বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অধিনায়ক হিসেবে খুব কাছ থেকেই মুশফিকুর রহিমের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার একদম শুরুর দিকটা দেখেছেন মাজহার উদ্দিন অমি। ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক, সাবেক ক্রিকেটার অনেক পরিচয়েই পরিচিত মাজহার দেশ রূপান্তরের অনুরোধে কলম ধরেছেন মুশফিককে বিদায়ী অর্ঘ্য দিতে। অনুলিখনে সামীউর রহমান
অনূর্ধ্ব-১৫ এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলাম আমি, মুশফিকুর রহিম ছিল আমার দলে। তখন আমরা সবাই তো বয়সে ছোট, খেলা নিয়ে খুব যে বেশি ভাবতাম তাও না। আমরা আনন্দ উপভোগের জন্য খেলতাম। মুশফিককে তখন থেকেই দেখতাম খেলা নিয়ে খুবই সিরিয়াস। আমাদের মধ্যে এতটা শৃঙ্খলাবোধ বা এতটা একাগ্রতা কাজ করত না। ওর মধ্যে ছোটবেলা থেকেই দেখতাম সিরিয়াসনেসটা বেশি, শৃঙ্খলাবোধটা অনেক বেশি। রাত জাগত না, সাড়ে ৯টার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ত। এ জিনিসগুলো সবসময় ওকে দেখে ওর প্রতি আমাদের একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করত।
পরিশ্রমের জায়গাটায় মুশফিক সবসময়ই এগিয়ে। সে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিল এমন নয়, ও অনেক কঠোর পরিশ্রম করে, শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে এ জায়গাটাতে নিজেকে নিয়ে গেছে। আমরা সবাই ওকে একটু আলাদা চোখে দেখতাম। আমরা সবাই তখন স্বপ্ন দেখতাম জাতীয় দলে খেলার, কিন্তু ওর মধ্যে শুধু জাতীয় দলে খেলাটাই না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকার প্রস্তুতি পর্বটাও ছিল। মুশফিককে আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে যে, ওর মধ্যে নেতৃত্বের গুণটা আছে। দলের ভেতর একটা কর্র্তৃত্ব নিয়ে কথা বলা, ওই দায়িত্ববোধটা, ম্যাচের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারা, দলীয় বৈঠকগুলোতে কথা বলা, এ অভ্যাসগুলো ওর আগে থেকেই ছিল। আমরা তখন ছোট মানুষ, কথা বলতে লজ্জা পেতাম। মুশফিকও এমনিতে বেশ লাজুক, কিন্তু মাঠের ভেতর সে পুরো আলাদা চরিত্র।
অনেক সময় বলা হয়, একজন ক্রিকেটারের কিটব্যাগ গোছানো দেখে বোঝা যায় সে ভবিষ্যতে কেমন করবে। মুশফিক তার রুম, তার জিনিসপত্র সবসময় খুব গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করত। আমি ওর রুমমেট ছিলাম। ওর একটা জুতা যদি বাঁকা হয়ে থাকত, সেটাও গুছিয়ে রাখত, এতটাই গোছানো ছিল। সকালে উঠে সবার আগে নিজের বিছানা ঠিক করবে, তারপর ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিছানাটা গোছাবে। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে ওর খুব সম্ভবত এইচএসসি পরীক্ষা ছিল। সেবার আমাদের অনেক কঠোর অনুশীলন করানো হয়েছিল, অনুশীলনের পর রুমে এসে আমরা তো বিছানায় কাত। কিন্তু মুশফিক এমন অনুশীলনের পরেও রুমে এসে পড়ার বই পড়ত, ওর রুমে সবসময় কয়েকটা পড়ার বই থাকত। পড়ালেখার ব্যাপারে ওর বাসা থেকেও একটা চাপ বোধহয় ছিল, সে নিজেও খুবই মনোযোগী ছিল পড়ার ব্যাপারে, ও নিজেই ঠিক করে নিয়েছিল যে ওর পড়তে হবে। আমরা যখন অবসর সময় পেতাম দেখা যাচ্ছে সেসময় টিভি দেখতাম, টেবিল টেনিস খেলতাম, মুশফিক তখন পড়ার বই পড়ত। মুশফিক আমাদের সমসাময়িক ক্রিকেটার হলেও আমরা ওকে সমীহ করতাম। আমাদের মধ্যেই একটা ভয় কাজ করত যে, মুশফিক যেন না জানে, মুশফিক জানলে খবর আছে!
ছোটবেলা থেকেই মুশফিক খুব আবেগপ্রবণ। একটা ঘটনা মনে আছে আমার, অনূর্ধ্ব-১৬ এশিয়া কাপেই ভারতের বিপক্ষে একটা ম্যাচে সে আউট হয়ে গিয়েছিল। মাঠ থেকে এসে ড্রেসিংরুমের বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে সে কান্না করছিল। আমি অধিনায়ক ছিলাম, আমি গিয়ে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, ওর কান্না দেখে আমারই কান্না পাচ্ছিল। এটা ওর জাতীয় দলেও হয়েছে। যেদিন খারাপ করে, সেদিন ওর পরিস্থিতি অন্যরকম থাকে। ও আজেবাজে কাজে সময় নষ্ট করে না, বন্ধু বলয়ের বাইরে কারও সঙ্গে খুব একটা মেশে না। ও এমন না যে, বড় হয়ে সিরিয়াস হয়েছে, ছোট থেকেই সিরিয়াস।
মুশফিককে ছোটবেলা থেকে দেখেই মনে হতো যে একসময় সে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় জায়গা করে নেবে। ওর বডি ল্যাংগুয়েজ, ডেডিকেশন, চিন্তাভাবনা সবকিছুই ছিল আমাদের বয়সের চেয়ে অনেক পরিণত, অনেক দূরদর্শী। আমরা তো তখন জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার স্বপ্ন দেখছি শুধু, মুশফিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লম্বা সময় ধরে টিকে থাকার জন্য শৃঙ্খলাটাও যে গুরুত্বপূর্ণ, সেই অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই গড়ে তুলেছিল। হাতে সবসময় একটা ঘড়ি থাকত ওর, সব জায়গায় সময়মতো উপস্থিত হতো। সবকিছুতেই সময়ানুবর্তী। ও সবসময় একটা নিয়ম শৃঙ্খলার চর্চা করত, উল্লাসে ভেসে যেত না। সেঞ্চুরি করলেও যে রুটিন অনুসরণ করবে, শূন্য করলেও সেই একই রুটিন অনুসরণ করবে।
সব কোচই মুশফিকের খুব প্রশংসা করতেন। তবে সবচেয়ে বেশি ওকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন রিচার্ড ম্যাকিন্স (বাংলাদেশের হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের কোচ)। তিনি সবসময় আমাদের বলতেন, বি লাইক মুশফিক। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও মুশফিকের মতো হওয়ার জন্য আমাদের বলতেন। সে কীভাবে আচরণ করে। কীভাবে খেলাটাকে সে দেখে। সে নিজের খেলা নিয়ে সবসময় একটা ডায়েরি লিখত। আমাদের সেটা দেখতে দিত না। ওর নিজের খেলার একটা লগ রাখার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই ছিল। মুশফিক আসলে খুব বড় একটা উদাহরণ বাংলাদেশের ক্রিকেটে। পরিশ্রম, একাগ্রতা আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে যে প্রতিভাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া যায়, সেটা মুশফিকই দেখিয়েছে।