গাছেরও প্রাণ আছে এমন আবিষ্কারে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। তবে তার পরের গবেষণা নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে বাংলায়। লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র
‘গাছেরা কি কিছু বলে? অনেকে বলবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? গাছ কী কোনো দিন কথা বলে থাকে?’ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর একটি লেখার শুরু এ প্রশ্ন দিয়ে। তার ওই লেখার শিরোনাম ‘গাছের কথা’। গাছের জীবন আছে, এমন আবিষ্কারে সাড়া ফেলে দেওয়া বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু পরবর্তী সময় উদ্ভিদের অনুভূতি নিয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন গাছ কথাও বলে।
ওই লেখায় বিজ্ঞানী জগদীশ আরও বলেছেন, ‘আগে যখন মাঠে কিংবা পাহাড়ে বেড়াতে যেতাম, তখন সব খালি খালি লাগত। তার পর গাছ, পাখি, কীটপতঙ্গদের ভালোবাসতে শিখেছি, সে থেকে তাদের অনেক কথা বুঝতে পারি, আগে যা পারতাম না। এই যে গাছগুলো কোনো কথা বলে না, এদের যে আবার একটা জীবন আছে, আমাদের মতো আহার করে দিন দিন বাড়ে, আগে এসব কিছুই জানতাম না। এখন বুঝতে পারছি। এখন এদের মধ্যেও আমাদের মতো আহার অভাব, দুঃখ-কষ্ট দেখতে পাই। জীবনধারণ করার জন্য এদেরও সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়। কষ্টে পড়ে এদের মধ্যেও কেউ কেউ চুরি ডাকাতি করে। মানুষের মধ্যে যেমন সদ্্গুণ আছে, এদের মধ্যেও তার কিছু কিছু দেখা যায়। বৃক্ষদের মধ্যে একে অন্যকে সাহায্য করতে দেখা যায়, এদের মধ্যে একের সঙ্গে অপরের বন্ধুত্ব হয়। তার পর মানুষের সর্বোচ্চ গুণ যে স্বার্থত্যাগ, তাও দেখা যায়। মা নিজের জীবন দিয়ে সন্তানের জীবন রক্ষা করেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন-দান উদ্ভিদের সচরাচর দেখা যায়। গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র।’
সমাজ আছে
জগদীশচন্দ্র বসু ছোটদের উপযোগী করে এ ভঙ্গিতে কথাগুলো লিখেছেন। তবে তার পরবর্তী সময় বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের ও ভাষার বিজ্ঞানীরা জগদীশের এসব কথার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। যেমন জার্মান বনবিদ ও লেখক পিটার ওয়েলবেন। গাছ নিয়ে তার বিখ্যাত বইয়ের নাম ‘দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিস’। এ বইয়ে পিটার ওয়েলেবেন দেখিয়েছেন গাছেদেরও সমাজ আছে। মানুষ যেমন একসঙ্গে অনেকজন বসবাস করে আর এর ফলে সমাজ গড়ে ওঠে, গাছেদেরও তেমনি সমাজ গড়ে ওঠে। একসঙ্গে অনেক গাছ মিলে জঙ্গল হয়। এক মানুষ যেমন আরেক মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, গাছেরাও তেমনি একে অপরের অভাব মেটায়।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গবেষক সুজান সিমার্ড প্রশ্ন করেন, উদ্ভিদের মন আছে কি না। তিনি বলেছিলেন, গাছেদের ভেতর ‘মাতৃ’ গাছের উপস্থিতি আছে এবং তারা বুদ্ধিমান হয়। গাছেদের স্মৃতিও রয়েছে। তিনি একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন, গাছেদের ভেতর একজন ‘মা’ থাকে, যে তার ‘সন্তান’দের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে।
তিনি এক গবেষণায় দেখেছেন, গাছেদের মধ্যে শেকড়ের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। কোনো গাছের কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘাটতি হলে অপর গাছ শেকড়ের মাধ্যমে তা সরবরাহ করে থাকে। শেকড়ে শেকড়ে গাছেদের এই যোগাযোগের সময় এক ধরনের শব্দ হয়, যা শুনতে অনেকটা ‘কররর...’ এ রকম।
পিটার ওয়েবলার বলেছেন, মানুষের সমাজে যেমন একজন বয়স্ক ব্যক্তি থাকে, যাকে সাধারণ অর্থে ‘মুরব্বি’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই মুরব্বি হন বয়স্ক, অনেক অভিজ্ঞতা থাকে তার। গাছেদের জঙ্গলেও তেমনি কিছু গাছ থাকে ঝাঁকড়া, যাদের অনেক বয়স; তারা নিজেদের পাতাসহ শরীরে জলীয়বাষ্প সঞ্চয় করে রাখে। যা অনাবৃষ্টির সময় অপরাপর গাছেরা ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়া গাছ মানে তাকে কেন্দ্র করে অপরাপর প্রাণীরা বসবাস করে, অক্সিজেন ও খাদ্য সংগ্রহ করে। সব মিলিয়ে গাছেরা মিলে একটা প্রাকৃতিক সমাজ তৈরি হয়।
স্পর্শ
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষ পাঁচটি মৌলিক ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে জীবনধারণ করে আসছে। সেগুলো হলো স্পর্শ, দৃষ্টি, শব্দ, গন্ধ এবং স্বাদ। এ ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে মানুষ চারপাশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে টিকে থাকে। গাছের ভেতরও এ অনুভূতিগুলো কাজ করে।
গাছের স্পর্শ অনুভূতি আছে তা বোঝার একটি সহজ উপায় হলো লজ্জাবতী গাছ। জগদীশচন্দ্র বসু এ গাছ বা গুল্ম নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ছুঁয়ে দিলেই নুয়ে পড়ার যে ঘটনা লজ্জাবতী গাছে দেখা দেয় তা বৃক্ষের স্পর্শ অনুভূতির প্রমাণকে সামনে নিয়ে আসে। গাছ নিজের নিরাপত্তার জন্যই এমন আত্মরক্ষার পদ্ধতি অবলম্বন করে। গাছের আহত হওয়ার অনুভূতির প্রমাণও জগদীশচন্দ্র দিয়েছেন।
আরেকটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘... একটি গাছ এক মিনিটে এক ইঞ্চির লাখো ভাগের ৪২ ভাগ করে বাড়ছিল। গাছটিকে তখন একখানা বেত দিয়ে সামান্য রকমে আঘাত করলাম। অমনি গাছের বৃদ্ধি একদম কমে গেল। সে আঘাত ভুলতে গাছের আধা ঘণ্টা বেশি সময় লেগেছিল।... সুচ দিয়ে বিঁধিয়েছিলাম, তাতে গাছের বৃদ্ধি করে এক-চতুর্থ হয়ে গেল। এক ঘণ্টা পরও সে আঘাত সামলিয়ে উঠতে পারেনি, তখনো তার বৃদ্ধির গতি অর্ধেকেরও বেশি হয়নি। ছুরি দিয়ে লম্বভাবে চিরলে আঘাত আরও গুরুতর হয়। তাতে বৃদ্ধি অনেক সময় পর্যন্ত থেমে যায়।’
জগদীশচন্দ্র বসু আরও লিখেছেন, ‘গাছের লিখনভঙ্গি ব্যাখ্যা অনেক সময়সাপেক্ষ। তবে উত্তেজিত অবস্থায় গাছের সাড়া বড় হয়, বিমর্ষ অবস্থায় ছোট হয় এবং মুমূর্ষু অবস্থায় লুপ্তপ্রায় হয়। এই যে সাড়ালিপি সম্মুখে দেখছেন তা লেখার সময় আকাশ ভরে পূর্ণ আলো এবং বৃক্ষ উৎফুল্ল অবস্থায় ছিল। সে জন্য সাড়াগুলোর পরিমাণ কেমন বৃহৎ। দেখতে দেখতে সাড়ার মাত্রা কোনো অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ ছোট হয়ে গেল। এর ভেতর যদি কোনো পরিবর্তন হয়ে থাকে তা আমার অনুভূতিরও অগোচর ছিল। বাইরে এসে দেখলাম, সূর্যের সম্মুখে একখানা ছোট মেঘের টুকরা বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। তার জন্য সূর্যালোক যে খানিকটা কমে গিয়েছিল তা ঘরের ভেতর থেকে কোনোভাবে বুঝতে পারিনি; কিন্তু গাছ টের পেয়েছিল, সে ছোট সাড়া দিয়ে তার বিষন্নতা জানাল। আর যেই মেঘখণ্ড চলে গেল অমনি সে আগের মতো উৎফুল্লতার সাড়া দেখাল। আগে বলেছি যে, আমি বৈদ্যুতিক পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছিলাম, সব গাছেরই অনুভব-শক্তি আছে। এ কথা পশ্চিমের বৈজ্ঞানিকরা অনেক দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারেননি।’
শেকড়ে যোগাযোগ
গাছপালা সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব খাদ্য তৈরি করে। তাই তাদের স্বাদের প্রয়োজন হয় না, যেমনটা মানুষের হয়। গাছেরা তাদের প্রয়োজনে মাটিতে পুষ্টির সন্ধান করে এবং বিষাক্ত পদার্থ এড়িয়ে চলে। বিজ্ঞানীরা এও বলছেন, গাছ প্রতিবেশীদের শনাক্ত করতে পারে। সে হিসেবে বলা হচ্ছে, মাটির নিচের গাছপালাও যোগাযোগ রয়েছে। গাছের শিকড় একে অপরের সঙ্গে বড় নেটওয়ার্ক গঠন করে। সুজান সিমার্ড এই নেটওয়ার্কগুলো অধ্যয়ন করে দেখেন যে, একটি বনের প্রায় প্রতিটি গাছ নেটওয়ার্কে সংযুক্ত। মা গাছ তাদের চারা শনাক্ত করতে পারে এবং তাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে পুষ্টি এবং জল পাঠাতে পারে।
মানুষের ইন্দ্রিয় শক্তির অন্যতম হলো দৃষ্টিশক্তি। তবে গাছের এই দৃষ্টিশক্তি কাজ করে ভিন্নভাবে। তারা মানুষের মতো ‘দেখতে’ পায় না। তবে তারা আলোর বিভিন্ন রূপ শনাক্ত করতে পারে। এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো সূর্যমুখী। এ ফুল বা ফসল সূর্যের আলোর দিকে বাড়তে থাকে। এ ছাড়া যে কোনো গাছকেই দেখা যায় সূর্যের দিকে বেড়ে উঠতে। সামান্য পরীক্ষায় যে কেউ বিষয়টির প্রমাণ পেতে পারেন। কোনো চারাগাছকে সামান্য ফাঁক রেখে ঢেকে দিলে দেখা যাবে সেটি আলোর দিকে মুখ করে বেড়ে উঠছে। অথবা ঘরের ভেতর কোনো গাছ রাখলে দেখা যায় সেটি জানালার দিকে বেড়ে উঠছে, যেখানে আলো আছে। গাছ এভাবে তার দৃষ্টিশক্তিকে কাজে লাগায়।
কান্না
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন যে, গাছ কাঁদে আর তাদের কান্নার শব্দ অনেকটা মানুষের আঙুল ফোটানোর মতো শোনায়। মানুষের আঙুলের সংযোগস্থলে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড (জয়েন্ট ফ্লুইড) থাকে। যাদের নাইট্রোজেন বুদ্্বুদ আকারে অবস্থান করে। আঙুল ফোটালে এ বুদ্্বুদ ফেটে যায় এবং এক ধরনের শব্দ হয়। গাছেরও একটি ‘ভাস্কুলার সিস্টেম’ রয়েছে যেখানে ‘কন্ডাক্টিং’ টিস্যুগুলোর একটি জটিল নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই ভাস্কুলার সিস্টেম গাছের পুরো অঙ্গকে আন্তঃসংযুক্ত করে। গাছের পুরো শরীরে পানি, খনিজ পদার্থ, পুষ্টি পরিবহনের পদ্ধতি হলো ভাস্কুলার সিস্টেম। বিজ্ঞানীরা বলছেন এসব পরিবহনের সময় গাছগুলো সারাক্ষণ শব্দ করে। কিন্তু যখন তাদের আক্রমণ করা হয়, তখন তারা অস্থির হয়ে পড়ে এবং এটি তাদের ভাস্কুলার সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। যার ফলে নিয়মিত উৎপাদিত শব্দ তৈরির ছন্দে ব্যাঘাত ঘটে। বিজ্ঞানীরা একে বলে ‘গাছের কান্না’।
জীবনদান
জগদীশচন্দ্র বলেছেন, মাতৃগাছ তার সন্তানের জীবনের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়। তিনি লিখেছেন, ফুলের মধ্যে বীজ পেকে থাকে। শরীরের রস দিয়ে গাছ বীজগুলোকে লালনপালন করতে থাকে । নিজের জীবনের জন্য এখন আর মায়া করে না। তিল তিল করে সন্তানের জন্য সব বিলিয়ে দেয়। যে শরীর কিছু দিন আগে সতেজ ছিল, এখন তা একেবারে শুকিয়ে যেতে থাকে। শরীরের ভার বহন করারও আর শক্তি থাকে না। আগে বাতাস হু হু করে পাতা নাড়িয়ে চলে যেত। পাতাগুলো বাতাসের সঙ্গে খেলা করত, ছোট ডালগুলো তালে তালে নাচত। এখন শুকনো গাছটি বাতাসের ভর সইতে পারে না। বাতাসের একেকটি ঝাপটা লাগলে গাছটি থর থর করে কাঁপতে থাকে। একেকটি করে ডালগুলো ভেঙে পড়তে থাকে। শেষে একদিন হঠাৎ গোড়া ভেঙে গাছ মাটিতে পড়ে যায়। এভাবে সন্তানের জন্য নিজের জীবন দিয়ে গাছ মরে যায়।