আধুনিক ফুটবলের জন্ম ব্রিটেনে, সেই ১৯ শতকে। খেলাটির প্রাতিষ্ঠানিক বিস্তার দেশটির পাবলিক স্কুলগুলোর শীতকালীন ক্রীড়াসূচির অংশ হিসেবে। উইনচেস্টার কলেজ, চার্টারহাউজ, ইটন কলেজগুলো নিজেদের মধ্যে ফুটবল খেলতো। উপনিবেশিক সংস্কৃতি অদলবদলের ধারায় দ্বীপরাষ্ট্রটি থেকে গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে ফুটবল নামী ছোঁয়াচে রোগটি। যেখানে জন্ম, সেই আঁতুর ঘরে ধরা দেয়নি সাফল্য। বৈশ্বিক আসরে সবমিলিয়ে মাত্র একটি শিরোপা রয়েছে ইংল্যান্ডের। ইতিহাসের ওই একটিমাত্র শিরোপা এসেছিল ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ জেতার পর। এরপর এত বছর পার হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোনো শিরোপা জেতেনি থ্রি লায়ন্সরা।
৫৫ বছর পর তারা প্রথম কোনো ফাইনালে ওঠে গত ইউরোয়। সে সময় ঘুরে ফিরে আবার ইংলিশ সমর্থকদের স্বপ্ন ও শক্তির সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় ‘ইটস কামিং হোম’ গানটি। এর চার বছর পর আরও একটি ইউরোর ফাইনালের আগে আবার পুরনো রূপে হাজির গানটি। ইংলিশ ফুটবলের প্রতিরূপ হয়ে দাঁড়ানো এ গানটি কীভাবে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো! সাধারণ একটি থিম গান কোন শক্তির ভরে হয়ে উঠলো একটি ফুটবলপ্রেমী জাতির আশা-ভরসার প্রতীক! নাকি এতে ফুটে ওঠে নাক উচু ইংলিশদের দম্ভের গল্প! সে সব নিয়েই এ লেখা।
১৯৯৬ ইউরোর আয়োজক রাষ্ট্র হিসেবে সিম্পলি রেড এর লেখা ‘উই আর ইন দিজ টুগেদার নামে’ একটি থিম গান বেঁছে নেয় ইংল্যান্ড। কিন্তু ড্র অনুষ্ঠানের সময় বোঝা যায় গানটি ঠিক জমে ওঠেনি। আয়োজক এফএ রিক ব্লেসকিকে দায়িত্ব দেন যুতসই একটি গান প্রস্তুত করার যা ইংলিশদের কাছে ইউরোর আবেগ যথাযথভাবে পৌঁছাতে সমর্থ হবে। ৯১ ও ৯৪ তে রাগবি ও ফুটবল বিশ্বকাপের থিম সং তৈরি করেছিলেন ব্লেসকি। আয়োজক কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞাপনী সংস্থার গবেষণায় নির্ধারিত হয় ‘ফুটবল কামস হোম’ বা ‘ফুটবল ঘরে ফিরল’ হবে নতুন গানের থিম।
ওখান থেকেই সুরকার ইয়ার ব্রোওডি আর দুই দুই ব্রিটিশ কমেডিয়ান ডেভিড ব্যাডিয়েল এবং ফ্রাংক স্কিনারের মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি হয় ‘ইটস কামিং হোম’। সেবার নিজেদের মাটিতে ইউরোর সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল ইংলিশরা। ঘরের মাটিতে আরেকটি শিরোপা জয়ের স্বপ্নে বিভোর ইংলিশরা মনে প্রাণে আঁকড়ে ধরে গানটিকে। যদিও তাদের বুক ভেঙে জার্মানির সঙ্গে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড। তবে থেকে যায় গানটি। হয়ে দাঁড়ায় ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের অলিখিত সংগীত রূপে।
২০১৮ বিশ্বকাপে গানটি পায় অনন্য মাত্রা। সেমিফাইনালে ওঠা ইংল্যান্ডকে ঘিরে আবারও শিরোপা স্বপ্নে মত্ত হয়ে ওঠেন ভক্তরা। খেলোয়াড়দের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামের মনিটর—সবখানেই ভেসে উঠতে দেখা যায় ‘ইটস কামিং হোম’ লেখাটি। ওই গানের সুরে দলকে সাহস যোগাতে থাকেন সমর্থকেরা। ওইবারও সেমিতেই ইংলিশদের হৃদয় আবার শেলবিদ্ধ হয়। অতিরিক্ত সময়ের গোলে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে যায় ক্রোয়েশিয়া। ওই সময় ইংলিশ সমর্থক এবং ফুটবলারদের আচরণে নাকি দাম্ভিকতার ছাপ দেখেছিলেন ক্রোয়াটরা। এমনকি ম্যাচ হারের পর সেন্টার ব্যাক ভেদরান করলুকা জবাব দিতে বলে উঠেছিলেন, ‘ইটস নট কামিং হোম’।
দুবছর বাদে কভিডের ছোবলে এক বছর পর হওয়া ২০২০ ইউরোতে ইংলিশ সমর্থকেরা পেয়ে যান বিগত ৫৫ বছরের ইতিহাসে নিজেদের সেরা অর্জন। সেমিফাইনালে ডেনমার্ককে ২-১ গোলে হারিয়ে ঘরের মাঠে ইউরোর ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড। অলিখিত এ গানটিকেই শিরোপা জয়ের মন্ত্র হিসেবে বেছে নেন ভক্তরা। ছাড়িয়ে যান সকল সৌহার্দের সীমা। কিন্তু বিধিবাম। ওয়েম্বলিতে ১-১ সমতার পর টাইব্রেকে ইতালির কাছে শিরোপা স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় ইংল্যান্ডের। উল্টো ইতালিয়ানরা গাইতে শুরু করে ‘ইটস কামিং টু রোম’।
গানটির এ শব্দ তিনটি অধুনাকালে হয়ে দাঁড়িয়েছে ইংল্যান্ড ফুটবলের সাফল্যের প্রেরণা মন্ত্র হিসেবে। এই ইতিবাচকতার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বরাবরই একে সমালোচিত হতে হয়েছে। ইংল্যান্ড জিতলেই কি তবে কেবল শিরোপা বাড়িতে ফিরবে! অন্যরা নয়? এ সমালোচনার জবাব দিয়েছেন গানটির স্বপ্নদ্রষ্টা ব্লেসকি। বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না ইটস কামিং হোম বলতে বোঝানো হয়েছে যে আমরা টুর্নামেন্টটি জিততে যাচ্ছি। বরং এটা অনেকটা ছিল যেখানে হৃদয়ের অব্স্থান সেটাই হোম। ফুটবলটাই এখানে প্রাধান্য ছিল, শিরোপা নয়।’ সে অর্থে অবশ্য ৯৬ সালে জন্ম নেওয়া গানটি সফল। ৩০ বছর পর ইউরো আয়োজনের সুযোগ পেয়ে ইংল্যান্ড বিদায় নেওয়ার পরও ভরা ওয়েম্বলি যখন দাঁড়িয়ে একসুরে ইটস কামিং হোম গেয়ে উঠেছিল- তখনই ফুটবলের বাড়ি ফেরার সফর সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল।
আর তার পরের ধাপ হিসেবে এ শব্দ তিনটি ইংলিশ সমর্থকদের ৫৮ বছরের শিরোপা খরার কাটানোর প্রেরণা মন্ত্র হয়ে ওঠাটাও খুব প্রাকৃতিক। গত ইউরোয় হয়নি। সুযোগ এসেছে এবারের ইউরোয় সেই অভাব মোচনের। এ দফায় সোমবার রাতে ইংলিশদের বিপরীতে থাকা দলটি হলো স্পেন। তাই বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে আরও একবার ইংলিশ সমর্থকদের স্বপ্নভরা হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে ওই তিনটি শব্দ- ইটস কামিং হোম।