চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় (ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন বা এলএ) দৈনিক কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। আর এ লেনদেনে মুখ্য সহায়তাকারীর দায়িত্ব পালন করছেন সার্ভেয়ার ও কানুনগোর সহযোগী হিসেবে কাজ করা ১০-১২ ব্যক্তি। এদের দাপ্তরিক কোনো পদপদবি বা নিয়োগের বালাই নেই। তবুও তারা দাপটের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে কাজ করে থাকেন। সার্ভেয়ার ও কানুনগোরাও ‘ফালতু’ নামে পরিচিত এসব ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। ছোট-বড় সব অবৈধ লেনদেন হয় তাদের মাধ্যমে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা সূত্রটি জানিয়েছে, সরকারি কর্মচারী না হয়েও দিনভর এলএ শাখায় বিচরণ করেন ‘ফালতুরা’। অফিস স্টাফের মতো ঘাঁটাঘাঁটি করে অফিসের কম্পিউটার। দৌড়ঝাঁপ করে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে। কখনো কখনো গায়েব করে দেন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। আর এ ফালতুদের দিয়ে বাইরের কম্পিউটার টাইপিং দোকান থেকে সার্ভেয়াররা আবেদনকারীর জমির ক্ষতিপূরণের রিপোর্ট প্রস্তুত করান। অনেক ক্ষেত্রে আবেদনকারীর এলএ আবেদন ফাইল জমা দেওয়া ও ফাইলের গুরুত্বপূর্ণ দলিল গায়েব করে আবেদনকারীকে ভোগান্তিতে ফেলার অভিযোগ আছে এসব ফালতুর বিরুদ্ধে।
এলএ শাখার সার্ভেয়ার ও কানুনগোদের নিযুক্ত ফালতুদের মধ্যে আছে হাটহাজারীর ওয়াহিদ; সন্দ্বীপের মো. হৃদয়; মিরসরাইয়ের শিপন; বাঁশখালীর রিফাত; কর্ণফুলী থানা এলাকার আইয়ুব আলী; আনোয়ারা উপজেলার আবদুল মান্নান; মিরসরাইয়ের মোশাররফ হোসেন, বেলাল উদ্দিন, গোলাম সরোয়ার, একরাম হোসেন, শাখাওয়াত হোসেন, ফখরুল ইসলাম, মো. নুরুচ্ছফা, ফৌজদারহাটের আনোয়ার ফারুক, টিটু মিয়া, খায়রুল ইসলাম; নগরের পতেঙ্গার মো. নোমান, ইলিয়াস হোসেন, আজিম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, কম্পিউটার অপারেটর মো. রিফাত সোলাইমান; ইপিজেড এলাকার আইউব আলী, দিদারুল আলম; বাঁশখালীর নজরুল ইসলাম, নেজামুল করিম; আনোয়ারার জুয়েল দত্ত, আব্দুল মান্নান, সাদ্দাম হোসেন মেম্বার, মাঈন উদ্দিন; অলংকারের আশরাফ আলী; বহদ্দারহাটের দিদারুল আলম ও বাকলিয়ার নুরুনন্নবী।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, এলএ শাখার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের বসার কক্ষে টেবিলে বসে অফিস করছেন কথিত উমেদার ওয়াহিদ। কালো রঙের সরকারি আলমারি খুলে কাগজপত্র রাখছেন তিনি। কাগজপত্র রাখা শেষে আলমারিটি বন্ধ করতেও দেখা যায় তাকে। জানা গেছে, ওয়াহিদকে ‘উমেদার’ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে নিয়োগ দিয়েছেন এলএ শাখার সার্ভেয়ার মো. জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া। এ কারণে সার্ভেয়ার জুবায়েরের জন্য নির্ধারিত সরকারি আলমারি ব্যবহার করছেন ওয়াহিদ। ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত একজন বলেন, ‘সার্ভেয়ারদের ব্যক্তিগতভাবে নিয়োগ করা উমেদার-সিন্ডিকেটই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার যাবতীয় কার্যক্রমসহ ঘুষের নেটওয়ার্ক।’
গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ফালতু বা বহিরাগতদের যোগসাজশে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎসহ নানান অভিযোগে প্রায় সময় খবরের শিরোনাম হচ্ছে চট্টগ্রামের এলএ শাখা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কর্র্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ ফালতুদের দিয়েই এলএ শাখার কতিপয় কর্মকর্তা, কানুনগো, সার্ভেয়ার কমিশনবাণিজ্যে লিপ্ত।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নগরের চকবাজার, মেহেদীবাগ, জিইসি মোড়, গোল পাহাড় মোড়, বাদুড়তলা, সদরঘাট কালিবাড়ী মোড়, প্রবর্তক মিমি সুপার মার্কেট, স্টেশন রোড, ষোলশহর নম্বর গেট, চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স, এমইএস কলেজ ও মহিলা কলেজসংলগ্ন মোড়, সানমারের সামনে, ভিআইপি টাওয়ার, কাজির দেউড়ি, স্টেডিয়াম মোড় ও বহদ্দারহাট, শিল্পকলা একাডেমি এলাকায় দালাল চক্রের আইনজীবীদের চেম্বারে ঘুষ বা কমিশনের টাকা ভাগাভাগি হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের মোবাইলে গতকাল বৃহস্পতিবার একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। অবশ্য এর আগে ২০২২ সালের ৩ আগস্ট এলএ অফিসে ক্ষতিপূরণ বাণিজ্যে জড়িত ফালতুরাসহ ২৩টি সিন্ডিকেট থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান।