গ্রামবাংলার সাদামাটা খেলাধুলা থেকে আজকের শিশুকিশোররা অনেক দূরে চলে এসেছে। হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো দিনের সেই খেলা, যে খেলা আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের এক অমূল্য উৎস ছিল। সে খেলাগুলোকে মনে করেই লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
আজকাল শহরের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলার মাঠে ছোটে না, তাদের দুনিয়া এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিন আর ভিডিও গেমে সীমাবদ্ধ। শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলার মাঠগুলো যেন মুছে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরের দিকে ছুটছে, কাজের সন্ধানে, আর সেইসঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের খেলাধুলার ঐতিহ্য।
এক সময় গ্রামে খেলার মাঠ ছিল প্রাণবন্ত, যেখানে শিশুরা দৌড়ঝাঁপ, ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি, গোল্লাছুট খেলত, অথচ আজকাল সে সব খেলা কেমন যেন নিঃশব্দ হয়ে গেছে। শহরের অলিতে গলিতে দালানকোঠা তৈরি হওয়ার কারণে খেলার মাঠগুলোর জায়গা হ্রাস পাচ্ছে এবং ডিজিটাল দুনিয়া শিশুদের আচ্ছন্ন করে ফেলছে। স্কুল-কলেজগুলো বছরে কয়েকদিন ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজন করে, কিন্তু এরপর আর কোনো খেলার আয়োজন দেখা যায় না।
এদিকে, ‘কাবাডি’, ‘গোল্লা’, ‘পিটা’, ‘ডান্ডাবালা’ ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আর চোখে পড়ে না। শহরের ছেলেমেয়েরা সারা দিন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে মুখ গুঁজে থাকলেও, তারা জানতেই পারে না যে, এক সময় এই একই মাঠে কত আনন্দে খেলা হতো।
দাড়িয়াবান্ধা
বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হাডুডুর মতোই আরও একটি জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্যবাহী খেলা হল দাড়িয়াবান্ধা। এই খেলাটি বিশেষত গ্রামের শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয়, তবে বড়রাও একে উপভোগ করতে পারেন। দাড়িয়াবান্ধার আসল মজা হলো তার ছক বাঁধা ঘর। খেলা দুটি দলের মধ্যে হয়ে থাকে, এবং প্রতি দলে ৫-৬ থেকে ৮-৯ জন পর্যন্ত খেলোয়াড় থাকতে পারে। খেলার মাঠে মাটির ওপর দাগ কেটে ঘরের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। এই সীমানার মধ্যে দ্রুত দৌড়ানো নয়, বরং কৌশল ও প্যাঁচের কসরতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমে, খেলায় যে ঘরগুলো ব্যবহৃত হয়, তা বিভিন্ন নামে পরিচিত। ১ নম্বর ঘর যাকে বিভিন্ন অঞ্চলে বদন ঘর, ফুল ঘর বা গদি ঘর বলে, আর ২ নম্বর ঘরকে লবণ ঘর বা পাকা ঘর বা নুন কোট বলা হয়। ঘরগুলোর মধ্যে যে দীর্ঘ দাগ থাকে, সেটিকে কিছু জায়গায় দৌড়েছি বলা হয়, আবার কোথাও শিরদাঁড়া বা খাড়াকোট নামেও পরিচিত। আর ঘরের প্রান্ত বরাবর লাইনগুলোকে পাতাইল কোট বলে।
খেলা খেলতে চাইলে প্রয়োজন হবে সমতল জমির, যেখানে কোদাল দিয়ে বা চুন দিয়ে দাগ কেটে সীমানা নির্ধারণ করতে হয়। সমান্তরাল রেখার মধ্যে কমপক্ষে এক হাত জায়গা রাখা জরুরি, যাতে খেলোয়াড়রা চলাফেরা করতে পারে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, খেলোয়াড়দের দাগে পা না পড়ার দিকে খেয়াল রাখতে হয়।
খেলা শুরু হয় গদি ঘরে এক দলের খেলোয়াড়দের অবস্থান নিয়ে। অন্য দলটি প্রতিঘরের সঙ্গে অঙ্কিত লম্বা রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার রয়েছে। যেকোনো খেলোয়াড় যদি সব ঘর ঘুরে এসে গদি ঘরে ফিরতে পারে, তবে সে এক পয়েন্ট পায়। একদল প্রথমে খেলার সুযোগ পায়, যার নাম ঘাই। পয়েন্ট পেলে ঘাই তাদের দখলে থাকে। কিন্তু বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় যদি সেই খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে ফেলে, তবে পুরো দলই ঘাই হারিয়ে ফেলে।
এভাবে খেলা চলতে থাকে। খেলোয়াড়দের একের পর এক ঘর ঘুরে আসা, কৌশল প্রয়োগ এবং সতর্কতার ওপর নির্ভর করে খেলার ফলাফল। এখানে একটি ছোট ভুল বা অসতর্কতা পুরো দলকে ঘাই হারাতে নিয়ে আসতে পারে, আর সেই মুহূর্তে পুরো দল বিপক্ষ দলের ভূমিকায় চলে আসে। এই উত্তেজনা এবং কৌশল, দাড়িয়াবান্ধাকে এক রোমাঞ্চকর খেলা বানিয়ে তোলে।
ডাঙ্গুলি
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক খেলা রয়েছে যা শুধু সময় কাটানোর জন্য নয়, বরং এক ধরনের আনন্দের উৎস হিসেবেও পরিচিত। তার মধ্যে ডাঙ্গুলি এক চমৎকার উদাহরণ। এটি ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়, আর অঞ্চলভেদে নানা নামে পরিচিত যেমন ডাংবাড়ি, গুটবাড়ি, ট্যামডাং বা ভ্যাটাডান্ডা। তবে সব থেকে পরিচিত নাম হলো ডাঙ্গুলি।
এই খেলা আসলে ক্রিকেটের গ্রামীণ সংস্করণ। ক্রিকেটের ব্যাট ও বলের মতোই, ডাঙ্গুলিতে রয়েছে ডান্ডা ও গুলির ব্যবহার। তবে এই খেলাতে মজাটা থাকে ক্যাচ ধরার কিংবা ডান্ডায় আঘাত করে আউট করার নিয়মে। দুই বা তার বেশি খেলোয়াড়ের দল হয়ে এটি খেলতে পারে।
তাহলে, কীভাবে খেলতে হয় ডাঙ্গুলি? খেলার উপকরণ খুব সাধারণ প্রায় দেড় হাত লম্বা একটি লাঠি, যাকে ডান্ডা বলা হয়, আর একটি ছোট, শক্ত কাঠি, যা গুলি, ফুলুক বা ফুত্তি নামেও পরিচিত। খেলা শুরু হয় একটি ছোট গর্ত দিয়ে। প্রথম দান পাওয়া দল এক খেলোয়াড়কে গর্তের ওপর ছোট কাঠিটি রেখে বড় লাঠির আগা দিয়ে সেটি যত দূর সম্ভব ছুড়ে মারতে বলে। এরপর, অপর পক্ষের খেলোয়াড়রা চারপাশে দাঁড়িয়ে সেটি ধরতে চেষ্টা করে। যদি তারা ধরতে পারে, তবে খেলোয়াড় আউট। কিন্তু যদি তারা ধরতে না পারে, তখন প্রথম খেলোয়াড় বড় লাঠিটিকে আড়াআড়ি রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।
এরপর, অপরপক্ষের খেলোয়াড় ছোট কাঠিটি সেই জায়গা থেকে ছুড়ে মারে গর্তের দিকে। যদি কাঠিটি বড় লাঠিটিকে আঘাত করতে পারে, তবে প্রথম খেলোয়াড় আউট হয়ে যায়। কিন্তু যদি না হয়, তখন প্রথম খেলোয়াড় কাঠির কাছে গিয়ে বড় লাঠি দিয়ে বিশেষ কায়দায় আঘাত করে সেটিকে শূন্যে তোলে। আর সেই শূন্যে থাকা কাঠি যদি সঠিকভাবে আঘাত করে দূরে পাঠিয়ে দিতে পারে, তবে আবার অন্যপক্ষ তা ক্যাচ ধরে আউট করার চেষ্টা করে। আর যদি কেউ আউট না হয়, তখন প্রথম খেলোয়াড় বড় লাঠিটি গর্তের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখে।
খেলার আরেকটি মজার দিক হলো, ছোট কাঠিটি যখন পড়বে, তখন গর্তের দূরত্ব মাপতে হবে মুনা, ধুনা, তিনা, চারা, পাঁচা, ছৈ, গৈ এভাবে লাঠি গোনা হয়। আর এই গোনাগুনতি, খেলার সময় এবং প্রতিপক্ষের খেলার কৌশল মিলে নির্ধারণ করে জয়-পরাজয়ের ফল।
ডাঙ্গুলি তাই শুধু একটি খেলা নয়, গ্রামবাংলার এক অমূল্য ঐতিহ্য, যেখানে খেলা, হাসি-ঠাট্টা আর বন্ধুত্বের এক অনবদ্য মেলবন্ধন তৈরি হয়।
গোলাপ-টগর
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা গোলাপ-টগর (যা কোথাও ফুলটোক্কা, বউরানী বা টুকাটুকি নামে পরিচিত), ছোট বড় সবারই প্রিয়। খেলার নিয়ম বেশ সোজা, কিন্তু মজাটা থাকে খেলোয়াড়দের চটপটে, ফাঁকা সময়ে সৃষ্ট হাস্যরসাত্মক মুহূর্তে। এই খেলাটি সাধারণত অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা খেলতে পছন্দ করে, যারা সমান সংখ্যক দুই দলে ভাগ হয়ে খেলে। তবে প্রতিটি দলের প্রধান একজন করে রাজা হয়, যে দলের সবকিছু পরিচালনা করে।
খেলা শুরু হয় রাজা নিজ দলের সদস্যদের নাম ঠিক করে। তিনি দলের সদস্যদের ‘ফুল’ বা ‘টগর’ নামে ডেকে তাদের নামকরণ করেন। এরপর, এক রাজার পালা শুরু হয়। সে প্রতিপক্ষের দলের কাউকে চোখ বন্ধ করে ধরে, এবং সেগুলোর মধ্যে নাম ধরে ডাক দেয় ‘আয়রে আমার গোলাপ ফুল!’ অথবা ‘আয়রে আমার টগর ফুল!’ এরপর, সেই রাজার চোখ বন্ধ থাকা খেলোয়াড়টি চুপচাপ গিয়ে তার হাত দিয়ে টোকা দিয়ে চলে আসে। তারপর, একে একে চোখ খুলে দেওয়া হয়, এবং খেলোয়াড়টি চেষ্টা করে শনাক্ত করতে যে তার কপালে টোকা দিয়েছে।
যদি সে সফল হয়, তবে সে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। এরপর বিপক্ষ দলের রাজা তার পালা পালন করে এবং এভাবেই খেলা চলতে থাকে। যতক্ষণ না কেউ বিপক্ষ দলের জমি দখল করে বা সব সদস্যকে বের করে না ফেলে, ততক্ষণ খেলা চলতে থাকে।
এক্কা-দোক্কা
বাংলাদেশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা এক্কা-দোক্কা খেলাটি পছন্দ করে, যা অঞ্চলভেদে কুতকুত, সাতখোলা, চিড়িয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত। খেলাটি বেশ মজার এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা শুধু কৌশল নয়, ব্যালান্স এবং দ্রুততার সঙ্গে খেলতে হয়।
এই খেলাটির মূল উপকরণ হলো একটি ভাঙা হাঁড়ি বা কলসির গোলাকার টুকরা, যেটি গ্রামে ‘চাড়া’ নামে পরিচিত। খেলার জন্য প্রথমে একটি সমতল জায়গা দরকার হতে পারে ঘরের ছাদ, বাড়ির উঠান বা খোলা কোনো স্থান। সেখানে মাটির ওপর একটি আয়তাকার ঘর আঁকা হয় এবং ঘরের ভেতরে ছয়টি খোপ তৈরি করা হয়। খোপগুলোর নাম যথাক্রমে : এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌক্কা, পক্কা এবং লাষ্ঠি। চার ও ছয় নম্বর ঘর খাড়া রেখা দিয়ে বিভক্ত করা হয়, আর চার নম্বর ঘরটি থাকে বিশ্রামঘর।
খেলা শুরু হয় একজন খেলোয়াড় চাড়াটি প্রথম ঘরে ফেলেই। সে এক পায়ে ভর করে লাফিয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে ‘কুত কুত’ বলে চাড়াটি এক এক করে পরবর্তী ঘরে নিয়ে যায়। সমস্ত ঘর ঘুরে চাড়াটি বের করে আনতে হবে। এরপর, চাড়া দ্বিতীয় ঘরে ফেলা হয় এবং খেলা আবার শুরু হয়। এমনভাবে, খেলোয়াড়কে ছয়টি ঘরের মধ্যে চাড়া নিয়ে যেতে হয় এবং প্রথম যে ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করবে, সে হবে জয়ী।
তবে এখানে একটি কৌশল রয়েছে যদি চাড়া আঙুলের টোকা দিয়ে ঘর অতিক্রম করার সময় কোনো দাগের ওপর থেমে যায়, তবে খেলোয়াড়টি দান হারাবে।
এছাড়া, অঞ্চলভেদে খেলাটির কিছু ভিন্ন রীতি রয়েছে যেমন চাড়াটি কপালে রেখে ঘরগুলো অতিক্রম করা বা চোখ বন্ধ করে খেলা, অথবা উল্টোদিক থেকে ঘরে চাড়া ফেলা।
এই খেলা শুধুমাত্র আনন্দের খেলা নয়, এটি শারীরিক ও মানসিক দক্ষতা বাড়ানোর একটি দারুণ উপায়। এক্কা-দোক্কা খেলে শিশুদের শারীরিক কসরত বৃদ্ধি পায় এবং তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়। এ যেন গ্রামের জীবনের এক অমলিন স্মৃতি, যেখানে খেলাধুলা ছিল জীবনের অন্যতম আনন্দ।