ঘাস কেটে, রাখালের কাজ করে লেখাপড়া করেছেন, সংসার চালিয়েছেন। স্কুলের ২০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে এসএসসি। কলেজেও সেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে ভালো ফলাফল করেছেন মোহন রবিদাস। স্বজাতির ভূমি রক্ষা আন্দোলনে যোগ দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি ছাড়লেন। সেই থেকে চা-বাগানের মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন তিনি।
কী তার সংগ্রাম? অসুবিধাগুলোই বা কী? প্রশ্ন করেছেন আসিফ আল আজাদ
চা-শ্রমিকের সন্তান হিসেবে ছোটবেলা কোথায়, কেমন কেটেছে? স্কুল-কলেজে অসুবিধায় পড়েছেন?
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমশের নগর চা-বাগানে এক চা-শ্রমিক পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে, বেড়ে উঠেছি। আমরা যারা চা-বাগানে বসবাস করি, তারা দেখতে অনেকটাই আদিবাসীদের মতো। স্কুলে যখন ভর্তি হলাম, আমাদের চেহারা-সুরতের দিকে তাকিয়ে এমনকি শিক্ষকরাও বৈষম্য করে বলতেন, এখনো বলেন, ‘এগুলো তো কুলি, চা-বাগানে কাজ করে।’ অনেকে মেনে নিতে পারে না, স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেয়, দিয়েছেও। ভাষার দিক থেকেও আমাদের পার্থক্য করা হয়। চা জনগোষ্ঠী বাংলা, সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তাদের আলাদা, আলাদা নিজস্ব ভাষা আছে। তাই স্কুলে গেলে অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা আমরা বৈষম্যের শিকার হই, আমি হয়েছি। উদাহরণ দিই-কাশিনাথ আলাউদ্দিন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ননীগোপাল চক্রবর্তী পড়া না পারলে, পরীক্ষায় খারাপ করলেও কোনো দিন আমার গায়ে হাত তোলেননি। আমাকে মারলে তো তার গায়ে ছোট জাতের স্পর্শ লেগে যাবে, স্যারের জাত চলে যাবে। এখন অবশ্য এ ঘটনাগুলো কমছে।
সংসারে অভাব কেমন ছিল? কীভাবে জয় করেছেন?
আমার বাবা মধু রবিদাসের পেশাই ছিল আশপাশের পাহাড়ের ঘাস কেটে বিক্রি করা। ঘাস কেটে এনে স্থানীয় বাজারে আঁটিপ্রতি ১০ টাকা করে বিক্রি করতেন। একদিন ঘাস বিক্রি বন্ধ থাকলে আমাদের খাওয়া বন্ধ থাকত। ছোট বোন রাম সখীদাসের মানসিক সমস্যা হলো। তাকে ডাক্তার দেখাতে মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তখন আমাকে পরিবারের হাল ধরতে হলো। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকে নিজে ঘাস কেটে বিক্রি করে পরিবার, পড়ালেখা চালিয়েছি। বোন সুস্থ হওয়ার পরও স্কুলে পড়ার সময় নিজের পড়ালেখার খরচ গরুর রাখাল হিসেবে, ঘাস বিক্রি করে, চা-বাগানে কুলির কাজ করে জোগাড় করতে হয়েছে। মা-বাবাকেও টাকা দিয়েছি। শমসের নগরের সুজা মেমোরিয়াল কলেজে পড়ার সময় ঘাস বিক্রেতা হিসেবে সবাই চেনে বলে দূরে গিয়ে টিউশনি করতাম। ধনী প্রতিবেশীরা টিউশনি চাইলে বলতেন, ‘ও তো ঘাস বেচে, লেখাপড়ার কী জানে? ওর কাছে সন্তান পড়ালে লাভ নেই।’ ভাঙা সাইকেলে দূরে পড়াতে যেতাম। দিনে চারটি টিউশনি করাতাম। আমার মা লাখপতি। ছোট বোনটি দুই বছর আগে মারা গেছে। আমাদের বাগান মালিকের ‘ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুল’ এলাকায় খুব বিখ্যাত।
ডানকান কোম্পানির যত চা-বাগান আছে, সবগুলো থেকে সেরা ১৫টি ছাত্র-ছাত্রীকে বাছাই করে এখানে ভর্তি করে। সেই স্কুল যে আমাদের শমসের নগরে আছে জানতামই না। ঘাস বিক্রেতার ছেলেকে কে জানাবে? আমি তো সেখানে পড়ার যোগ্য নই। সেই অতি বিখ্যাত স্কুল থেকে বাণিজ্য বিভাগে পাস করেছি।
লেখাপড়া করতেও তো অসুবিধা হওয়ার কথা। তখন কাদের সহযোগিতা পেয়েছেন? কীভাবে পেয়েছেন?
আমাদের স্কুলের উপদেষ্টা মিসেস নাসরিন সুবহান, আমার কলেজের অধ্যক্ষ মোরশেদুর রহমান খুব সহযোগিতা করেছেন। ভালো ছাত্র বলে স্কুল-কলেজে আমার কোনো খরচ লাগেনি।
মেধার লড়াই আপনাকে এগিয়ে দিয়েছে। পড়ালেখা কীভাবে করতেন?
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় না ঘুরে যতটুকু সময় পেতাম, লাইব্রেরিতে বসে দিনের পড়া দিনে শেষ করতাম। বাড়ির কাজগুলো করে ফেলতাম। কারণ জানতাম-স্কুল থেকে বেরিয়েই আমাকে কাজে যেতে হবে। ছোটবেলা থেকে আমি মনোযোগী, যে কাজ করি, মন দিয়ে করি। কাজ করতে হলে মনোযোগী হতে হবেÑ এই আমার জীবনের মূলমন্ত্র।
এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল?
এসএসসি ৪.৮১ জিপিএ পেয়ে স্কুলের ২০ বছরের ইতিহাসে সেরা ফল করেছি। এইচএসসিতে ৪.৭০ জিপিএ পেয়েছি। সেটিও কলেজের বাণিজ্য বিভাগের সর্বোচ্চ ফল ছিল।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন কীভাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব- এই স্বপ্ন কোনোদিনও দেখতে পারিনি। স্বপ্ন ছিল, অনেক দূর যেতে হবে। চা বাগানের কুসংস্কার, স্বজাতি শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে হবে। সে জন্য জীবনে বড় হতে হবে। জানতাম, বড় জায়গায় যেতে হলে ভালোভাবে পড়তে হবে। ২০০৯ সালে প্রথম কলেজের শিক্ষকদের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জানলাম। তখনই পণ করলামÑ যত কষ্ট হোক, যতক্ষণ পড়তে হয়, পড়ব, সেখানে ভর্তি হবই। ভর্তির জন্য যখন পড়া শুরু করলাম, আগের বছরের প্রশ্নগুলো দেখে মনে হলো, ভর্তি হওয়া খুব কঠিন। তখন অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কোচিংয়ের গাইড বই, লেকচার শিট সংগ্রহ করে পড়েছি। দিন, রাত বলে কোনো কিছু আমার কাছে ছিল না। সারাক্ষণ পড়তাম। ‘গ’ অর্থাৎ সি ইউনিটে অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিলাম, মনটি খুব খারাপ হয়ে গেল। ২০ দিন পড়ে ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। লোকপ্রশাসনে সুযোগ পেয়ে গেলাম। কিন্তু ১০ হাজার টাকা ভর্তি ফি দিয়ে ভর্তি হওয়ার সামর্থ্য ছিল না। কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শুধাকর কৈরি ভর্তির টাকা দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইসলামিক মিশন ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মহেবুল হক সহযোগিতা করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কী দেখলেন, কী শিখলেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দেখলাম, ঢাকার মানুষ খুব আত্মকেন্দ্রিক। কেউ কাউকে সামান্য সহযোগিতা করতে চান না। নতুন এই শহরে চালাক হওয়ার জন্য নানা জায়গায় একা, একা খুব ঘুরতাম। বাসে এদিক, ওদিক যেতাম। মাঝেমধ্যে হারিয়েও যেতাম। পরে বাসের সামনে নাম লেখা দেখে উঠে ফিরে আসতাম। এই অভ্যাসই আমাকে শাহবাগ থেকে উত্তরায় টিউশনি করতে নিয়ে গেল। ৭ হাজার টাকা পেতাম। এক সময় টিউশনি করে মাসে ৩২ হাজার টাকাও আয় করেছি। তবে দ্বিতীয় বর্ষে উঠে উপলব্ধি করলাম, আমাকে আমার এলাকার মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে। প্রতি শুক্রবার বাসে এলাকায় চলে যেতাম। চলার মতো একটি টিউশনি রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিলাম। সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হলাম। সিলেট বিভাগে ২২৮টি চা বাগান আছে। সেগুলোর ১৫০টিতে গিয়েছি। তরুণদের সঙ্গে কথা বলেছি, মানুষের সমস্যায় ভরা জীবন দেখেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতেন?
ভালো গান করতাম। তখন ‘স্বাধিকার’, ‘উদীচী ঢাবি শাখা’য় গেয়েছি। ‘গড়বই বিশ্ব তো সাম্যের’ নামে ছায়ানটের করা অ্যালবামে আমার গান আছে। প্রতিবাদ, গণজাগরণের গানই বেশি গেয়েছি। ঢাকার কোথাও আন্দোলন, সংগ্রাম হলে নিজে থেকে গিয়ে গান গেয়েছি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ঘুরে দেখেছি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ২২টি কলোনি আছে। এই মানুষগুলোও আমার মতো বৈষম্যের শিকার। তারা চা-শ্রমিকদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় জীবন কাটাতে বাধ্য হন। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান নিয়ে কাজ করেছি। তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা এই মানসিকতার নয়, তারা হল টু ডিপার্টমেন্ট ভায়া টিএসসিকেন্দ্রিক জীবন কাটায়।
লেখাপড়া শেষ করে কী করলেন?
এর মধ্যে আমাদের সংগঠন ‘জাগরণ যুব ফোরাম’ দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা ২০১৫ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছি। অ্যাওয়ার্ড প্রদানের দিন সেই সময়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি একটি চাকরি দিতে চাইলেন। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসে পরীক্ষা বা বিসিএস ছাড়া চাকরি পাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। ফলে খ-কালীন হিসেবে ইন্টার্ন করা শুরু করলাম।
সেই চাকরি ছাড়তে হলো কেন?
২০১৫ সালে আমাদের হবিগঞ্জের চান্দপুর, বেগমখান চা বাগানের শ্রমিকদের ৫১১ একর জমি ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সরকার জবরদখল করে নিচ্ছিল। কিন্তু বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করছি। একদিন হঠাৎ চা-বাগানের ১০-১২ জন শ্রমিক ঢাকায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন। তারা বললেন, আপনি সহযোগিতা না করলে আমরা সাড়ে ১২শ পরিবারের থাকার জায়গা হারিয়ে ফেলব। একদিকে এতগুলো পরিবারের উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকি, অন্যদিকে আমার খ-কালীন চাকরিÑ কোনটির দিকে যাব সেই ভাবনায় পেয়ে বসল। এরপর চাকরি ছেড়ে এই শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দিলাম। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, ‘এই চাকরি তো খ-কালীন। আপনি আন্দোলনের জীবনে জড়িয়ে পড়–ন। আমার শুভকামনা রইল।’ আন্দোলন সফল হলো। পরে অনেক চাকরির সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু সংগ্রাম আমাকে যেতে দেয় না। চা-শ্রমিকরাই তো আমার প্রাণ। তাদের নিয়ে এগিয়ে যাব।
জাগরণ যুব ফোরামের জন্ম কবে, কীভাবে?
বাগানের মানুষরা মনে করেন, আমাকে জানালেই তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাদের জন্য কাজ করতে ২০১১ সালে ‘জাগরণ যুব ফোরাম’-এর জন্ম। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলাম। ১০-১২ জনকে নিয়ে শিক্ষা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের শুরু। বিশেষ করে আমাদের শমশের নগর চা-বাগানের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করি। যারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তাদের প্রেষণা জোগানো, কোচিং করানো ইত্যাদি কাজ করি। কাজ করতে করতে অনেক বিষয় জড়িয়েছে। আমাদের কম্পিটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এখন ১৭টি কম্পিউটার আছে। ১৫০-২০০ টাকা ফি নিয়ে আমরা ছেলেমেয়েদের কম্পিউটারের সবকিছু শেখাই। উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে সেলাই, পোল্ট্রি করা শেখাই। ২০১০ সালে আমি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ‘বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করেছি। দুটি সংগঠনই ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছে। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের প্রধান উপদেষ্টা। এখানে দুই বছর পর পর নতুন কমিটি হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযুক্ত ছেলে, মেয়েদের নানাভাবে সহযোগিতা করি। আমরা চাই, চা-বাগানের ছাত্রছাত্রীরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে যায়। এই বিশাল সংগঠনের বর্তমানে ৫১ সদস্যের কমিটি আছে।
চা-বাগান ঘুরে ঘুরে গান গাওয়ার দারুণ অভিজ্ঞতা কীভাবে হলো?
আমাদের চা-বাগানের শ্রমিকরা তো ৪৫টি ভাষায় কথা বলেন। আমাদের বাগানি ভাষা ‘সাদরি’। সবাই এই ভাষা বুঝতে পারি। সাদরিতেই বেশি গান করেছি। অন্য ভাষাগুলোতেও গান গেয়েছি। ১৫০টি বাগানে গান গেয়েছি। গান না গেয়ে কোনো বাগান থেকে ফিরিনি।
অনেকের সঙ্গে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। আলাদাভাবে কোনোটির কথা বলবেন?
আমার বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্য গবেষকদের সঙ্গে ২০ থেকে ২৫টি গবেষণা প্রতিবেদনে এদেশের চা-শ্রমিকদের জীবন, আদিবাসী মানুষ ও তাদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছি। সর্বশেষ মাসখানেক আগে টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে যে তথ্যগুলো আছে, সেগুলো আমার প্রদান করা। এর আগে নেপালের ত্রিভুবন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোপাল নেপালি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি মিলে সারা দেশের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বছরব্যাপী গবেষণা করেছি।
চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত? তারা কোথায় কোথায় আছেন? মানুষগুলোর প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?
এই দেশের চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। তারা চা পল্লীগুলোতে থাকেন। তাদের ভূমির কোনো অধিকার নেই। তারা জমি কিনতে, বেচতে পারেন না। মালিকের দেওয়া নির্দিষ্ট জমিতে ৮ ফিট বাই ১২ ফিট নির্দিষ্ট মাপের ঘর বানাতে পারেন। সেই ছোট্ট ঘরেই তাদের জীবন কাটে। তারা নিজস্ব আলাদা ভাষায় কথা বলেন। মানুষগুলোর প্রধান সমস্যা, মজুরি কম পান, সুপেয় পানি পান না, ঘরে বিদ্যুৎ নেই, স্যানিটারি ব্যবস্থা খুব করুণ। চা কোম্পানিগুলো মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে চা চাষের জমিগুলো ৩০ থেকে ৪০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে চা ব্যবসা করে। বাগান মালিকরা জানেন, জীবনের মান উন্নত হলে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারলে তারা আর এই অন্ধকার পেশাতেই থাকবেন না। ফলে তাদের বাধার মুখে বাগানগুলোতে সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কেউই তেমন কাজ করার সুযোগ পায় না। তবে বাগানগুলোতে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে ব্র্যাক, প্রশিকা অবদান রাখতে পারছে। শ্রমিকরাও নিজেদের সমস্যা সমাধানে খুব বেশি আগ্রহী নন। ভূমির অধিকার নেই, চিরকাল শোষণের ফলে তারা আন্দোলন করতে ভয় পান। এখান থেকে বের করে দিলে তারা যাবেন কোথায়?
জাগরণ যুব ফোরাম এখন কী করছে?
তিন-চার মাস ধরে আমরা চা-বাগানের নারী ও মেয়েদের জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করছি। আমরা তো বাগানের এলাকায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে পারব না, সামর্থ্য নেই। আমরা তাদের এই ক্যান্সার না হওয়ার বিষয়ে সচেতন করতে পারি। নারীদের বলছি, মাসিকের সময় নোংরা কাপড় নয়, স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করুন। নোংরা কাপড়ের কারণে জরায়ু ক্যান্সার হয়। তবে এই মানুষগুলো একেবারেই গরিব, ৬০-৭০ টাকা খরচ করে প্যাড কেনার সামর্থ্যও নেই। ফলে আমাকে ফেইসবুকে পোস্ট দিতে হলোÑ ফেইসবুকে কে আছেন? ২শটি মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারবেন? একদিনেই অসংখ্য লাইক হলো, প্রচুর মানুষ সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিতে চাইলেন। তাদের সাহায্যে প্রতি মাসে এত ন্যাপকিন পাচ্ছি যে ঘরে রাখার জায়গা হচ্ছে না। ন্যাপকিন ব্যবহার একেবারেই জানে না বলে ইউটিউব দেখে আমরা ২০টি মেয়েকে ব্যবহারবিধি শিখিয়েছি। তাদের দলটি চা বাগানগুলো ঘুরে অন্যদের ন্যাপকিন ব্যবহার শেখাচ্ছে।
যুব ফোরামের সমস্যাগুলো কী?
ফোরাম ডোনারদের কাছ থেকে কোনো ফান্ড নেয় না। এনজিওগুলোর টাকাও আমরা নিই না। তারা টাকা দিতে চায়। দিলেই তো তারা তাদের স্বার্থ খুঁজবে। আমরা ফান্ড সংকটে আছি। আমাদের যুব ফোরামে সাড়ে ৩শ মেয়ে নানাভাবে কাজ করে। আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আপনার বোন কয়জন? বলি, আমার সাড়ে ৩শ বোন। তাদের কোনো খরচ দিতে পারি না। খুব খারাপ লাগে। তারপরও তারা নিজের ইচ্ছেতে কাজ করছে। যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করেন, তারা সবাই সদস্য। আমাদের সবসময় ‘ইয়ং বাংলা’ ও ‘সিআরআই’ সাহায্য করে। (২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ঢাকা)