সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার নামে নয়ছয়

  • ২৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ের কোনো হিসাব নাই
  • অডিট আপত্তিতে দেওয়া হয়েছে বিভ্রান্তিকর তথ্য
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩১ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণে ২০১৭ সালে একটি প্রকল্প নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। কিন্তু এ অর্থ কোন কোন খাতে, কী প্রক্রিয়ায় ব্যয় করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। 

এ ছাড়া অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির বিষয়ে দেওয়া হয়েছে বিভ্রান্তিকর তথ্য। প্রকল্পের ডিপিপিতে বিদেশ সফরের কোনো বিধান না থাকা সত্ত্বেও ১৬ জন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন প্রকল্পের অর্থে। প্রকল্প গ্রহণের আগে করা হয়নি সম্ভাব্য যাচাই। ক্রয়-সংক্রান্ত বিষয়েরও সঠিক হিসাব উত্থাপন করা হয়নি। এমন অসংখ্য অনিয়ম হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে।

সম্প্রতি প্রকল্পটির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। প্রতিবেদনটিতে উল্লিখিত প্রকল্পটির বিষয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। পর্যবেক্ষণগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পটি টেকসই করার লক্ষ্যে স্থাপনাগুলোর নির্মাণকাজ শেষে এগুলো উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল। প্রকল্পটির সমাপ্তি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৫৬টি জেলার ১৬৪টি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক স্থাপনা নির্মাণ ও সংরক্ষণে কাজ করা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন উপজেলায় কী কী কাজ করা হয়েছে, তার কোনো তালিকা দেওয়া হয়নি। এমনকি প্রাক্কলিত ব্যয় অনুসারে প্রকৃত ব্যয়ের কোনো হিসাব দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া এই স্মৃতি স্থাপনাগুলো কোনো সংস্থার কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়েও কোনো স্পষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি।

প্রকল্পটির আওতায় দুই ধাপে ১৬ জন কর্মকর্তা শিক্ষাসফরের নামে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। এই বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে প্রকল্পের ডিপিপিতে কোনো অনুমোদন ছিল না। কী প্রয়োজনে এবং কোন যৌক্তিকতায় এই বিদেশ সফর করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো কিছুই প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লেখ নেই। তা ছাড়া প্রকল্পটি শেষে এর এক্সিট প্ল্যান কী হবে, সে বিষয়েও কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় যেসব কম্পিউটার, আসবাবপত্র ও অন্যান্য অফিস সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, সেগুলোর কোনো হিসাব দেওয়া হয়নি।

অডিট নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, অডিট সম্পন্ন হয়েছে ২০১৯ সালে। অডিট বিষয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা খুবই বিভ্রান্তিকর। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অডিট নিষ্পত্তির বিষয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেটি খুবই বিভ্রান্তিকর। তারা আইএমইডিকে জানিয়েছে, প্রকল্পটির বিষয়ে কোনো অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। এর বিপরীতে অডিট দপ্তরের কোনো প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়নি। এমনকি প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর থেকেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সদ্য সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইএমইডি যাচাই-বাছাই করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এখানে যেসব অনিয়ম উঠে এসেছে, সে বিষয়ে আইএমইডি-সংশ্লিষ্ট উদ্যোগী মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।

তিনি বলেন, প্রকল্পের ডিপিপির বাইরে কোনো কাজ করার সুযোগ নেই। প্রকল্পের আওতায় যদি ডিপিপিবহির্ভূত কোনো কাজ হয়ে থাকে, সেটি বড় ধরনের অনিয়ম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।

প্রকল্পটি বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, এটি প্রণয়নের আগে কোনো সম্ভাব্য যাচাই করা হয়নি। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুতেই বিশৃঙ্খলার মুখে পড়ে। শুরুতে ১৮৮টি উপজেলায় প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়নের কথা থাকলেও, সেটি পরে ১৬৪টিতে নেমে আসে। মূল ডিপিপিতে ৩৪২টি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রাক্কলন থাকলেও শেষ পর্যন্ত ২৭২টি নির্মিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু দেশের কোথায় কোথায় এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি)। তবে স্থাপনার সংখ্যা কমানোর কারণে সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যয়ের প্রাক্কলনও কমে এসেছিল। শুরুতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। চূড়ান্তভাবে ২৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।

স্মৃতিস্তম্ভগুলো নির্মাণে আগে থেকে জায়গা নির্ধারণ করা না থাকায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে সেটি নিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ ছাড়া কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পের অঙ্গভিত্তিক ব্যয় প্রাক্কলনের একটি ছক দেওয়া থাকে ডিপিপিতে। কিন্তু এই প্রকল্পের ডিপিপিতে সেটি ছিল না। কাজেই প্রকল্পের অর্থব্যয়ে নয়ছয় হয়েছে বলে ধারণা করছেন আইএমইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

প্রকল্পটির আওতায় যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের কথা ছিল, তার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামফলক স্থাপন, সিরামিক ম্যুরাল পুনঃস্থাপন, স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো সঠিকভাবে নির্মিত হয়েছে কি না তার কোনো তথ্য নেই।

এর আগেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশি বন্ধুদের স্বর্ণপদক দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বর্ণ জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদানের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রণালয়টির বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত