ করে পৌরসভার সম্প্রসারিত বা বর্ধিত বহুতল ভবনগুলো করের আওতাভুক্ত করেনি। এভাবে তারা প্রতি বছর ৫-৬ কোটির ক্ষতি করেছে পৌরসভার। সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য নাসির উদ্দিন খান পৌর তহবিলের কোটি টাকা ও লিজ দেওয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ অভিযোগে বাজার পরিদর্শককে শুধু বরখাস্ত করেই কর্তব্য শেষ করেছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
দুর্নীতির অভিযোগে পৌরসভার কর্মকর্তা (অ্যাসেসর) সুলতান আহমেদকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে একটি স্কুলে পদায়ন করেছে পৌরসভা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আকাম ভূঁইয়ার খপ্পরে পড়েই আজ আমি সাজাপ্রাপ্ত। আমাকে পৌরসভার বিজ্ঞাপন বিল নিয়ে লুটপাট করার কর্মকৌশল শিখিয়ে দিয়েছে এই চক্র। বিজ্ঞাপন করের নথি এনে দিয়েছে আমাকে। দুজনের নির্দেশমতো এ দুর্নীতি-লুটপাট করতে বাধ্য হয়েছি। আকাম ভূঁইয়ার কথা না শুনে আকাম না করলে চাকরিও করতে পারতাম না।’
আত্মীয়স্বজন কাউকে মুখ দেখাতে পারেন না উল্লেখ করে সুলতান বলেন, ‘পৌরসভার লোকজন, বন্ধুবান্ধব দেখলে পালিয়ে বেড়াই। এমনও হয় কখনো মাদ্রাসার মেসে, কখনো মসজিদে রাত কাটাই। আমাকে বিজ্ঞাপনের টাকা লুটপাট করতে বাধ্য করেছে, বাজার করের টাকা নয়-ছয় করার নির্দেশ দিয়েছে। এখন আমি শাস্তির আওতায় অথচ যারা আমাকে দিয়ে বাধ্য করিয়েছে তারা বহাল তবিয়তে পৌরসভার টাকা আত্মসাৎ করেই চলেছে।’
মেয়র এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৌরসভায় অনিয়ম করার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ হওয়ায় সুলতানকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়েছে।’
পৌরসভার সাধারণ নাগরিকরাও জানেন বর্তমান ও সাবেক দুই মেয়রই ‘আকাম ভূঁইয়া’র হাতের পুতুল। নাম প্রকাশ না করে এক বাসিন্দা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাঁদপুর পৌরসভার অনেকেই জানে পৌরসভার সম্পত্তি লিজ দেওয়ার নামে মানুষজনের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও টিকে আছেন আকাম-মফিজ সিন্ডিকেট।’
কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, মেয়র জুয়েল পৌরসভার সিন্ডিকেট ভাঙা, দুর্নীতি দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। তারা দাবি করেন, আকাম ভূঁইয়াা-মফিজ চক্র মেয়রের নিজস্ব লোকজনকে দলে ভিড়িয়ে সিন্ডিকেটকে আরও শক্তিশালী করেছে।
জানা গেছে, ‘আকাম ভূঁইয়া’ এখনো উৎকোচ নিয়ে সম্প্রসারিত ভবনের পৌর কর নেন না, নতুন হোল্ডিং, মিউটেশন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ, ভবনের নকশা অনুমোদন, যৌথ জরিপ, ট্রেড লাইসেন্স দিতে ঘুষ নেন। দিনে দিনে তার ঘুষের রেট বেড়েছে। তার অবৈধ আয়ের আরও খাতের মধ্যে আছে হাট-বাজার, গরুর বাজারের ইজারার কোটি কোটি টাকা পৌরসভার তহবিলে জমা না দেওয়া, পৌরসভার ভূমি লিজ-দোকান বরাদ্দ ও মিউটেশনে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া। অটোরিকশা, টমটম এসব গাড়ির লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে দৈনিক ১৫০ ও মাসিক ৪ হাজার টাকা করে নেন। আবার অবৈধ যানের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন।
অবৈধ আয়ের টাকায় ‘আকাম ভূঁইয়া’ চাঁদপুর পৌরসভায় বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন। শহরের নাজিরপাড়ায় এই বাড়ির নাম রেখেছেন তাজ ভিলা। ওই এলাকায়ই একই আদলে একই মাপে বাড়ি করেছেন মফিজ হালদার।
দুজনের বাড়ি একই রকম হলো কীভাবে এ প্রশ্নে আবুল কালাম ওরফে আকাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই বিষয়টি মফিজকেই জিজ্ঞেস করেন। আমি আমার পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এ বাড়ি করেছি।’
দুর্নীতি ছাড়াও আবুল কালাম পৌর কর্মচারী সংসদের সভাপতি পদ দখল করে আছেন। মফিজসহ তারা দুজন মিলে লাখ লাখ টাকা বিলিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ফরিদগঞ্জ ফাউন্ডেশন, নাইট রাইডার্স ক্লাব, অফিসার্স ক্লাবের আদলে এলিট প্রশাসনিক/ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘এভারগ্রিন ক্লাব’ ‘ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমি’।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা।’
তবে এ চক্রের দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ পৌর বাসিন্দা কামরুল বলেন, ‘সামনে ইলেকশনে আকাম-মফিজরা নৌকায় ভোট দিলেই হইবো, আমাগো আর লাগবো না।’
তামিম ইকবাল দলে না থাকাতে যেন অনেকেরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে! আবার বিশ্বকাপের দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অন্তর্ভুক্তিতেও অনেকের চোখ কপালে! দল ঘোষণার পর যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা এলেন সংবাদ সম্মেলনে, তখন আলোচনায় শুধু ছিলেন এই দুজনেই। তাদের এই বিরহ বেদনায় চাপা পড়ে যায় অনেক প্রশ্ন। লিটন দাসকে বাদ দিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত কেন সহ-অধিনায়ক! বাড়তি কোনো ওপেনার ছাড়া কিংবা পাঁচ পেসারকে নিয়ে কেন দল গড়া?
প্রায় মিনিট পনেরোর সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে এসেছে একই প্রশ্ন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও ঘুরেফিরে বন্দী ছিলেন একই কথার বৃত্তে। প্রশ্নোত্তর শেষে বেরিয়ে যান তিন নির্বাচক। যেতে যেতে কথা হয় তাদেরই একজন হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল চাপা পড়া সেইসব প্রশ্নের উত্তর।
শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় লিটনকে বাদ দিয়ে শান্তকে কেন সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ একটা কারণ। আর লিটনের অনাগ্রহও তাকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর একটি কারণ। লিটন নিজেও চায় না নেতৃত্বের চাপ নিতে। সে একটু ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চায়।’
বিশ্বকাপ দলে বিকল্প ওপেনার না থাকার কারণও জানা গেল এই নির্বাচকের কথায়। তিনি জানালেন, ‘আমরা ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে মিরাজকে ভাবছি।’
বিকল্প ওপেনার হিসেবে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নেওয়ায় একজন বাড়তি বোলার দলে রাখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে শেখ মেহেদি হাসান সুযোগ পেয়েছেন সে কারণে। পাশাপাশি জায়গা হয়েছে পাঁচ পেসারেরও। এর পেছনে বাশার ভারতের কন্ডিশনের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভারতে এখন আর্লি সিজন। উইকেট সতেজ থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচজন পেসার দরকার হবে।’
যেতে যেতে আরও বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক মুখোমুখি হলেন, এই দলটা বিশ্বকাপে কেমন করবে? এই প্রশ্নটা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন হাবিবুল। উত্তরে মজা করে বললেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হবে এই দল।’ এরপর একটু গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে যোগ করলেন, ‘আমি এদের অনেক দিন ধরে দেখছি। ওরা কয়টা ম্যাচ জিতবে জানি না। তবে বিশ্বকাপে প্রতিটি দলকে ভোগাবে, এটা জানি।’
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনে রদবদলের সুযোগ নেই সরকারের। তাই এর আগেই নির্বাচনী প্রশাসনে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি ও রদবদল। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বদলি-পদায়ন হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে বড় পদোন্নতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিবেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২০ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৮ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিসিএসের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে, ২৫তম ব্যাচ ২০০৬ সালে এবং ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে।
জানা যায়, নির্বাচনের সময় ডিসিরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। তাদের যে কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দুটি ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। আর সে সময় বিসিএস নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিসিএসে ছিল নানা ধরনের তদবির। ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ দুটি বিএনপির সময়ে নিয়োগ পেলেও ২৭তম ব্যাচ নিয়োগ পেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কারণ বিএনপির শেষ সময়ে ২৭তম ব্যাচের নিয়োগে বড় ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় তা বাতিল হয়। পরে ফের পরীক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে এ ব্যাচের নিয়োগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২৪তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডিসির পদ থেকে তুলে আনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় যারা ডিসির দায়িত্বে থাকবেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের সবার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো যাচাই করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আর ডিসির পদে রাখা হবে না।
এ ছাড়া নির্বাচনে অন্যতম ভূমিকা পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। বর্তমানে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন ইউএনও পদে, যারা আসন্ন নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এখন ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনওর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারের ২৯১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইকরাম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষা হয় যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ছাত্রজীবনে কে কোন পার্টি করেছিলেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে তা বিবেচনা করা হয় না। বিসিএস কর্মকর্তাদের যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাতে তাকে একজন অফিসার হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। এরপর এসিআর, সুপিরিয়রের মতামত, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতার ভিত্তিতেই একজন কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তবে সরকার যে দল পরিচালনা করে তাদের কিছু নীতিমালা ও উদ্দেশ্য থাকে। কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া বৈধ ও জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা। তিনি প্রলুব্ধ হবেন না, নিরপেক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নির্বাচনী দায়িত্বও দেওয়া হয়, সেটাও নিরপেক্ষভাবে তিনি পালন করবেন।’
গত মে মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জনের পদোন্নতি হয়। জুলাই মাসে পাঁচ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসেই বদলি ও নতুন মিলিয়ে ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার এই ডিসি পদে এবারও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আটজন পিএসকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২১ কর্মকর্তা। এ পদোন্নতিতে মূল বিবেচনায় এসেছে ২২তম ব্যাচ। বর্তমানে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা হলো ৯৪৬ জন। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ২ নভেম্বর ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৭০ জন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অন্তত ১০ জন সচিবের স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন আগামী ১৩ অক্টোবর অবসরে যেতে পারেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান ১৪ সেপ্টেম্বর, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে আবদুস সালামের চাকরি এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩০ অক্টোবর, ইআরডি সচিব শরিফা খান ২৪ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী ২৫ নভেম্বর এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সিনিয়র সচিব কামাল হোসেন ২৯ নভেম্বর অবসরে যাবেন। ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এ ১০ জনের মধ্যে কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব পদে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক অবসরের মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সাবেক চার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে একমাত্র কবির বিন আনোয়ার ছাড়া বাকি তিনজনই স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।