পবিত্র ঈদুল ফিতর সমাগত। ময়মনসিংহ বিভাগসহ উত্তরের জেলারগুলোর অনেকেই ইতিমধ্যে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট করে ফেলেছেন। ঈদে বাড়িতে ফিরে পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে কীভাবে সময় কাটাবেন অনেকে তার পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছেন। কিন্তু তাদের সে স্বপ্নে ভোগান্তির কারণ হতে পারে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক। ওই সড়ককে যানজট থেকে মুক্তি দিতে প্রায় একযুগ আগে যে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল সেটি এবারও ভয়ংকর ভোগান্তির কারণ হতে পারে। অবশ্য ইতিমধ্যে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশ।
এক যুগ ধরে ওই ১২ কিলোমিটার সড়কে মানুষ প্রতিনিয়ত অসহনীয় যানজটে পড়ে নাকাল হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে বিআরটি প্রকল্প চালু হওয়ার পরেও স্বস্তি মেলেনি। এবারের ঈদযাত্রায়ও ময়মনসিংহ বিভাগসহ উত্তরের জেলারগুলোর বেশিরভাগ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হতে পারে গাজীপুরের ওই ১২ কিলোমিটার সড়ক। এবার ঢাকার আশুলিয়ার সড়কটি খানাখন্দ থাকায় যাত্রী ও পরিবহনের চাপ গাজীপুর অংশ দিয়ে (ওই ১২ কি.মি.) বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে গন্তব্যে যেতে পারেন সেজন্য জেলা ও মহানগর পুলিশ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
পুলিশ বলছে, বিআরটি প্রকল্পের কারণে ওই ১২ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থান সংকুচিত হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকার উত্তরা থেকে টঙ্গী কলেজ গেট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার পথে রয়েছে উড়াল সড়ক। এর মধ্যে একটি লুপ টঙ্গী স্টেশন রোড, অন্যটি চেরাগ আলী এলাকায় নেমেছে। রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিআরটি সড়ক দিয়ে যাত্রীবাহী বাসসহ বিভিন্ন পরিবহন চলাচল করে। বিআরটি সড়ক দিয়ে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ ভারী যানবাহন চলাচল নিষেধ থাকলেও তা না মেনে দেদার চলছে এসব পরিবহন। তবে মাঝেমধ্যে টঙ্গী ও বড়বাড়ি এলাকায় এসব পরিবহনকে বিআরটি রোড থেকে বের করে দিতে দেখা যায় পুলিশকে। বিআরটি অংশে প্রায় সময়ই দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।
বিআরটি সড়কে কোনো যানবাহন বিকল হয়ে পড়লে বিপত্তির আর শেষ থাকে না। কারণ, বিআরটি সড়কে কোনো যানবাহন প্রবেশ করলে সেটিকে ডান বা বাম দিকে কোনো সড়কেই বের করার কোনো সুযোগ নেই। অথবা বিকল গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে আসার মতো কোনো জায়গা নেই। এতে ওই সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
এ উড়াল সড়ক হয়েই ঢাকা থেকে সব যানবাহন টঙ্গী গাজীপুর হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৩৭টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রায় একই সময়ে যাত্রীরা বাসা থেকে বের হন। আর অগণিত যানবাহন ও যাত্রীদের চাপে সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আর দেখা দেয় পরিবহন সংকট। পরিবহন সংকটের কারণে যাত্রীরা ট্রাক, পিকআপসহ অন্যান্য বিকল্প যানবাহনে করে ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেয়।
যাত্রীদের সড়ক পারাপারের জন্য বিআরটির নির্মাণাধীন ওভারব্রিজগুলোর একটিও চালু হয়নি। ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ যত্রতত্র দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়। এতে যেমন ঘটে দুর্ঘটনা তেমনি যানবাহনের গতি কমে সৃষ্টি হয় যানজটের।
গাজীপুরের ভিআইপি পরিবহনের চালক নাজমুল হোসেন বলেন, বিআরটি প্রকল্প আমাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। কখন কোন স্থানে যানজট লেগে যায় তা বলা যায় না। একটি বাস স্টপেজে থামলে পেছনে যানজট লেগে যায়। ঈদের সময় যাত্রী ওঠাতে-নামাতে বিভিন্ন স্টপেজে বাস থামাতে হবে, এতে সৃষ্টি হবে তীব্র যানজটের।
বোর্ডবাজার এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল বলেন, সড়কের কোথাও কোনো যাত্রী ছাউনি নেই। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করে। অপরিকল্পিত বিআরটি প্রকল্প এখন গাজীপুরবাসীর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ১২ বছর ধরে যে প্রকল্প কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। এখন ভবিষ্যতে এটি আর কোনো উপকারে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। গাজীপুরের যানজটের মূল কারণ বিআরটি প্রকল্প।
এবারের ঈদে ঘরমুখো মানুষের জন্য গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চন্দ্রা ত্রিমোড় একটি টার্নিং পয়েন্ট। প্রতি বছর চন্দ্রাতে ঈদে ঘরমুখো লাখ লাখ মানুষের ভিড় জমে থাকে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। এতে জনজট ও যানজটের কারণে ওই এলাকায় যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তবে প্রতি বছরের মতো এবারও জেলা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ যানজট নিরসনে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
ইতিমধ্যে পূবাইলের মীরের বাজার এলাকায় ভাঙা রাস্তা মেরামত করা হয়েছে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের টঙ্গী ও মীরের বাজার হয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা দিয়ে নরসিংদী হয়ে সিলেটের পথে যেসব যাত্রীবাহী গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল করবে সেসব যানবাহনকে দ্রুত গাজীপুর থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার সব রকম ব্যবস্থা নিয়েছে মহানগর ও জেলা পুলিশ।
গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী মো. যাবের সাদেক জানিয়েছেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে গন্তব্যে যেতে পারেন সেজন্য জেলা পুলিশ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিশেষ করে গণপরিবহনগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হবে। যাত্রী নেওয়ার পর রাস্তায় কোনো যানবাহনকে থামতে দেওয়া হবে না।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) এসএম আশরাফুল আলম বলেছেন, ঢাকা থেকে যেসব যাত্রীবাহী পরিবহন গাজীপুর হয়ে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে সেসব যানবাহনগুলোকে দ্রুত গাজীপুর পার করে দেওয়া হবে। আর সেজন্য দুটি বিআরটি লেন এবং একটি সড়ক লেন ব্যবহার করা হবে। যাতে বেশি সংখ্যক পরিবহন গাজীপুর থেকে বের হতে পারে। এ ছাড়া ঈদের পর যাত্রীরা যখন ঈদ করে কর্মস্থলে ফিরবেন তখনো তিন লেন ব্যবহার করে যানবাহনগুলোকে ঢাকায় প্রবেশ করানো হবে।
তিনি বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করার জন্য বেশ কিছুসংখ্যক ট্রাফিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হবে। তারা যানজট নিরসনে সড়কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে কাজ করবেন।
তবে এবার আশুলিয়া সড়কের অবস্থা খারাপ থাকায় অনেক পরিবহন গাজীপুরের ওপর দিয়ে যাবে, যে কারণে এ সড়কে গতবারের চেয়ে যানবাহনের চাপ বেশি পড়বে। আর সে কারণে যানজট হতে পারে বলেও মনে করেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।