দেশের উন্নয়ন হয়েছে, প্রতিবছর বাজেটের আকারও বেড়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার ওপরের দিকে থাকছে। মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২৪’ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। ২০২৩ সালে অবস্থান ছিল দশম। বাংলাদেশের চার ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কারণ দেশে দুর্নীতি কমেছে বলে নয়, বরং বাংলাদেশ নম্বর আরও কম পেয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে। সিপিআই অনুযায়ী, দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ০ (শূন্য) থেকে ১০০ (একশ)-এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে স্কেলের ০ (শূন্য) স্কোরকে দুর্নীতির সর্বোচ্চ ব্যাপকতা এবং ১০০ স্কোরকে দুর্নীতির সর্বনিম্ন ব্যাপকতা বলে ধরা হয়। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। ২০২৩ সালে অবস্থান ছিল ১৪৯তম। আফগানিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার (ভারত, পাকিস্তান, নেপাল প্রভৃতি দেশ) দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা বাংলাদেশেই বেশি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা খুবই উদ্বেগজনক। আর এ বছর স্কোর ও ক্রম অনুযায়ী দেশের অবস্থানের অবনমন প্রমাণ করে, গত ১৩ বছর কর্তৃত্ববাদী সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালন করেছে, এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা দিয়েছে ও অংশগ্রহণ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘সূচকের এবারের বিশ্লেষণ মতে, বাংলাদেশ এমন সব দেশের পর্যায়ে রয়েছে, যারা দুর্নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। নাগরিক স্বাধীনতা ও মানব উন্নয়ন সূচকে সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা দেশের চেয়েও আমাদের স্কোর কম।’ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমাদের দেশ থেকে পাচার করা অর্থ এমন সব দেশে যাচ্ছে, যারা সূচক অনুযায়ী ভালো অবস্থানে আছে। দেশে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির দায় আমাদের, অর্থ পাচার রোধে ব্যর্থতার দায়ও আমাদের। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে উচ্চমাত্রার দুর্নীতির বিকাশে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে তারা।’ উপস্থাপিত সূচকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনকাল পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের সুযোগ নেই উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও, ওই সময়সীমা পর্যন্ত (সেপ্টেম্বর ২০২৪) দলবাজি, দখলদারি, চাঁদাবাজি ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে অব্যাহত ছিল। বলা যায়, সামান্য হলেও কর্তৃত্ববাদের পতন-পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতির প্রতিফলন এখানে রয়েছে। দুর্নীতি প্রতিহত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেষ্টা করছে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার। কিন্তু তা অব্যাহত থাকবে কি না তা নির্ভর করছে মূলত সংস্থাটির সক্ষমতার ওপর। দুদকের প্রতি জনগণের যে আশা, সে অনুযায়ী কাজ করার পাশাপাশি দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়িত করতে পারলে বাংলাদেশের স্কোর পরে বাড়তে পারে। তবে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সহযোগিতা জরুরি।’
দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কও বেশ গভীর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিনঝিন পি তার বই চায়না’স ক্রোনি ক্যাপিটালিজম : দ্য ডায়নামিকস অব রেজিম ডিকে বইয়ে ‘করাপশন বাই কলিউশন’ বা পারস্পরিক যোগসাজশে করা দুর্নীতিকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের একটি নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, পারস্পরিক যোগসাজশে বা যৌথভাবে করা দুর্নীতি একক ব্যক্তির দুর্নীতির চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। বাংলাদেশে দুর্নীতির ঘটনাগুলো অনেক সময় এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে, মনে হতে পারে এগুলো স্রেফ এক ব্যক্তির অপকর্মের কারণে ঘটেছে। কিন্তু দেশে যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটছে, সেটাকে ব্যক্তিগত দুর্নীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার না থাকা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে রাখা, বড় বড় দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় না আনার কারণে দুর্নীতির চিত্রে বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানুষের মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে। দুর্নীতির ভালো স্কোর করার মতো আইনি ও কাঠামোগত সক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার জন্যই স্কোরে এগোতে পারছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। দুর্নীতি থাকার ফলে এর সুফল মানুষ ঠিকমতো পাচ্ছে না।