মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

‘পুরনো’ জীবন আর ‘নতুন’ আল-আমিনের অভিন্ন স্বপ্ন

আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:৪৮ পিএম
মোহাম্মদ আল-আমিনকে কজনই বা চেনেন? নাবিব নেওয়াজ জীবনের তুলনায় সংখ্যাটা হাতেগোনা। জীবনের ফুটবল জীবন বলতে গেলে অস্তাচলে। বয়স হয়ে গেছে ৩৪ বছর। জাতীয় দলে এক সময় ছিলেন অবধারিত পছন্দ। আর আল-আমিনের পথচলা কেবল শুরু। ২০ বছর বয়সে আল-আমিন আছেন পায়ের নিচে শক্ত মাটির খোঁজে। চলতি ফুটবল মৌসুম অবশ্য এই দুজনকেই দেখাচ্ছে নতুন স্বপ্ন। ভিনদেশিদের ভিড়ে দুজনই নিজ নিজ দলের হয়ে গোল করছেন নিয়মিত। তাতে জীবন যেমন
জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্নে বিভোর, আল-আমিনের চোখ সিনিয়র দলে অভিষেকের।
জীবনের ফেরার গল্প লেখার আগে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার গল্পের একটা স্মৃতিচারণ করা যাক। ২০২২ সালের মে মাসে হাভিয়ের কাবরেরার প্রাথমিক স্কোয়াডে রাখা হয়েছিল সে সময় আবাহনীতে খেলা জীবনকে। ফুটবলারদের ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার তারিখ ছিল ১৬ মে। বাফুফে থেকে সময়মতো যোগাযোগ না করা একদিন পর ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন জীবন।
গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় থাকার কারণে সংবাদ মাধ্যমেও জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবরটা পৌঁছায়নি তার কাছে। এতে বেজায় চটে গিয়ে কাবরেরা জীবনকে বাদ দিয়ে দেন। নির্ধারিত সময়ে আসতে না পারার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন জীবন। তবে কোচের মন গলেনি। এতটাই ক্ষেপেছিলেন স্প্যানিশ কোচ, এরপর আর বিবেচনায় আনেননি জীবনকে। একটা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জের তাকে টানতে হচ্ছে আড়াই বছর ধরে। অথচ দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ক্লাব হোক কিংবা জাতীয় দল, কোনো ক্ষেত্রেই তার বিরুদ্ধে ওঠেনি শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ। শেষ দুই মৌসুম আবাহনীর হয়ে খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি জীবন। বিদেশিদেরই নাম্বার নাইন পজিশনে খেলানো হয়েছে বেশি। এছাড়া নাগরিকত্ব পাল্টে ফেলা এলিটা কিংসলেকে আবাহনীর কোচরা সাব হিসেবে খেলিয়েছেন জীবনকে বসিয়ে রেখে। তবে রহমতগঞ্জে আসার পর অভিজ্ঞ কোচ কামাল বাবু জীবনকে দিয়েছেন লাইফ লাইন। নিয়মিত খেলার সুযোগ পেয়ে লিগ ও ফেডারেশন কাপ মিলিয়ে সাত ম্যাচে একটি হ্যাটট্রিকসহ জীবন করেছেন আট গোল। যা তাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে জাতীয় দলে ফেরার।
আল-আমিনের গল্পটা আর দশজন স্বপ্নবাজ কিশোরের মতোই। নীলফামারীর অসচ্ছল পরিবারের সন্তান আল-আমিনের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বুট পরে ফুটবল খেলার। স’মিলে শ্রমিকের কাজ করা বাবাও চাইতেন ছেলে ফুটবলার হোক। তবে মায়ের চাওয়া ছিল ভিন্ন। মা চাইতেন ছেলেকে বড় ক্রিকেটার বানানোর। তবে আল-আমিন ফুটবলটাই খেলতেন ভালো। বঙ্গবন্ধু জাতীয় প্রাইমারি স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে তার ফুটবলের রাজপথে পা রাখা। এরপর ভাগ্যগাড়ি ছোটাতে ছোটাতে চলে যান যশোরের শামস-উল-হুদা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে। ফুটবলের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নিয়ে ২০১৮ সালে সুযোগ পান সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ জয়ী বাংলাদেশ দলে। এরপর আরামবাগে প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে অভিষেক।
দুই মৌসুম সেখানে খেলার পর শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে জায়গা পান। তবে এ মৌসুমে শেখ জামাল দল না গড়ায় শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ পুলিশে সুযোগ হয়। পুলিশের আসার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন উইঙ্গার। পুলিশের কোচ মাহবুবুল জুয়েল তাকে নাম্বার নাইন পজিশনে খেলতে উদ্বুদ্ধ করেন। উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। স্ট্রাইকারের জন্য মোটেই আদর্শ উচ্চতা নয়। তবে তার মধ্যে গোল করার তীব্র ইচ্ছাটা দেখেছেন জুয়েল। তাই প্রাক-মৌসুম থেকেই তাকে নিয়ে আলাদা কাজ করতে শুরু করেন। জুয়েল আল-আমিনের হৃদয়ে গেঁথে দেন, ‘বল ধরে রেখো না। বরং সুযোগ বুঝে গোলের চেষ্টা করো।’ সেটা করতে করতেই ২১ বছরের তরুণ লিগে এরমধ্যেই করে ফেলেছেন জীবনের সমান পাঁচ গোল। এছাড়া মঙ্গলবার বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে ফেডারেশন কাপের ম্যাচে করেন জোড়া গোল। বিদেশিদের ভিড়ে নিয়মিত গোল পাওয়াই আল-আমিনকে সিনিয়র জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
জীবনের বিশ্বাস, এই পারফরম্যান্সটা ধরে রাখতে পারলে আবার খুলবে জাতীয় দলের দরজা, ‘২০২২ সালে শেষ ম্যাচ খেলেছিলাম মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে। এরপর একটা ভুল বোঝাবুঝিতে আর সুযোগ পাইনি জাতীয় দলে। মাঝে আবাহনীতে নিয়মিত খেলার সুযোগ পাইনি। তবে রহমতগঞ্জে সুযোগ কাজে লাগাতে পেরে ভালো লাগছে। আমি মনে করি জাতীয় দলকে দেওয়ার সামর্থ্য এখনো আমার যথেষ্ট আছে। এই পারফরম্যান্সটা ধরে রেখে আরও গোল করতে চাই, যাতে জাতীয় দলের দায়িত্বে যেই থাকুক, তিনি বাধ্য হন আমাকে দলে রাখতে।’ নাম্বার নাইনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মাঠে আরও প্রমাণ দিতে চান তরুণ আল-আমিন। দেশ রূপান্তরকে সে কথাই বলেছেন পুলিশের স্ট্র্াইকার, ‘আমার ভালো গুণ কী, সেটা অন্যরা বলবে। আমি শুধু চাই নিজের উন্নতি করতে। যাতে আরও নিখুঁত হয়ে উঠতে পারি, যাতে আরও বেশি গোল করতে পারি। জাতীয় দলে আমাদের ফিনিশারের সংকট আছে। আমার স্বপ্ন মার্চে জাতীয় দলের এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে অভিষেকের। যদি ক্যাম্পে ডাক পাই, তবে নিজেকে উজাড় করে দেব মূল দলে জায়গা পেতে।’
দুজনের দুই কোচ কামাল বাবু ও মাহবুবুল জুয়েলেরও বিশ্বাস, সুযোগ পেলে তাদের দেশকে দেওয়ার সামর্থ্য আছে। কেবল জীবন, আল-আমিন নয়, স্থানীয় এই কোচরা মনে করেন, যথেষ্ট গেম টাইম পেলে স্থানীয়রাও পাবেন গোল করার আত্মবিশ্বাস। তাতে গোল আর গোলকধাঁধায় রূপ নেবে না জাতীয় দলে। লিগের পঞ্চম রাউন্ড শেষে গোলদাতার তালিকাও কিন্তু সেই কথা বলছে। ৫টি করে গোল করে সেরাদের মধ্যে দুজন বিদেশির সঙ্গে আছেন আমাদের জীবন ও আল-আমিনও।
 

 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত