শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ ও কাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণ না হওয়ায় তিন দিনেও শান্ত হয়নি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। বৃহস্পতিবারও (২০ ফেব্রুয়ারি) উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ এবং সব ছাত্র সংগঠনকে লাল কার্ড দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
তবে উপাচার্য বলছেন, ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি। পদত্যাগ ছাড়া ছাত্রদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটবে। শিক্ষার্থীরাও দ্রুত ক্লাসে ফিরে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই কুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হল থেকে এসে ক্যাম্পাসে সমবেত হতে থাকে। বেলা ১২টার দিকে তারা দুর্বার বাংলা চত্বরে জড়ো হয়।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্র রাজনীতির ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘নো ছাত্রদল, নো ছাত্রশিবির, নো বৈবিছাআ, অনলি ছাত্র’; ‘রক্ত যখন ঝরছিল প্রশাসন তখন কই ছিল?, ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’, ‘উই ওয়ান্ট নলেজ নো পলিটিকাল ড্যামেজ’, ‘শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরে, প্রশাসন তামাশা করে’, ‘ছাত্র রাজনীতি রেড কার্ড’, ‘বহিষ্কার বহিষ্কার জড়িতদের বহিষ্কার’, ‘দালালি না রাজপথ রাজপথ রাজপথ’, ‘তুমি কে আমি কে আবরার আবরার, ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘দড়ি ধরে মারো টান ভিসি হবে খান খান’- লেখা এসব প্ল্যাকার্ডের সঙ্গে লাল কার্ড প্রদর্শন করে। এ সময় মুহূর্মুহূ স্লোগানে ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে।
ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সিয়ামসহ অন্যান্য শিক্ষার্থীরা লালকার্ড দেখানোর সময় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বহিরাগতদের হামলার ঘটনায় ৫ দফা দাবি দেওয়া হলেও কুয়েট প্রশাসন সেটা মানেনি। সে-কারণে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ছাত্রবিষয়ক পরিচালককে বর্জন করা হয়েছে। আমাদের ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আন্দোলন ভিসি বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আমরা গত পরশু (১৮ ফেব্রুয়ারি) যখন প্রশাসনিক ভবনে যাই, তখন ভিসি বিরোধী আন্দোলন ছিল না। আসরা যখন চার ঘণ্টা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, তখন সেটা পরিণত হয় ভিসি বিরোধী আন্দোলন। প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এজন্য আমরা নতুন প্রশাসন চাই।
এ সময় শিক্ষার্থীরা রাজনীতি মুক্ত কুয়েট ক্যাম্পাস এবং ভিসি, প্রোভিসি ও ছাত্র কল্যাণবিষয়ক পরিচালকের পদত্যাগ দাবি করেন। পাশাপাশি তারা প্রধান উপদেষ্টার নিকট লিখিত আবেদন করার তথ্য জানান।
শিক্ষার্থীরা তাদের ৬ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সকল একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া থেকেও বিরত থেকে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, এখন যারা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন, তাদের বহিষ্কার করতে হবে। আজ (বৃহস্পতিবার) আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লাল কার্ড দেখিয়ে বয়কট ও বর্জন করেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এদিকে, গত মঙ্গলবার কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮তম সিন্ডিকেট সভায় গঠিত তদন্ত কমিটি। কমিটির সভাপতি কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম এম এ হাসেম বলেন, আমরা তদন্তের কাজ শুরু করেছি। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আমাদেরকে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অনেক কিছু যোগাড় করতে হবে। কিন্তু একাডেমিক ভবন তালাবদ্ধ থাকায় আমরা সেই সুযোগটা পাচ্ছি না। এছাড়া শিক্ষার্থীরা যদি আমাদেরকে সঠিকভাবে সহযোগিতা না করে তাহলে আমরা সময় মতো রিপোর্ট দিতে পারব না। তিনি সুষ্ঠু তদন্তে সকলের সহযোগিতা চান।
এ ব্যাপারে কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাছুদ বলেন, পদত্যাগ ছাড়া ছাত্রদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় মামলা দায়েরসহ গ্রহণযোগ্য সব কিছু করা হয়েছে। আশা করছি, ছাত্ররা সকলেই দ্রুত ক্লাসে ফিরবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠিকভাবে পরিচালনা করছি। নিয়োগ থেকে শুরু করে যত অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে- আমরা সব ঠিক করার চেষ্টা করছি। আমরা চাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় একটা নিয়মের মধ্যে আসুক। বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য সরকার আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোভাবে চালাই-তাহলে কেন পদত্যাগ করব?
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, কুয়েটে সেই ছাত্র রাজনীতিকে লালকার্ড দেখানো হয়েছে, যে ছাত্র রাজনীতি বুয়েটের আবরার ফাহাদকে হত্যা করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে লিয়াকত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, কুয়েটের ঘটনাটি একেবারেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদলের। এর সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই। যারা এটিকে শিবিরের সঙ্গে মেলাতে চাচ্ছেন, তাদের হীন উদ্দেশ রয়েছে। বরং যারাই ‘শিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে দাও’ রাজনীতি করেন এটি তাদেরই অপপ্রচার।খানজাহান আলী থানার ওসি মো. কবির হোসেন বলেন, এখনো কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের তদন্তসহ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে গত বুধবার রাতে কুয়েটে সন্ত্রাসী কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান লিটন।