আন্তর্জাতিক তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া এবং এ নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে চোখেমুখে ক্ষোভ আর আশা নিয়ে লাখো মানুষ এসেছিল তিস্তাপাড়ে। একদিকে নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে, অন্যদিকে এরই মধ্যে জেগে উঠেছে জনতার অদম্য সংহতি। তাদের প্রত্যাশা, প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা নয়, বরং বর্তমান সরকারের আমলেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন দাবির কথাই ধ্বনিত হয়েছে লাখো মানুষের কণ্ঠে।
গতকাল সোমবার দুপুর থেকে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার ১১টি পয়েন্টে শুরু হয়েছে দুদিনব্যাপী তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচি। ৪৮ ঘণ্টার এ কর্মসূচি পালন করছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি।
লাখো মানুষের দাবি ভারত যদি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায় তবে তিস্তার পানি দিতে হবে। সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করেন। আর আমাদের সঙ্গে বড় দাদার মতো আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
কর্মসূচি ঘিরে তিস্তাপাড়ে যেন নতুন আশা জেগে উঠেছে। ফজরের নামাজের পর থেকে তিস্তা চর এলাকার পাশাপাশি দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মানুষ একত্রিত হতে থাকে। দুপুর ১২টার মধ্যে লাখো মানুষের সমাবেশ।
বিকেল ৪টায় কর্মসূচির মূল মঞ্চ কাউনিয়ায় তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে জনতার ঢল। কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তিস্তা বাঁচানোর ডাক আমাদের অন্তরের ডাক উল্লেখ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ভারতের উদ্দেশে বলেন, যদি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চান তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করেন। আর আমাদের সঙ্গে বড় দাদার মতো আচরণ বন্ধ করেন। আমরা আমাদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে চাই। আমরা আমাদের হিস্যা বুঝে নিতে চাই। আমরা অবশ্যই ভারতকে বন্ধুত্বের সঙ্গে দেখতে চাই। যে বন্ধুত্ব হবে সম্মানের সঙ্গে আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকের এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচা-মরার সংগ্রাম। তিস্তাপাড়ের মানুষের এই সংগ্রামকে কখনো বন্ধ হতে দেব না। অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিষ্কার বলতে চাই, তিস্তা নিয়ে আপনাদের মুখ খুলতে হবে। ভারতকে বলতে হবে আমরা পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। আর আপনারা যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার সেহেতু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা দেন।
তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে ভারতের কাছে বাংলাদেশ অনেক কিছু বেচে দিয়েছে কিন্তু তিস্তার এক ফোঁটা পানি আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শুধু তিস্তা নয়, ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। বাঁধ দিয়ে তারা পানি তুলে নিয়ে যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর আমাদের দেশের মানুষ এখানে ফসল ফলাতে পারে না। জীবন-জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়। জেলেরা মাছ ধরতে পারে না। প্রত্যেক মানুষকে কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছে।
সমাবেশে এসে অনুভূতি প্রকাশ করেছে তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা। ‘তিস্তা হামার সব শেষ করছে বাহে। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ছিল। একে একে আটবার তিস্তার ভাঙনে বিলীন হয়েছে সব। এখন মানুষের (অন্যের) জমিতে থাকি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাজার হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদ করতে পারব বাহে’Ñ এভাবেই বলছিলেন তিস্তাপাড়ের কৃষক জমসেদ মিয়া (৬৮)। আরেক কৃষক তিস্তাচর এলাকার বাসিন্দা আজগর আলী (৬৫)। তিনি বলেন, ‘খরাতেও ভাঙে, বন্যাতেও ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে বাপ-দাদার ভিটে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। যতটুকু আছে তাও ভাঙনের মুখে। শুনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু শুধু শুনিই, বাস্তবায়ন হয় না। আমরা চাই অন্তত এবার সেটা হোক।’
তিস্তার ঝাড়সিংহেশ্বর চরের কৃষক আসাদুল হক (৬২) বলেন, ‘নদী ফিরে পেলে আমরা আবারও স্বপ্ন দেখব। আজকের এ জমায়েতই প্রমাণ, তিস্তা মরেনি, মরতে দেব না।’
এদিকে তিস্তাপাড়ের যে ১১টি পয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচি হচ্ছে তা হলো নীলফামারীর ডালিয়ার তিস্তা ব্যারাজ পশ্চিমপাশ, লালমনিরহাটের দোয়ানীর তিস্তা ব্যারাজের পূর্বপাশ, কালীগঞ্জের মহিপুর সড়ক সেতু পূর্বপাশ, কালীগঞ্জ মহিপুর সড়ক সেতু পশ্চিমপাশ, আদিতমারীর মহিষখোচা, লালমনিরহাট সদরের তিস্তা রেলসেতু সংলগ্ন, রংপুরের গঙ্গাচড়া মহিপুর সেতু, রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা রেল সেতুসংলগ্ন, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের সরিষাবাড়ী ঘড়িয়াল ডাঙ্গা, উলিপুরের পাকার মাথা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ ও হরিপুর সেতুসংলগ্ন। তবে লালমনিরহাট সদরের তিস্তা রেলসেতু সংলগ্ন পয়েন্টটি হচ্ছে কর্মসূচির প্রধান মঞ্চ। সেখান থেকে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রসারণ করা হচ্ছে প্রতিটি পয়েন্টে বড় পর্দা স্থাপন করে। অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিতে জেলা ও উপজেলার বিএনপির নেতাকর্মীসহ এলাকার মানুষজনকে অংশ নিতে দেখা যায়। উদ্বোধনের পর প্রতিটি এলাকার বিএনপি নেতারা বক্তব্য রাখেন।
১১টি অবস্থান কর্মসূচির মঞ্চে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রামের রাজারহাটের সরিষাবাড়ী ঘড়িয়ালডাঙ্গা পয়েন্টে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, উলিপুরের থেতরাই পয়েন্টে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ব্রিজ পয়েন্টে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুর তিস্তা ব্রিজ পয়েন্টে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু ও শামসুজ্জামান দুদু, নীলফামারীর ডিমলা তিস্তা ব্যারেজ পশ্চিমপাড় ও লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার তিস্তা ব্যারেজ পূর্বপাড়ে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সাধারণ স¤পাদক সাইফুল হক এবং গণসংহতি আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বিভিন্ন পয়েন্টে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন।
অবস্থান কর্মসূচিতে সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, “বাংলায় কথা আছে ঠেলার নাম বাবাজি! আজকের এ কর্মসূচি ৬০ দিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর গত কয়েক দিন আগে ভারত পানি ছাড়া শুরু করেছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ঘোষণা করতে চাই, যদি তিস্তার ন্যায্য হিস্যা না দাও তাহলে আমরা এককভাবে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করব। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের অধিকার আছে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তিস্তার এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব।”
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘তিস্তার খড়খড়া মাটিগুলো যাতে মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রতারণার চিহ্ন হয়ে না থাকে সেজন্য অল্প কিছু পানি ছেড়ে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিস্তা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা করে আসছে। এই তিস্তা বাংলাদেশের মানুষের জীবনমরণের প্রশ্ন। ভারত তাদের অংশে রাবার ড্যাম বসিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটা করছে আর দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার যা খুশি তাই চাপিয়ে দিচ্ছে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লা বুলু বলেছেন, এ দেশের মানুষ ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আল্লাহ আমাদের যদি ক্ষমতা দেন, তারেক রহমান ক্ষমতায় ফিরে এসে আন্দোলন নয়, তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। এটাই হলো আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা। তাহলে বাংলাদেশে কত উন্নয়নমূলক কাজ হবে। আবার খাল খনন কর্মসূচি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুরু হবে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘ভারত একবার আমাদের পানি শুকিয়ে মারে আরেকবার আমাদের পানিতে ডুবিয়ে মারে। এই হচ্ছে ভারতের নীতি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অববাহিকায় যত দেশ রয়েছে সবাই সেই নদীর পানি সমানভাবে পাবে। কিন্তু ভারত সরকার সেই আইন লঙ্ঘন করে তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ দিয়ে পানি একতরফা ব্যবহার করছে।’
তিস্তা নদী ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী। রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলার ও ১২টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত। তিস্তা শুধু একটিমাত্র প্রবাহ নয়, শাখা-প্রশাখা প্রাণ-প্রকৃতি ও উপনদী মিলে তিস্তা সংযুক্ত নদীর সংখ্যা ২২টি। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বেণিসদৃশ তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে প্রবাহ ১১৫ কিলোমিটার উপনদী মিলেই তিস্তার উৎপত্তিস্থল থেকে ভাটির ব্রহ্মপুত্রের সীমানা পর্যন্ত; ৩১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা অববাহিকাকে একটি ইউনিট ধরে সারা বছরের পানির প্রবাহ হিসেবে এনে অববাহিকাভিত্তিক যৌথ ব্যবস্থাপনা গড়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল। এ লক্ষ্যে ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বিরোধ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় থেকেই শুরু হয়, যখন নদীর জলাধারগুলো ভারত এবং নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান রাজ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর এ সমস্যাটি আবার উত্থাপিত হয়। ১৯৮৩ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে ভারত নদীর পানির ৩৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ লাভ করে। তবে এ ব্যবস্থা কখনো স্থায়ী চুক্তিতে রূপান্তরিত হয়নি এবং তখন থেকেই আলোচনা চলছে।
২০১১ সালে একটি বিস্তৃত চুক্তি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা এগিয়ে যায়, যেখানে একটি খসড়া চুক্তির প্রস্তাব করা হয় যে, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার ৩৭.৫ শতাংশ পানি বাংলাদেশকে বরাদ্দ করা হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা, তার রাজ্যে পানি সংকটের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে চুক্তিটি স্থগিত করে দেয়। ভারতের এ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন বিরোধ সমাধানের ক্ষেত্রে একটি অবাঞ্ছিত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
দ্বিতীয় দিন আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় গণপদযাত্রা (তিস্তা ব্রিজ থেকে কাউনিয়া) পর্যন্ত, দুপুর ১২টায় তিস্তা নদীর পানিতে নেমে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, দুপুর ২টায় সিরাজুম মুনিরা পাখি পরিবেশিত সংগীতানুষ্ঠান, বিকেল ৩টায় পল্লবী সরকার মালতী পরিবেশিত সংগীতানুষ্ঠান, বিকেল ৪টায় সুলতানা জামান জ্যোৎস্না পরিবেশিত সংগীতানুষ্ঠান, বিকেল ৫টায় রবীন্দ্রনাথ ও তার দল পরিবেশিত পালা গান।
সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান অতিথি বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল বক্তব্য ও ডকুমেন্টরি ভিডিও প্রদর্শন, রাত ৮টায় নকশিকাঁথা পরিবেশিত সংগীতানুষ্ঠান, রাত ৯টায় বেবী নাজনীন পরিবেশিত সংগীতানুষ্ঠান, রাত ১০টায় সিনেমা ‘সাঁতাও’ প্রদর্শন, রাত ১২টায় সফল কর্মসূচির পরিসমাপ্তি।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি