১০ বছর খুব বেশি সময় নয়। ইতিহাস এভাবেও যে ফিরিয়ে দেয়, জানলে সাকিব আল হাসান বোধহয় এমন ঔদ্ধত্ব সেদিন দেখাতেন না। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে হারাবার পর সাকিব সামনে এনেছিলেন কলার খোসা তত্ব! আর আজ সেই কলার খোসায় পা পিছলেই কোমর ভেঙ্গেছে আর চোখের সামনে দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে চলে গেছে আফগানিস্তান।
২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি স্বাগতিক বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। ম্যাচের পর সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার পাওয়া সাকিব সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছিলেন ড্রেসিং রুমের পরিস্থিতির কথা, ম্যাচ শুরুর আগে নাকি ড্রেসিংরুমের ময়লার পাত্রে একটু দূর থেকে কলার খোসা ছুড়ে মারছিলেন সাকিব। মারার আগে সতীর্থদের বলেছিলেন, খোসাটা ময়লার পাত্রে পড়লে আফগানিস্তান ৪০ রানে অলআউট হবে। আর বাইরে পড়লে ৮০ রানে। সাকিবের কলার খোসাতত্ত্ব যে দুই রকম সম্ভাবনার কথা বলেছিল, কোনোটাতেই জেতার কথা নয় আফগানিস্তানের। দিনশেষে সত্যি হয়েছিল সাকিবের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক। কারণ কলার খোসা ময়লার পাত্রে পড়েনি এবংআফগানিস্তানও রান করল ৪০-এর ওপরে এবং সেটা ৮০-র কাছাকাছি—৭২। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে সাকিব বলেছিলেন, 'আজকের ম্যাচের আগে আমি যতটা রিল্যাক্সড ছিলাম, খুব কম ম্যাচের আগেই এতটা থাকি। আমার তো মনে হয়, আমরা পুরো দলই জানতাম, আজকের ম্যাচ আমরাই জিততে যাচ্ছি, ম্যাচটা একপেশে হতে যাচ্ছে।’
কে জানত, ১০ বছর পর এই আফগানিস্তানই বাংলাদেশকে কলার খোসায় আছাড় খাওয়াবে। মিরপুরে সাকিব ম্যাচসেরার পুরষ্কার নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছিলেন যাদের বিপক্ষে, তারাই সেন্ট ভিনসেন্টে তাকে শূণ্যতে আউট করে ফেরালো ইতিহাসের বাঁকবদলের মুহূর্তে। আফগানিস্তান আসলে সেই আয়না, যার সামনে যেতে ভয় পায় বাংলাদেশ। আফগানিস্তান হচ্ছে সেই নির্মম সত্যি, যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এখনো কতটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট, স্থবির হয়ে আছে সেই নব্বইর দশকের শেষে।
আফগানদের সঙ্গে টেস্টেও একবার লজ্জা পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম দেখাতেই টেস্টে হারিয়ে দেয়া, মাত্র দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নামা আফগানরা একশ'র বেশি টেস্ট খেলা বাংলাদেশকে যেভাবে হারিয়ে দিল এরপর লাজলজ্জা থাকলে ক্রিকেট বোর্ডের অনেক কর্তাব্যক্তিরাই পদত্যাগ করতেন। সেসবের বালাই বাংলাদেশের ক্রিকেটে কেন, বেশিরভাগ জায়গাতেই নেই বলে তাই তারা বহাল তবিয়তে টিকে আছেন। তবে বিশ্বমঞ্চে আফগানরা যে লজ্জাটা দিল বাংলাদেশকে, এরপর আসলে অন্তত কয়েকজন ক্রিকেটারের আর জাতীয় দলে না খেলাটাই হবে সম্মানের।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা তোতাপাখির মত সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে আমরা প্রতিটা ম্যাচই জেতার জন্য খেলতে নামি। এসবই যে কথার কথা, শিখিয়ে দেয়া বুলি বা অর্থহীন প্রলাপ তার প্রমাণ আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুপার এইট এর ম্যাচটা। নিয়তি বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করায়, যেখান থেকে সেমিফাইনালে যাওয়ার রাস্তাটা তাদের জন্য সম্ভবের আওতায়। ১৩ ওভারে ১১৬ রান, মোটা দাগে এই সমীকরণ মেলালেই বিশ্বকাপের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে চলে যেত বাংলাদেশ। কিন্তু এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে বীরত্ব নয় কাপুরুষের মত পালাতে চেয়েছেন ক্রিকেটাররা। ব্যাটসম্যানরা কেউ দায়িত্ব নিয়ে খেলেননি, ডানহাতি-বামহাতি তত্বে গোটা আসরে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক-রেটে ব্যাট করা তাওহিদ হৃদয়কে ব্যাটিংয়ে আসতে হয়েছে ছয়ে, তার আগে ব্যাট করতে নেমেছেন ৫ ম্যাচ একাদশের বাইরে থাকা সৌম্য সরকার।
সেই ১৯৯৭ সালে,যখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে বলতে গেলে কিছুই ছিল না, তখন কেনিয়ার বিপক্ষে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ২৫ ওভারে ১৬৬ রান তাড়া করে জিতেছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে, কম বলে বেশি রান করার তাগিদেই নিয়মিত উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান আতাহার আলী খানকে দিয়ে ইনিংসের সূচনা করায়নি বাংলাদেশ। গর্ডন গ্রিনিজ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে পাঠিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিককে, তার ১৫ বলে ২৬ রান বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল সেই কাংখিত ছন্দ। অথচ এই ২০২৪ সালে এসে, ডাগআউট ভর্তি ভিনদেশী সাপোর্ট স্টাফ নিয়েও কারো মাথা থেকে এমন কোন কৌশল বের হয় না। সেই ঘুণেধরা ডানহাতি-বামহাতি তত্ব, যার খেসারত দিতে দিতে খেলাই শেষ।
জরা আর অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, বারবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভিন্ন ভিন্ন ফল আশা করার নামই পাগলামী। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে বিসিবির পরীক্ষা নিরীক্ষা পাগলামির পর্যায়ে গিয়েই ঠেকেছে। ২০১২'র এশিয়া কাপে বোলারকে স্ট্রাইকে ঠেলে দেয়া, ২০১৬'র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফুলটসে ক্যাচ তুলে দিয়ে জয়ের মুখ থেকে ম্যাচ হারিয়ে দেয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে স্পিনারের ফুলটস বল পেয়েও ছক্কা মারতে না পারা...অপকীর্তির কমতি নেই তার। তবুও 'সেরা ফিনিশার', 'সাইলেন্ট কিলার' বলে আহ্লাদ তাকে নিয়ে। যখন দরকার আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে মরীয়া চেষ্টা, তখন তিনি ঋষিরমত ধ্যানমগ্ন হয়ে একের পর এক ডট বল দিয়ে গেছেন নুর আহমেদের ওভারে। ৫ খানা ডট আর একখানা বাউন্ডারি।
১০ বছর আগের আর পরের বাংলাদেশ এবং আফগান দলের দিকে দেখা যাক। মোহাম্মদ নবী আর গুলবদিন নাইব এখনো টিকে আছেন। বাংলাদেশ দলে সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ। আফগানদের জিতিয়েছেন নাভিন উল হক আর রশীদ খান। রশীদ তো লেগস্পিনের জাদুকর, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে তাকে নিয়ে লাগে কাড়াকাড়ি। ২৪ বছর বয়সের নাভিনও কম নন, বিগব্যাশ থেকে বিপিএল, আইপিএল সবজায়গাতেই তার চাহিদা। এই বয়সেই টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে ১৮৭টা ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিসিবি তাসকিন আহমেদ কিংবা শরীফুল ইসলামকে ছাড়পত্রই দিতে চায় না বিদেশী লিগে খেলতে। যদি চোট পায়েই ভয়ে! অথচ প্রস্তুতি ম্যাচে চোট পেয়ে গোটা বিশ্বকাপে শরিফুল দর্শক, তাসকিনও চোট থেকে ফিরে ছিলেন না ছন্দে।
অধিনায়ক শান্ত আফগানিস্তানের কাছে হারের পর দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন আর রশিদ খান হেসেছেন আত্মতৃপ্তির হাসি। তিনি বিশ্বকাপের আগে দেশে গিয়ে কথা দিয়ে এসেছিলেন দলকে সেমিফাইনালে নেবেন, সেটা করে দেখিয়েছেন। ২০০৭ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবগুলো আসরে খেলা বাংলাদেশ এর কোচ নেপাল, নেদারল্যান্ডস আর ঘুণে ধরা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ভাবছে অভিযান সফল, এরপর যা পাই সব বোনাস। আর নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে হারানো আফগানরা এখন চোখ রাখছে ফাইনালে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা খোঁজেন অজুহাত। আফগানরা খোঁজে জয়ের পথ। যে দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয় না, যাযাবরের মত অন্য দেশে গিয়ে হোম সিরিজ খেলতে হয় সেই দেশ যখন হারিয়ে দেয় ৯০০ কোটির ক্রিকেট বোর্ডের দেশকে, যেখানে সাবেক অধিনায়ক আর সাংসদের ছড়াছড়ি, তখন বোঝা যায় কেন বেপথু দেশের ক্রিকেট। এখানে দেশপ্রেমের মোড়কে চলে বাণিজ্য, যার অংশীদারা কর্তা থেকে ক্রিকেটাররাও। আছে গোষ্ঠীতন্ত্রের অদৃশ্য সিন্ডিকেট। আছে কমিশন বাণিজ্য। এসবের আড়ালে হারিয়ে গেছে জয়ের ইচ্ছা। আফগান আয়নায় মুখ দেখলে লজ্জাই পেতে হয়। তবে কথায় আছে না, লেংটার নাই বাটপারের ভয়, তেমনি এইসব লজ্জা টজ্জাও বোধহয় তারা পাননা। পেলে তো কবেই সরে যেতেন।