শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

অসম করের ভুক্তভোগী নিম্ন আয়ের পেশাজীবী

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৫, ১০:২০ পিএম

বাংলাদেশে উৎসে কর কর্তন (টিডিএস) ব্যবস্থা সময়মত কর সংগ্রহ নিশ্চিত করার জন্য এবং কর ফাঁকি রোধ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। তবে অনেক নিম্ন আয়ের পেশাজীবীদের জন্য বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সার, পরামর্শদাতা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এই ব্যবস্থাটি একটি অপ্রয়োজনীয় আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। করযোগ্য আয়ের সীমার চেয়ে কম আয় করা সত্ত্বেও তারা প্রায়শই তাদের আয়ের ওপর স্বয়ংক্রিয় কর কর্তনের শিকার হন, যা ফেরত পেতে তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়। বাস্তবতা হলো আমাদের বর্তমান কর ব্যবস্থা, নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের সমর্থন করার পরিবর্তে তাদের নগদ প্রবাহ সংকট এবং প্রশাসনিক বাধার সম্মুখীন করে।

উদাহরণস্বরূপ, একজন তরুণ পরামর্শদাতা যিনি নিয়মিত চাকরি থেকে তিন লাখ টাকা এবং ফ্রিল্যান্স কাজ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন। যেহেতু তার মোট আয় তিন লাখ ২০ হাজার টাকা করমুক্ত সীমার (সাধারণ করদাতাদের জন্য সাড়ে তিন লাখ) নিচে তাই নিয়মমাফিক তাকে কোনো আয়কর দিতে হয় না। তবে বর্তমান কর নিয়ম অনুসারে, পরামর্শ ফি ১০% উৎসে কর কর্তন সাপেক্ষে, অর্থাৎ উৎসে দুই হাজার টাকা আটকে রাখা হয়। যদিও এই পরিমাণ ছোট মনে হতে পারে, তবে যাদের বাজেট কম, তাদের জন্য প্রতিটি টাকাই গুরুত্বপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই কর্তন অপ্রয়োজনীয়। কারণ ব্যক্তির মোট আয় করযোগ্য পর্যায়েও পৌঁছায় না। তবুও এই অর্থ ফেরত পেতে তাদের একটি কঠিন রিফান্ড প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় যা খুব কম লোকই পুরোপুরি জানে ও বোঝে।

তত্ত্বগতভাবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করদাতাদের টিডিএস কর্তন তাদের প্রকৃত কর দায়ের চেয়ে বেশি হলে রিফান্ড দাবি করার অনুমতি দেয়। তবে বাস্তবে প্রক্রিয়াটি ব্যবহারকারী-বান্ধব নয়। ব্যক্তিদের প্রথমে একটি বার্ষিক ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হয়, সহায়ক নথি (যেমন ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং টিআইএন সার্টিফিকেট) সংযুক্ত করতে হবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে রিফান্ডের জন্য আবেদন করতে হবে। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা যা প্রায়শই কয়েক মাস।

প্রতীকী ছবি

অনেক নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই আমলাতান্ত্রিক বাধা শুধু প্রচেষ্টার মূল্য দেয় না এবং তারা তাদের রিফান্ড দাবি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিরা জানেন না তারা রিফান্ডের জন্যও যোগ্য। ফলাফল হলো সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কর আদায় করে যাদের প্রথমে কর পরিশোধ করা উচিত ছিল না। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্তরা এমন অর্থ হারায় যা প্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি কেবল একটি অন্যায্য কর ব্যবস্থা তৈরি করে না বরং ব্যক্তিদের আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করে।

বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয় যারা টিডিএসকে কর আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, বরং অনেক দেশেই নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য আরও দক্ষ ব্যবস্থা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে কোনো ব্যক্তি যদি তার আয় করযোগ্য সীমার নিচে বলে আশা করে তবে তিনি অগ্রিম টিডিএস অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। এটি অপ্রয়োজনীয় কর্তন সম্পূর্ণরূপে রোধ করে। মালয়েশিয়ায় ক্ষুদ্র আয়ের ব্যক্তিদের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেরত দেওয়া হয়, যাতে তাদের অতিরিক্ত কাগজপত্রের জন্য বাড়তি সময় ব্যয় করতে না হয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ এমন কোনো পূর্ব-অব্যাহতি ব্যবস্থা প্রদান করে না, যার ফলে নিম্ন আয়ের পেশাদাররা একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ ফেরত ব্যবস্থার বেড়াজালে পড়ে। এটি কেবল একটি নীতিগত ব্যবধান নয় - এটি ন্যায্যতার একটি মৌলিক বিষয়। ব্যবস্থাটি ধরে নেওয়া উচিত নয় যে পরামর্শদাতা বা ফ্রিল্যান্স আয় উপার্জনকারী প্রত্যেকেই করযোগ্য সীমার উপরে। পরিবর্তে, যারা কর দেন না তাদের অগ্রিম পরিশোধ করতে বাধ্য করা হবে না তা নিশ্চিত করার জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত।

এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের টিডিএস ফেরত প্রক্রিয়া সংস্কার করা উচিত এবং ন্যায্য কর নিশ্চিত করার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা চালু করা উচিত। প্রথমত, সরকারের উচিত সাড়ে তিন লাখ টাকার কম আয়কারী ব্যক্তিদের জন্য একটি টিডিএস অব্যাহতিপত্র প্রদান চালু করা। এনবিআর কর্তৃক জারি করা এই অব্যাহতিপত্র যোগ্য করদাতাদের নিয়োগকর্তা বা ক্লায়েন্টদের কাছে এটি জমা দেওয়ার সুযোগ করে দেবে, যার ফলে উৎসে অপ্রয়োজনীয় কর্তন রোধ করা হবে।

দ্বিতীয়ত, একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফেরত প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত যেখানে অতিরিক্ত টিডিএস করদাতাদের কাছে জমা দেওয়া হয়, কোনো কাগজপত্র ছাড়াই। এটি প্রশাসনিক বোঝা কমাবে এবং কর প্রদানে উৎসাহিত করবে।

তৃতীয়ত, করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেক ব্যক্তি ফেরতের বিষয়ে অবগত নন। এনবিআরের উচিত করদাতাদের তাদের অধিকার এবং ফেরত প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রচারণা শুরু করা, যাতে আরও বেশি লোক তাদের ন্যায্য আয় পুনরুদ্ধার করতে পারে।

পরিশেষে সরকারের উচিত বাধ্যতামূলকভাবে আইনত সর্বোচ্চ ফেরত সময়সীমা নির্ধারণ করা, যেমন ৩০ দিনের মধ্যে ফেরত প্রক্রিয়াকরণ। বর্তমানে দীর্ঘ এবং অনিশ্চিত অপেক্ষাকাল করদাতাদের রিফান্ড দাবি করতে নিরুৎসাহিত করে, যা তাদের আর্থিক অসুবিধার মধ্যে ফেলে। এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ন্যায্য এবং আরও দক্ষ করব্যবস্থা তৈরি করতে পারে যা নিম্ন আয়ের উপার্জনকারীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় বোঝা চাপিয়ে দেবে না।

মো. মমিনুর রহমান ও তাসনিম ইসলাম দ্যুতি

কর আরোপের লক্ষ্য হওয়া উচিত ন্যায্যতা এবং অর্থনৈতিক দক্ষতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের বর্তমান টিডিএস ব্যবস্থা কর ফাঁকি রোধে কার্যকর হলেও অনিচ্ছাকৃতভাবে নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের তাদের অর্থ আটকে রেখে এবং ফেরত দাবি করা কঠিন করে শাস্তি দেয়। সরকারকে অবশ্যই তার পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং এমন নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে যা ক্ষুদ্র আয়ের ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনীয় আর্থিক চাপ ছাড়াই তাদের ন্যায্য সম্পত্তি রাখতে দেয়।

একটি ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থা সেই ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ নেয় না যাদের কর দেওয়া উচিত নয়। এটি নিশ্চিত করে প্রতিটি নাগরিকের কর প্রদানের ক্ষমতা অনুসারে কর ধার্য করা হয়।

যদি বাংলাদেশ সত্যিই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার লক্ষ্য রাখে, তাহলে টিডিএস ফেরত ব্যবস্থা সংস্কার একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে। কর ব্যবস্থা ন্যায্য ও স্বচ্ছ হওয়া উচিত; যারা ইতিমধ্যেই বেঁচে থাকতে সংগ্রাম করছে তাদের জন্য কষ্টের উৎস হওয়া উচিত নয়। 

মো. মমিনুর রহমান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের সহকারী অধ্যাপক এবং বিআইজিএম জার্নাল অব পলিসি অ্যানালাইসিসের সহযোগী সম্পাদক।  email: [email protected]

তাসনিম ইসলাম দ্যুতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন)। email: [email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত