ফাইক জেফরি বলকিয়ার নাম দুনিয়ার বেশিরভাগ লোকই জানে না। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া এই ২৬ বছরের ফুটবলার খেলেন থাই ক্লাব রাচাবুড়ির হয়ে। ব্রুনেই জাতীয় হলের হয়ে ছয় ম্যাচ খেলে মাত্র এক গোল খেয়েছেন। এ ফুটবলারকে না চেনাই স্বাভাবিক। তাহলে উনাকে নিয়ে আলাপ উঠছে কেন? কারণটা বললে চমকে উঠারই কথা, ফাইক বলকিয়া দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ফুটবলার। সরকারি হিসেবেই ২ হাজার কোটি টাকার মালিক বলকিয়ার সম্পদের পরিমাণ দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মোট সম্পদের চেয়েও অনেক বেশি।
স্বাভাবিকভাবেই, বলকিয়া এই সম্পদ ফুটবল খেলে পাননি। তিনি পেয়েছেন বার্থ লটারি বা জন্মভাগ্যে। যা কিনা সম্পদ অর্জনে দুনিয়ায় এখনো সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা। বলকিয়া জন্মেছিলেন ব্রুনাইয়ের রাজ পরিবারে। তার দাদা ওমর আলী সাইফুদ্দিয়েন তৃতীয় ছিলেন ব্রুনাইয়ের ২৮তম সুলতান। চাচা হাসানাল বলকিয়া ১৯৬৭ সাল থেকে ব্রুনাইয়ের সুলতান আর ১৯৮৪ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর সে দেশের প্রধানমন্ত্রীও। রাজপরিবারের প্রশাখার অংশ হয়েও জন্মসূত্রে যে সম্পদের মালিক হয়েছেন ফাইক, তা দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দামি ফুটবলারের কয়েক জন্ম লাগবে উপার্জন করতে।
সম্প্রতি আরও একটা ব্যপার ঘটলো ভারতে। সে দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার অজয় জাদেজা জামনগর এস্টেটের উত্তরাধিকার পেলেন। যারা ৯০ এর দশকে ক্রিকেট দেখতেন তারা জাদেজাকে চেনেন। সে যুগের ওয়ানডে ক্রিকেটের টেমপ্লেট মেনে একটু ব্যাটিং একটু বোলিং আর তুখোড় ফিল্ডিং করতে জানা স্মার্ট ক্রিকেটার। ভীষণ হ্যান্ডসাম হওয়ায় বিজ্ঞাপন, সিনেমাতেও ডাক পড়তো। সেই তিনি এখন সম্পদের দিক দিয়ে ভারতের বর্তমান সেনসেশন বিরাট কোহলিকে ছাপিয়ে গেছেন। বিরাট কোহলি দেড়শো কোটি মানুষের দেশে পূজিত হওয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা, মাঠ আর মাঠের বাইরে টাকা তাকে বানের জলের মতো ভাসিয়ে নেয়। অথচ, ভারতের এক ছোট শহরের ‘রাজকুমার’ বার্থ লটারির জোরে কোহলির এত বছরের পরিশ্রম, অধ্যাবসায়কে ছাপিয়ে যান অর্থবিত্তে।
মেক্সিকোতে একটা প্রবাদ আছে, তোমার বিরাট ধনসম্পদ আছে মানে হচ্ছে তোমার তিনপুরুষের মধ্যে কেউ একজন মানুষকে শোষণ করতো। পুঁজিবাদের এই যুগে এসব কথা বললে বেশিরভাগ মানুষ তেড়ে আসবে। রাষ্ট্র ও তার শোষণমূলক এবং সম্মতি আদায়মূলক যন্ত্রগুলো শিখিয়েছে, পরিশ্রমই সৌভাগ্যর প্রসূতি। ইউরোপের প্রটেস্ট্যান্ট এথিকস থেকে পাওয়া এই অপ্তবাক্য দেখিয়ে মানুষকে বোঝানো হয়, গাধার মতো কাজ করে যাও, তোমার জন্য তবেই রয়েছে বিশাল পুরস্কার। এই মূলার লোভ দেখিয়ে চলে বড় বড় কর্মযজ্ঞ, আর গাধার ভাগে জোটে উদরপূর্তি করা আর কমোডিটি ফেটিশ নামক ভয়ংকর ক্ষুধার্ত এক সাপের যতকিঞ্চিত পেট ভরানোর তৃপ্তি। গাধার পরিশ্রমের বেশিরভাগটাই যায় রাজাগজা এবং তাদের বংশধরদের ভোগে।
সে যাই হোক, খেলার দুনিয়ায় ফিরে আসি। জাদেজা আর বলকিয়ার আলাপটা আসলে তোলা হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে হওয়া সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে। সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ তলানির দেশ। তবে যেহেতু মাত্র গুটিকয়েক সাবেক ব্রিটিশ কলোনি খেলাটা খেলে, আর ভারতের ক্রিকেট ভাইরাসের ছোবলে এই দেশে ক্রিকেট এক নম্বর খেলা- ফলে ব্যাবসাটা ভালোই হয়। দেশের আর সব খেলা বাদ দিয়ে ক্রিকেটেই বিনিয়োগ হয়। কর্পোরেট পুঁজির জন্য ক্রিকেট বেশ নধর একটি সোনার হাঁস। আর সেই দুনিয়ায় সাকিব একজন পোস্টার বয়।
‘বাংলাদেশের জান সাকিব আল হাসান’ এই থরো থরো আবেগে ভর করে সাকিব ও কর্পোরেট দুই হাত ভরে কামিয়েছে। বাংলাদেশ এমন এক দেশ যেখানে ২০ কোটির বেশি জনসংখ্যা নিয়ে আজ পর্যন্ত অলিম্পিকে কোনো পদক জেতে নাই। অদূর ভবিষ্যতেও জেতার কোনো সম্ভাবনা নাই। অথচ খেলাধুলার দুনিয়ায়, সারাজীবন মাথা নিচু করে গ্লানির শিকার হওয়া এদেশীয়রা কোনো কিছু নিয়ে একটু গর্ব করার জন্য মরিয়া। পোস্ট কলোনিয়াল ট্রমায় ভোগা এই জাতি হারবালের জড়িবুটি নিয়ে কোনোভাবে নিজের গৌরবকে উত্থিত করতে চায়, ক্রিকেট সেই হারবাল। মিরপুরের মাঠে কিছু জয়, বিদেশে একটা দুইটা ফ্লুকের হারবালে সে পৌরুষদীপ্ত স্বপ্নদোষে ভোগে। কর্পোরেট পুঁজি আর সাকিবরা এর লাভটুকু চেটেপুটে নেয়।
কিন্তু, সেও আসলে কতোটুকু? আধুনিক যুগে পেশাদার খেলাধুলা হচ্ছে মানুষকে অভাব-অনটন থেকে ভুলিয়ে রাখা আর জাতীয়তাবাদের উত্থিত যন্ত্রকে চাঙ্গা রাখার মাধ্যম। কিন্তু, এত আসলে শোষণের একটা বিন্দু মাত্র। টপ অফ দ্যা আইসবার্গ।
বিশ্বাস হয় না? মানতে কষ্ট হয়? গুগুল করে দেখেন, বিগত আওয়ামী সরকারের লোকজন যে পরিমাণ টাকা লুট করেছে তার তুলনায় আসলে কতটুকু গোটা ক্রিকেট ইন্ড্রাষ্ট্রি! দুনিয়ার সবচেয়ে দামি ফুটবল লিগ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অর্থনীতি একটা মাঝারি মানের মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেটের আয়ের চেয়ে কম।
তাহলে কি সাকিবকে আমরা নিরীহ বা নির্দোষ বলবো? একদমই না। অর্থের দিক দিয়ে একজন রাজনৈতিক বা কর্পোরেট স্যুর তুলনায় সাকিবও চুনোপুটি, কিন্তু কোটি মানুষের আবেগ নিয়ে খেলার অসীম ক্ষমতা খেলোয়াড়রা পান। মুহম্মাদ আলী, সক্রেটিসরা সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে জনতার সামনে শাসককে পদানত করেন। তাই তারা লিজেন্ড। সাকিব লিজেন্ড হতে পারেননি সেটা অভিযোগের বিষয় নয়, তবে তিনি আবেগ দিয়ে খেলে অপশাসকের পদলেহন করেছেন। মানুষ বড় বড় অপরাধ ভুলে যায় কিন্তু আবেগ নিয়ে খেলা ক্ষমা করে না।
আর একটা কাজ হয়, সমস্ত রাগ যখন সাকিবরে উপরেই খরচ হয়ে যায়, তখন আঠারো লাখ কোটি টাকা তছরুপ করা ডাকুদের, গরীব দেশের টাকা লুটে ধনী দেশে বেগমপাড়ায় আয়েশ করাদের নিয়ে মাতামাতির শক্তি বা মনোযোগ থাকে না। সংবাদপত্রে ছাপা হয় রোনালদো সেকেন্ডে কয় টাকা উপার্জন করেন, কিন্তু শাসকগোষ্ঠী সেকেন্ডে কয় টাকা লুট করে সে খবর আসে না। সাকিবরা এদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান দুর্ভাগ্যবশত।