সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

এসপির সঙ্গে দূরত্ব কমাতে চান ডিসি

  • পুলিশ নিয়োগে সংশ্লিষ্টতা চান ডিসিরা
  • রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চিরতরে বন্ধ চান সবাই
  • এক মাসের মধ্যেই র‌্যাবের নাম পরিবর্তনের সম্ভাবনা  
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:২৪ এএম

জেলা প্রশাসকরা পুলিশ সুপারদের (এসপি) সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে এবার সক্রিয় হচ্ছেন। অতীতে প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকে এমন দূরত্ব দেখা দিত। এমনকি কোনো বৈঠকে এসপির পরিবর্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের পাঠানো হতো। এ নিয়ে আক্ষেপ আছে জেলা প্রশাসকদের। জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জেলা প্রশাসকরা এবারের সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করার ওপর জোর দিয়েছেন। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতেও বেশকিছু সুপারিশ আনা হয়েছে। গত ১৬ বছর ধরে পুলিশের কনস্টেবল বা এসআই নিয়োগ হয়েছে বেশিরভাগই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পুলিশ সুপারদের পাশাপাশি ডিসি বা তাদের প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে অনির্ধারিত আলোচনা হয়। বিষয়টি সরকারের হাইকমান্ডেও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন জেলা প্রশাসক দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতীতে প্রায়ই দেখা গেছে, পুলিশের সঙ্গে আমাদের বিস্তর দূরত্ব ছিল। বিশেষ করে জেলার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকগুলোতে পুলিশ আমাদের কাউকে রাখতে অনীহা জানাত। আবার কখনো কখনো আমাদের অপমান করতে এসপিদের পরিবর্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের পাঠিয়ে দিত। অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ আছে এসপি ও ডিসিদেরই উপস্থিত থাকতে হবে।

গত সরকারের আমলে এমনও দেখা গেছে, এসপিরা পুলিশ সদর দপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিসিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আবার ডিসিরাও এসপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন। এসব বিরোধ থেকে আমরা বের হতে চাই। কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ জেলা প্রশাসক বা তাদের প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রক্রিয়ার জন্য তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন করে বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা চলছে। আমরাও চাচ্ছি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে পুলিশকে সব ধরনের সহায়তা করতে। জেলার এসপি থেকে শুরু করে কনস্টেবলদেরও সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই। কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চাচ্ছি না। বৈঠকে বেশকিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শুরু হয়ে গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্মেলন উদ্বোধন করেন। তারপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিবরা বৈঠক করেন।

গতকাল আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে জেলার এসপিদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে যেসব সুপারিশ এসেছে সেগুলো সরকারের হাইকমান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

র‌্যাবের নাম পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে র‌্যাবের নাম পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ৪৮ বছর আগে স্থগিত হওয়া একটি বিধান কার্যকর করে জেলা পুলিশ সুপারের (এসপি) এসিআর লেখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসকের হাতে এবং থানার ওসির এসিআর লেখার কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হাতে দেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছে।

মূলত পদাধিকারবলে জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির প্রধান হন জেলা প্রশাসক। পুলিশ সুপাররা ওই কমিটির সদস্য থাকেন। উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভাপতি হন ইউএনও। ওসি হন ওই কমিটির সদস্য।

ডিসি-ইউএনওদের অভিযোগ, এসপি-ওসিরা নিজেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিতে না এসে বেশির ভাগ সময় প্রতিনিধি পাঠান। জরুরি প্রয়োজনে পুলিশের তাৎক্ষণিক সহায়তা পাওয়া যায় না।

জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রধান দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে মূলত পুলিশের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তাদের সার্বিক আচার-আচরণ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিফলিত হয় এমন বার্ষিক প্রতিবেদন দেওয়ার বিধানসংবলিত পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল, ১৯৪৩-এর ৭৫ (এ) অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার কারণে প্রায়ই সরকার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

আবার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট, উচ্ছেদ অভিযানসহ ত্রাণ বিতরণ, দুর্যোগে তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়ার মতো বিভিন্ন জরুরি কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকেন। নিজস্ব সুরক্ষা নিয়ে এ ধরনের জরুরি সেবা কার্যক্রম বেগবান করতে ডিসিদের অধীনে বিভিন্ন বাহিনী নিয়ে একটি রেসপন্স ফোর্স স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে জেলা প্রশাসকরা প্রস্তাব দিয়েছেন।

জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরেই জেলায় ডিসি ও জেলা পুলিশ সুপারদের মধ্যে ছিল নানা অমিল। এই নিয়ে চিঠি চালাচালি পর্যন্ত হয়েছে। ডিসি বা পুলিশ কর্মকর্তারা যখন মিটিং করেন সেখানে অনেকে যান না। মতানৈক্যের কারণে জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসপিদেরও কোনো কথা শোনেন না জেলা প্রশাসকরা। বিষয়টি সুরাহা করতেই পিআরবিতে উল্লিখিত প্রবিধান স্মরণ করিয়ে দিয়ে ডিসিদের কাছে মামলা ও জিডির সংক্ষিপ্ত তথ্য সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। তারপরও জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ডিসিদের কাছে মামলা ও জিডির তথ্য সরবরাহ করেন না।

নাম প্রকাশ না করে একটি জেলার ডিসি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারণাস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারণাস্ত্র ও ছররা গুলি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশ মারণাস্ত্র ব্যবহার করায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কর্তব্যরত অবস্থায় বাধ্যতামূলক শরীরে ‘ক্যামেরা’ ব্যবহার নিশ্চিত করারও প্রস্তাব এসেছে।

গতকাল বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে। কীভাবে পরিস্থিতির আরও উন্নতি করা যায় তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের বড় আশা হলো- দেশ থেকে দুর্নীতি কমানো। দুর্নীতি না কমাতে পারলে দেশের অগ্রগতি হবে না। আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। এটা সব লেভেল থেকে কমিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা চাই।

র‍্যাবের নাম পরিবর্তনসহ পুনর্গঠন হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘র‍্যাবের নাম পরিবর্তনসহ বাহিনীটি পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী সভায় নাম চ‚ড়ান্ত হতে পারে। কী নাম হতে পারে সে বিষয়টি এখনও আলোচনায় রয়েছে।

জানা গেছে, ২০০৪ সালে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) গড়ে তোলা হয়েছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী, দাগী ও দুর্ধ্বর্ষ জঙ্গি দমনের এলিট ফোর্স হিসেবে। তবে পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, গুমঘরে বছরের পর বছর আটকে রাখা এবং বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ডে এই সংস্থার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের ভাষ্যমতে, গুমের যে ৪০০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেখানে ১৭২টি ঘটনায় র‍্যাবের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত