বায়েজিদ বোস্তামির মাজারেই বসবাস চল্লিশ বছরের ভবঘুরে আবু সুফিয়ানের। এলাকার আশেপাশে ঘুরে খুঁজে যা পায় তাই দিয়ে দিন চলে। কিন্তু রোজা চলে আসায় বন্ধ হয়েছে তার খাবার। সঙ্গে চিন্তিত ছিলো ইফতার করা নিয়ে। এসব সংশয়ের মধ্যে খোঁজ পায় এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন ফুটপাতে রোজার প্রথম থেকে প্রতিদিন কোনো এক প্রতিষ্ঠান ইফতারে ভালো খাবার দিচ্ছে। সে খবরে আবু সুফিয়ানসহ আরও কয়েকজন গিয়ে দেখেন ইফতারের বিশাল আয়োজন। শত শত দিন মজুর, শ্রমিক, এতিম, রিকশাচালক, ভবঘুরে এখানে সারিবদ্ধভাবে বসে অপেক্ষা করছেন ইফতারের।
দেশ রূপান্তরকে আবু সুফিয়ান বলেন, শুনেছি এখানে ভালো কাজের বিনিময়ে ইফতার করানো হয়। তাই ইফতার করার জন্য এখানে এসেছি। সঙ্গে আরও কয়েকজন এসেছে বলেও জানান।
সুফিয়ান বলেন, ‘গতকালও এখানে ইফতার করেছি। তাদের এই আয়োজন আমাদের মত দরিদ্রদের জন্য অনেক উপকারে আসছে। ইফতার করতে এসে কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। লাইন ধরে বসার পর আয়োজকরা হাতে হাতে ইফতারি তুলে দেন।’
শুধু আবু সুফিয়ান নয় নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৫০০ ভাসমান নারী পুরুষ এখানে প্রতিদিন আসছেন ইফতার করতে। যেখানে প্রতিদিন ছিন্নমূল মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করে আসছে ‘ভালো কাজের হোটেল’। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় সেখানে দেখা যায়, ফুটপাতে লাইন ধরে বসে আছেন দুইশ থেকে তিনশ শিশু, নারী-পুরুষ।
সেখানেই কথা হয় রিকশাচালক কল্লোলের সঙ্গে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, থাকি বহদ্দারহাটে। সারাদিন রোজা রেখেই চেষ্টা করি রিকশা চালিয়ে পরিবারের জন্য হালাল উপার্জন করতে। কিন্তু দেখা যায় কাজে কাজে ইফতারের সময় হয়ে গেলে বাসায় আর যেতে পারি না। আর বাসায় গেলে পরিবার ভালো-মন্দ খেতে চায়। সামর্থ্যে কুলোয় না। তাই এখানে চলে আসি ইফতার করতে। প্রথম কয়েকদিন তাদের চকবাজার শাখায় ইফতার করেছি। এখন এখানে করি। মানসম্মত খাবার দেয়ায় ইফতারটা একদম পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
এখানে ইফতার করতে হলে একটি ভালো কাজ করতে হয়, এটি জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ইফতার করার জন্য একটি ভালো কাজ করতে হয়, সেটি আমি জানতাম না। ইফতার করতে এসে জেনেছি।’
ইয়ুথ ফর বাংলাদেশের একটি উদ্যোগ হলো ‘ভালো কাজের হোটেল’। একটি ভালো কাজের বিনিময়ে এক বেলা খাবার সরবরাহ করে সংগঠনটি। তারই অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম নগরীর এমএ আজিজ স্টেডিয়াম গেট সংলগ্ন ফুটপাতে দীর্ঘদিন ধরে সপ্তাহে একদিন খাবারের আয়োজন করে আসছে সংগঠনটি। রমজান শুরু হওয়ায় এখন সেখানে প্রতিদিন ‘ভালো কাজের ইফতার’ আয়োজন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, রমজানের প্রথম দিন থেকেই এখানে ইফতারের আয়োজন হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ জনকে এখানে ইফতার করানো হয়। ছোলা, মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজুর পরিবর্তে তারা ইফতার করান মুরগি-পোলাও অথবা বিরিয়ানি দিয়ে। সঙ্গে থাকে এক গ্লাস শরবত ও খেজুর।
রবিবার ইফতারের আগে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারের জন্য প্যাকেট ভর্তি মুরগি-পোলাও সেখানে নিয়ে এসেছেন আয়োজকরা। ইফতারের জন্য শরবত তৈরি করছেন ১০-১২ জন স্বেচ্ছাসেবক। পাশেই ফুটপাতে লাইন ধরে বসে আছেন আড়াইশ থেকে তিনশ শিশু, নারী-পুরুষ। ইফতারের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, লাইনে ততই মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে।
ইফতার করতে আসা ১২ বছরের সকিনা বলেন, আগে আমার আব্বা আসতো এখানে। আব্বার কাজ কর্ম নাই তাই আমরা চাইলেও ইফতারে ভালো কিছু খেতে পারি না। তাই আব্বা আমাদের দুই ভাই বোনকে এখানে নিয়ে আসেন। আমরা শুধু ইফতার করে চলে যাই তাই না। আমরা এখানে সারাদিন কি কি ভালো কাজ করলাম সেগুলো আলোচনা করি। আজ কী ভালো কাজ করেছ? জানতে চাইলে সকিনা বলে, আমি এক মুরব্বিকে রাস্তা পার করতে সহযোগিতা করেছি।
ইফতার আয়োজনের তদারকির দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ বলেন, ‘ভালো কাজের হোটেলের উদ্যোগে প্রতিদিন চট্টগ্রামে মোট ৭০০ জনকে ইফতার করানো হচ্ছে। এর মধ্যে এখানে( স্টেডিয়াম সংলগ্ন ফুটপাত) ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ জনকে ইফতার করানো হয়। বাকি ১৫০ থেকে ২০০ জনের ইফতার আয়োজন করা হয় চট্টগ্রাম কলেজের সামনে।’
গত দিনে ইফতার আইটেমে কী ছিল জানতে চাইলে মোহাম্মদ বলেন, প্রথম রমজানে আমরা চিকেন বিরিয়ানি দিয়ে ইফতার করিয়েছিলাম। পরদিন রবিবার মুরগি আর খিচুড়ি, আর আজ মুরগি পোলাও দিয়ে ইফতার করানো হচ্ছে। আমাদের বাবুর্চি আছেন তার নেতৃত্বে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা সকাল থেকে ইফতার প্রস্তুতের কাজ শুরু করেন। বাইরে রান্না করার পর সেগুলো প্যাকেট ভর্তি করে আমরা বিকাল ৪টার দিকে এখানে নিয়ে আসি। এরপর ইফতারের সময় আমরা সেগুলো উপস্থিত ছিন্নমূল মানুষদের হাতে তুলে দিচ্ছি।