শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ক্ষমতার দাপটে ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে রিসোর্ট

আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৬ পিএম

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া গ্রামে শুরুতে ডেইরি ফার্মের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে স্থানীয়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে এখন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেছে ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার। ডেরা রিসোর্ট ও স্পা সেন্টারের অভ্যন্তরে নারীদের দেহ ব্যবসা ও মাদকের আড্ডার আখড়ায় পরিণত হওয়ার অভিযোগে রিসোর্ট বন্ধের দাবিতে এলাকাবাসী একাধিকবার মানববন্ধন করেছে।

বিনোদনের সব ধরনের ব্যবস্থা থাকায় রিসোর্টটিতে প্রতিদিন দেশ বিদেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ভিড় করেন, খরচ করেন লাখ লাখ টাকা। প্রতি রাতের জন্য রুম ভাড়া ১২ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জাঁকজমকপূর্ণ বিনোদনের সব উপকরণ রিসোর্টটি থাকলেও নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের নবায়নকৃত ছাড়পত্র। রিসোর্টটি সরকারি নিয়ম-কানুন না মেনেই পরিচালিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা থাকলেও ডেরা রিসোর্টে নির্মাণ করা হয়নি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি)। পরিবেশ অধিদপ্তর কারণ দর্শানোর নোটিশ করলেও টনক নড়েনি ডেরা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের। ক্ষমতার দাপটে ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে ডেরা রিসোর্ট।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা (এশিউর ট্যুরিজম লিমিটেড)-কে শর্তসাপেক্ষে ছাড়পত্র প্রদান করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নবায়ন না করেই কার্যক্রম চলমান রাখে ডেরা রিসোর্ট। ছাড়পত্রের তিন নম্বর শর্ত ভঙ্গ করায় ২০২৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কারণ দর্শানোর নোটিশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

চলতি বছরে কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় ‘ফসলি জমি দখল করে ডেরা রিসোর্ট নির্মাণ, বিপাকে কৃষক’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে ডেরা রিসোর্টের তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য পেতে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব জেবুন নাহার স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানান, ডেরা রিসোর্টের বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন তদন্ত করছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পরে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকাশিত প্রতিবেদনের অভিযোগের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট মতামতসহ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হোটেল ও রেস্তোরা সেলে পাঠানোর জন্য চলতি বছরের মার্চ মাসের তিন তারিখে সাত সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহবায়ক, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক/সহকারী পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক/সহকারী পরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শকসহ ছয়জনকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় বালিয়াখোড়া পুরান গ্রামে অত্যাধুনিক অ্যাগ্রো ফার্ম করতে কৃষি জমি দখলে নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই সকল জমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে ডেইরি ফার্ম নির্মাণ করা হয়। পরে ২০২২ সালে ওই ডেইরি ফার্ম এলাকায় এশিউর গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টার নামে পাঁচ তারকামানের রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়। ডেইরি ফার্মের সাইনবোর্ড থাকা অবস্থায় চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে শুরু হয় রিসোর্ট নির্মাণের কাজ। সেসময় বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর সমালোচনার মুখে পড়ে কাজ বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এলাকাবাসীদের দমাতে তাদেরকে মামলায় ফাঁসানো হয়। পরে প্রভাবশালীদের আশকারায় রিসোর্টের কাজ পুরোদমে চালু হয়। দুই বছর কাজ শেষে ২০২২ সালের জুলাই মাসের ৫ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় পাঁচ তারকা মানের এই অবকাশযাপন কেন্দ্রটির।

ডেরা রিসোর্ট ও স্পা সেন্টারের ব্যবস্থাপক ওমর ফারুক বলেন, আমাদের ২০২৫ সাল পর্যন্ত ছাড়পত্র আপডেট করা আছে। আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাচ্ছি। তার পাঠানো ছাড়পত্রটি অনলাইন স্ক্যান করে দেখা যায় ছাড়পত্রটির মেয়াদ ২০২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে কথা বলবেন। তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, এর আগেও প্রশাসন থেকে তদন্ত হয়েছে। সম্প্রতি তদন্ত কমিটি সম্পর্কে তিনি অবগত নন।

মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি উন্নয়ন কমিটির সমন্বয়কারী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, রিসোর্ট শুরু থেকেই কৃষকদের ফাঁদে ফেলে জমি নিয়েছেন। তারা ওই এলাকায় কৃষি জমি ধ্বংস করে রিসোর্ট নির্মাণ করেছেন। রিসোর্টটির পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় আশেপাশের কৃষির উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিনিয়র সহসভাপতি ইকবাল হোসেন কচি, ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করার দায়ে ডেরা রিসোর্টটিকে আইনানুগ ভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত। আর ছাড়পত্র ছাড়া এখন কীভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে সেটি দেখার বিষয়। তদন্ত কমিটি তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশা করি।

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট এ কে এম ছামিউল আলম কুরসি বলেন, ডেরা রিসোর্ট অ্যান্ড স্পাকে পরিবেশ অধিদপ্তর শর্ত সাপেক্ষে ছাড়পত্র প্রদান করেছিলো। কিন্তু ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে রিসোর্ট পরিচালনা করায় তাদের ছাড়পত্র নবায়ন দেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশ করা হয়েছে। প্রয়োজনে পুনরায় নোটিশ প্রদান করে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ডেরা রিসোর্টের অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে অনিয়ম পাওয়া গেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত