বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

কোটা নিয়ে অনড় আন্দোলনকারীরা, কঠোর অবস্থান নিচ্ছে সরকার

আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৩০ পিএম

টানা ১২ দিন ধরে চলছে কোটা আন্দোলন। গত ১০ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত কোটার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়েছে। আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে আপাতত কোটা থাকছে না বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। অনেকেই বিষয়টির সমাধান দেখতে পেলেও সহসা সমাধান হচ্ছে না।

আন্দোলনকারীরা বলছে, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম মাত্রায় রেখে স্থায়ী সমাধানে আসতে হবে; না হলে তাদের আন্দোলন চলবে। আর আদালত নয়, সরকারকেই সমাধান দিতে হবে।

গত ১১ জুলাই ঢাকা, কুমিল্লাসহ কয়েক জায়গায় পুলিশের বাধা এবং সংঘর্ষের কারণে আরও ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। সব মিলিয়ে দ্রুত কোটা সমস্যার সমাধান আশা করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে কঠোর হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে প্রশাসন ও সরকার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলন কীভাবে আরও বেগবান করা যায়, তা নিয়ে সারা দেশে অনলাইন এবং অফলাইনে প্রতিনিধিসভা করা হবে। আলোচনার ভিত্তিতে আরও কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। টানা হরতাল, অবরোধ দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকার এবং আদালত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যেতে বললেও শিক্ষার্থীরা এক দফা দাবিতে অনড়। আন্দোলন আরও সংগঠিত করার চেষ্টা করছে তারা।

আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর এক মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছে। স্থায়ী সমাধান আমরা দেখিনি। আমরা চাই সরকারের নির্বাহী বিভাগ একটি কমিশন করে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করুক। আমরা বলেছি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা থাকতে পারে। দাবি মেনে নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আন্দোলনরত অন্য সমন্বয়করাও অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় রেখে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কথা বলছেন।’

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে কোটা আগের মতোই বহাল থাকবে বলে ওই পরিপত্রে বলা হয়। পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।

গত ১০ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি করে আপিল বিভাগ। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র বহাল থাকছে বলে জানান আইনজীবীরা।

গত ১১ জুলাই রায়ের মূল অংশ প্রকাশ করেছে হাইকোর্ট। এতে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটাপদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবি আরও জোরালো হয়। তারা বলছে, তাদের দাবি আদালতের কাছে নয়, নির্বাহী বিভাগের কাছে। সংসদে আইন করে সমাধান চায় তারা।

আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সরকার কিংবা নির্বাহী বিভাগের এখনো অনেক সুযোগ রয়েছে। সরকার চাইলে নতুন পরিপত্র জারি করতে পারে। সরকার আদালতকে সামনে রেখে তার দায় এড়াচ্ছে। বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক কোটা বাতিল করে শুধু অনগ্রসর জাতির জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে আইন করে স্থায়ী সমাধান চাই আমরা। সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, যত দ্রুত আমাদের দাবি পূরণ করা হবে, তত দ্রুত আমরা পড়ার টেবিলে ফিরতে পারব। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথে থাকব।’

গত বৃহস্পতিবার ঢাকাসহ কোনো কোনো স্থানে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেয়। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আদালতের রায়ের পরও এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক মনে করছে না সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। আপিল বিভাগের রায়ের পরও আন্দোলন অব্যাহত থাকায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রশাসন এবং সরকারের পক্ষ থেকে বার্তাও দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকে সরকারবিরোধী ও রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। পুলিশ কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আবেগ পুঁজি করে কোনো মহল যদি দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে সরকারকে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অরাজনৈতিক এ আন্দোলনকে কেউ যদি রাজনৈতিক ফাঁদে ফেলতে চায় তাহলে আমরা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করব।’

ওইদিন সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘(আন্দোলনকারীরা) যখন অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংস করতে যাবে, যখন জানমালের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে তখন পুলিশ বসে থাকবে না। তাদের (শিক্ষার্থীদের) চাহিদা আমরা শুনব। কিন্তু শোনারও একটা সীমা বোধহয় থাকে। তারা বোধহয় তা অতিক্রম করে যাচ্ছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা জারির পরও আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমে জনদুর্ভোগ ঘটালে তারা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।

একইদিন সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমরা তাদের আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছি। তবে আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীসমাজকে জিম্মি করে জনসাধারণের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করলে ছাত্রলীগ তা রুখে দেবে।’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের জন্য আদালতের দরজা সবসময় খোলা মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান গত বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে একটি মামলার শুনানির সময় আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্টের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘কোটা নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন তাদের পরামর্শ দিন, তারা কেন নির্বাহী বিভাগের কথা বলে? নির্বাহী বিভাগের যেকোনো সিদ্ধান্ত তো আদালতে চ্যালেঞ্জড হতে পারে। কোটা আন্দোলনকারীদের জন্য আদালতের দরজা সবসময় খোলা। তারা তাদের দাবিগুলো আইনজীবীদের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারেন, আমরা তা শুনব।’

কোটা বিতর্কের সমাধান সরকারের হাতে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছেন এক মাসের জন্য। এটা একটা ভালো দিক, আশা করি এটি কোটা আন্দোলনের অসন্তোষ ও মানুষের ভোগান্তি কমাতে ভূমিকা রাখবে। তবে এটি চূড়ান্ত সমাধান নয়। আমি মনে করি, চূড়ান্ত সমাধান সরকারের হাতে। আগে সরকার আন্দোলনের মুখে কোটাব্যবস্থাই তুলে দিয়েছিল। এটি ভালো সমাধান ছিল না, কোটা আন্দোলনকারীরাও এরকম কিছু চায়নি, চেয়েছিল সংস্কার। এ সংস্কার সংবিধানের আলোকে করতে হলে আমাদের নির্মোহভাবে সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ বুঝতে হবে। ২৮ অনুচ্ছেদে সার্বিকভাবে সাম্য ও বৈষম্যহীনতার কথা বলা আছে। ২৯ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না বলা আছে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত