বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

দরবার-ই-জহুর

আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:১৯ এএম

পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জহুর হোসেন চৌধুরী ‘দরবার-ই-জহুর’ কলামে তৎকালীন সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবের অন্যতম উপদেষ্টা এই সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব ১৯৮০ সালের ১১ ডিসেম্বর ৫৮ বছর বয়সে মারা যান। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।

অতীতের সঙ্গে অধুনার সংযোগ ঘটাতে ছাপা হলো তার লেখা উপসম্পাদকীয়

গত শনিবার ২২ এপ্রিল তারিখের ‘সংবাদ’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘নারী নির্যাতনবিরোধী কমিটির ৭-দফা’ শীর্ষক একটা খবর বক্স করে ছাপা হয়েছে। খবরটি রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চাটগাঁর নয়, দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার পীরগঞ্জ থানাধীন বিরহলী গ্রামে বেগম সুফিয়া খাতুনের সভানেত্রীত্বে ৭০ জন মহিলার এক জনসভার। সভাটি কোনো জাতীয় নারী সংগঠনের শাখা কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়নি এবং মনে হয়, সেখানে কোনো বিদুষী জাতীয় নারীনেত্রী উপস্থিত থেকে সভার গৌরব বৃদ্ধি করেননি। সভার বিবরণে দেখা যায়, উক্ত সভায় কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য রাখা হয়নি এবং দেশ গঠনে নারীসমাজকে এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বানও জানানো হয়নি।

গৃহবধূদের দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে সাদামাটা সাতটি (!) দাবিনামা সংবলিত একটি প্রস্তাবই আলোচনার পর পাস করা হয়। দাবিগুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি (১) স্ত্রীদের সঙ্গে স্বামীদের মধুর ব্যবহার করতে হবে (২) শারীরিক নির্যাতন ও মারধর বন্ধ করতে হবে (৩) কথায় কথায় চোখ রাঙানো চলবে না (৪) বহু বিবাহ চলবে না (৫) হাঁস-মুরগি-ছাগল ইত্যাদি পালন থেকে জমা স্ত্রীর নিজস্ব তহবিলে স্বামীরা হাত দিতে পারবে না (৬) প্রত্যেক স্বামীর সাধ্য ও সামর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীদের চিকিৎসা করাতে হবে (৭) সংসার পরিচালনার ব্যাপারে স্ত্রীদের মতামত শুনতে হবে (৮) ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদিতেও স্ত্রীর মতামতের মূল্য দিতে হবে এবং (৯) ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে যে স্বামীরা বাইরে চলে যায়, তারা ফেরিওয়ালাদের কাছে কিছু ক্রয় করতে চাইলে স্বামীর অবস্থানুযায়ী টাকা-পয়সা দিতে হবে।

শিরোনামায় ছিল সাতটি দাবি, গুণে নয়টি হয়ে গেল। কিন্তু এতে বক্তব্যের কিছু হেরফের হয়নি বরং মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনের এ দুর্ভোগ আরও পরিষ্কার করে ফুটে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে উপরোক্ত দাবির কয়েকটিকে হাল্কা এমনকি হাস্যকরও মনে হবে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংসারের ঘরণীদের জন্য এগুলো কঠোর বাস্তব সমস্যা। বস্তুত নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্বন্ধে অবিভক্ত ভারতের কাল থেকে বহু নারী সংগঠনের গালভরা বহু প্রস্তাব পড়েছি, কিন্তু বাংলাদেশের সুদূর এক অখ্যাত গ্রামের মহিলাদের সভায় উপরোক্ত যে দাবিগুলো করা হয়েছে, এগুলোর ন্যায় নারীদের সমস্যার এরূপ চিত্রায়ণ আমার নজরে পড়েনি। বোধহয় বেশি বিদুষী না হওয়াতেই তারা এরূপ সহজ-সরলভাবে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরতে পেরেছেন। এ দাবিতে কেবল বিবাহিত নারীদের সমস্যাগুলোই চিত্রায়িত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কুমারী ও স্বামীহারা মেয়েদের সমস্যাও কম নয়।

পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে নারীমুক্তির যে আন্দোলন চলছে, সে সম্বন্ধে যেসব দাবির বিবরণ কাগজে পড়ি, তার তুলনায় উপরোক্ত দাবি একেবারে প্রাগৈতিহাসিক। তবুও আমাদের দেশে যে মুষ্টিমেয় মেয়ে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে অত্যন্ত সীমিত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজে উপার্জনের চেষ্টা করেন, আমাদের প্রগতিশীল পুরুষরাও তাদের সম্বন্ধে সহজ হতে পারেন না। যদি বেগম রোকেয়ার ওই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতো, তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের আণবিক যুদ্ধের বিভীষিকা পর্যন্ত সব কিছুই এড়ানো যেত। রোকেয়া হলের মেয়েরা সেদিন মারামারি করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন, তাঁরা কি তাদের ছাত্রীনিবাস যে পুণ্যশ্লোক মহিলার নামে নামকরণ হয়েছে, তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানেন? তাঁরা জানেন না, মুসলমান মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অধিকার আদায়ের জন্য এই পর্দানশীন মহিলা তাঁর জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করেছিলেন। তাঁরা সচেতন নন তাঁদের ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য স্বামীর সঞ্চিত পঁচিশ হাজার টাকার শেষ কপর্দকটিও তিনি সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলের জন্য ব্যয় করেছেন।

আবার বিরহলী গ্রামের মহিলাদের সভার নয়টি দাবিতে ফিরে আসা যাক। উপরোক্ত দাবিগুলোর প্রথম চারটিই মৌলিক মানবিক অধিকার সম্পর্কিত। স্ত্রীদের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করতে হবে, শারীরিক নির্যাতন ও মারধর চলবে না, কথায় কথায় চোখ রাঙানো চলবে না, বহু বিবাহ চলবে না এ চারটি দাবির মধ্যে আমাদের মেয়েদের যে অবস্থা পরিস্ফুট হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে, শত প্রলেপ সত্ত্বেও আসলে তাদের মর্যাদা শ্রমিক ও বাসার কাজের লোকের চেয়েও খারাপ। বর্তমানে কোনো শ্রমিক ও গৃহভৃত্যের সঙ্গেও অশালীন আচরণ করা, কথায় কথায় চোখ রাঙানো সাধারণত চলে না, দৈহিক নির্যাতন ত দূরের কথা। সেদিন যে রিকশাওয়ালার গায়ে মালিক পিন ফুটিয়ে ও মারধর করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে, সেটা সচরাচর ব্যাপার নয়। এবং তার খেসারত পরদিন ঢাকার রিকশা ব্যবহারকারী লাখ লাখ মানুষকে দিতে হয়েছে। বাসার কাজের লোকের সঙ্গেও আজকাল মোটামুটি মধুর ব্যবহারই করতে হয়, নতুবা সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। কল-কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে চাকা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্ত্রীদের সঙ্গে স্বামীদের মধুর ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয়। রূঢ় ব্যবহার করলে, শারীরিক নির্যাতন অর্থাৎ মারধর করলেও স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার অসম্মানের ঝুঁকি নিতে পারে না কিংবা গৃহভৃত্য বা শ্রমিকরা যেমন অন্যত্র যেয়ে চাকরি নিতে পারে, তত সহজে তারা অন্যের সঙ্গে সংসার পাততে পারে না।

মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহবধূদের খুন হওয়ার দায়িত্ব কেবল স্বামী ও তার পরিবারের নয়, হতভাগিনী বধূর পিতারও। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কন্যার বিত্তশালী পিতা সুযোগ্য পাত্র অর্থাৎ সিভিল সার্ভিসে নিয়োজিত কিংবা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা অন্য কোনো ভালো চাকুরে ছোকরা পেলে তার অন্য কিছু খোঁজখবর না নিয়ে সুপাত্রটি ক্রয় করেন। এর ফলে একটার পর একটা মেয়ের জীবন রীতিমতো দোজখে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভূরি ভূরি খবর আমি জানি। সালেহার হত্যাও এ কারণে। তার পিতা কেন সাত লাখ টাকা খরচ করে এই লোচ্চা হবু ডাক্তার ছোকরার কাছে মেয়ে বিয়ে দিলেন? ঠাকুরগাঁর বিরহলী গ্রামের মহিলারা যে দাবি করেছেন, ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদিতেও স্ত্রীদের মতামতের মূল্য দিতে হবে, তার বাস্তব কারণ নেই কি? পিতা বা মাতা কারও একতরফা মতে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিলে ট্র্যাজেডির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। অবশ্য বিয়ের ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের মতই একমাত্র ধর্তব্য ব্যাপার, এ প্রথাই এখন দুনিয়ার অগ্রসর দেশগুলোতে চলে, কিন্তু এরপরও স্বামীর হাতে স্ত্রীর নির্যাতন ও হত্যা অনবরতই চলছে। আসল কথা, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এখনো পুরুষের আধিপত্য পুরোমাত্রায়ই রয়েছে। স্ত্রী হত্যাটা পুরুষের জুলুমের চরম প্রকাশ মাত্র। কিন্তু আমার জানাশোনার মধ্যে অল্প সংসারই রয়েছে, যেখানে স্ত্রী বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে। ভ্রুকুটি, চোখ রাঙানো তো সামান্য ব্যাপার। একটা চামচ হারিয়ে ফেলার জন্য স্ত্রীকে প্রফেসর স্বামী চোরের মার মারায় তাঁর করুণ কান্না, রাত এগারোটায় স্বকর্ণে শোনার অভিজ্ঞতা আজিমপুর কলোনিতে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগেই হয়েছে।

সত্যি কি না জানি না, আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব সম্প্রতি তাদের এ ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ার করেছেন বলে শুনেছি। এ ব্যাপারটা শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমলেই, যখন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ শিক্ষিত ছেলেরাও গন্ডায় গন্ডায় সিএসপি হওয়া শুরু করেন। জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসার একজন এমএ পাস জজ-কন্যাকে বিয়ে করে উত্তরবঙ্গের এক মহকুমার প্রশাসক নিযুক্ত হয়ে সেখানে জনৈক ব্যক্তির আইএ পড়া মেয়েকে বিয়ে করেন। তারপর করাচি বদলি হলে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তাঁর ক্লাস নাইনে পড়া বোনকেসহ করাচি যান। তারপর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে সন্তান হওয়ার পূর্বেই শ্যালিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। পরে আবার প্রথমা স্ত্রীকে ঘরে এনে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করায় তিনি চিফ সেক্রেটারির নিকট অভিযোগপত্র দেন। চিফ সেক্রেটারি এসএম আজফার আমাকে ডেকে গোটা ফাইলটি দেখিয়ে বলেন, ‘আমি যদি এ নরপশুর চাকরিটা খাই, আপনারা তো বাঙালি অফিসারকে বরখাস্ত করায় আমার পিছনে লাগবেন।’ আমি বলেছিলাম, এ ধরনের ব্যাপারে এখানকার কোনো কাগজ কোনো প্রশ্ন তুলবে না, এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। এ অফিসারের চাকরি গিয়েছিল। এ রকম ঘটনা বর্ণনা করতে গেলে কাহিনি আর শেষ হবে না। দিনাজপুরের বিরহলী গ্রামের মহিলাদের সভায় গৃহীত দাবিগুলো আলোচনা করতে যেয়ে সালেহার হত্যা ও ‘সংবাদ’-এর ঐ দিনের সংখ্যাতেই গাইবান্ধার কোনো একটি স্কুলের ছাত্রী রিনার ফুটফুটে চেহারার ছবিসহ তার অমানুষিক হত্যার কাহিনী পড়ে আমি একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। এগুলো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। (সংক্ষেপিত)

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ ২৬ এপ্রিল, ১৯৭৮

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত