শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বিজয়নগরে চলছে টিলা কাটা ও পুকুর-ফসলি জমি ভরাটের মহোৎসব 

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৫, ০২:৪৪ পিএম

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে পুকুর ও ফসলি জমি ভরাটসহ পাহাড় কাটার উৎসব চলছে। উপজেলা পরিষদ থেকে প্রায় ৫০০ মিটারের দূরত্বে মির্জাপুর এলাকার চারদশক পুরনো পুকুরের অস্তিত্ব গত কয়েক মাস আগেও ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই পুকুরের অস্তিত্ব এখন আর নেই। নাকের ডগায় আরও দুটি পুকুর ভরাট চললেও রহস্যজনক কারণে নীরব প্রশাসন। দুই-তিন মাস ধরে কোনো বাধা ছাড়াই অবাধে পাহাড় কাটা, চারটি পুকুর ভরাট ও ছয়টি ফসলিজমি ভরাটের কাজ চলছে, যেন দেখার কেউ নেই।

ভরাটকাজে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, সবাইরে ‘ম্যানেজ’ করেই তারা পুকুরসহ ফসলি জমি ভরাট করছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিজয়নগরের চান্দুরা-আখাউড়া সড়কে ইছাপুরা ইউনিয়নের মির্জাপুর মোড়ে রাস্তা-সংলগ্ন পুকুরটি ৪০-৫০ বছরের পুরনো। পুকুরের পূর্ব দিকের বাসিন্দা জলফু মিয়া, তার ছোট ভাই আজিজুল হক ওরফে মলাই মিয়া, করিম মিয়াসহ কয়েকজন পুকুরটির ৭২ শতকের মালিক। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে পুকুরটি ভরাট করতে পানি সরানো হয়। এরপর গত বছরের জানুয়ারি মাসে জলফু, মলাইসহ পাড়ের বাসিন্দারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাক্টর দিয়ে মাটি এনে ভরাটের কাজ শুরু করেন। পুকুরটি ভরাট করে সেখানে বিপণিবিতান নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, উপজেলার মির্জাপুর মোড়ের পুকুরটি বিজয়নগর উপজেলা পরিষদের ৫০০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত। ইউএনওসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রতিদিন পুকুরের সামনে দিয়ে যাতায়াত করেন। তারা এ বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি। ৫ আগস্টের পর স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাটি ফেলে ধীরে ধীরে পুকুর ভরাট শুরু করেন। সম্প্রতি মাটি ফেলে পুকুর ভরাটের কাজও শেষ হয়েছে। এসব কাজ দিনরাত চললেও শুরু থেকে নীরব প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চান্দুরা-আখাউড়া সড়কের ইছাপুরা ইউনিয়নের মির্জাপুর মোড়ের দক্ষিণদিকে রাস্তার পূর্বদিকে কাসেম মিয়া ও সিফত আলী মাস্টারের দুটি পুকুর রয়েছে। ওই দুটি পুকুর বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। প্রায় অর্ধেক ভরাট হয়েছে। এই দুটি পুকুরের অবস্থানও উপজেলা পরিষদ থেকে ৫০০ মিটারের ভেতরে। উপজেলার সাটিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার দক্ষিণ-পূর্বদিকের একটি পুকুর ও পাহাড়পুর ইউনিয়নের আউলিয়া বাজারের পশ্চিমদিকে দুটি পুকুর রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিপণিবিতান নির্মাণ করে ওই পুকুরগুলো ভরাট করে ফেলেছেন। এসব এলাকার পুকুর ভরাটসহ ট্রাক্টরে মাটি ফেলে ফসলি জমির ভরাটের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মির্জাপুর গ্রামের কাইয়ুম মিয়া। এসব কাজ তদারকি করছেন তার ছেলে আবদুল রাজ্জাক ওরফে মুন্না। উপজেলায় গত কয়েক বছর ধরে ফসলি জমির মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কাইয়ুম।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এ বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

অন্যদিকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের (২০১০ সালে সংশোধিত) ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।’

জানতে চাইলে কাইয়ুম মিয়া বলেন, আপনি সাংবাদিক হলেই ছবি তুলবেন কেন। আপনি মাটি কাটা ও পুকুর ভরাটের ছবি তুলবেন কেন। অন্য কারো তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। উপজেলা প্রশাসনও কিছু বলছে না।

উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কালাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে দক্ষিণদিকে একটি টিলা (পাহাড়ের মতো উঁচু) জমি রয়েছে। সাবেক ইউপি সদস্য হারিজ মিয়া ও তার ছেলে সোলমান মিয়া ভেকু দিয়ে টিলা মাটি কেটে ট্রাক্টরে নিয়ে ডোবায় ফেলে ভরাট করছেন। স্থানীয়রা সব দেখেও নীরব রয়েছেন।

উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য হারিজ মিয়া বলেন, বসতি নির্মাণ করতে  পাহাড় কাটছি। পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে একটি ডোবা ভরাট করছি। হরষপুর গ্রামের মুজিবুর রহমান ট্রাক্টর ও ভেকু ভাড়া দিয়েছেন। ট্রাক ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ও ভেকু ঘণ্টায় ২ হাজার ২০০ টাকা। তিনি পাহাড়টির মালিক বলে দাবি করেন।

ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আবদুল ওহাব বলেন, ইউনিয়নে পাহাড় শ্রেণি ভূমি নেই, টিলা শ্রেণির জমি রয়েছে। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও উঁচু বা টিলা শ্রেণির জমি কাটতে পারবে না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

স্থানীয় লোকজন জানান, উপজেলার মির্জাপুরের রাস্তার পশ্চিমদিকে আম্বালা ফাউন্ডেশনের পাশের উত্তরদিকের ব্যক্তি মালিকানাধীন ফসলিজমি মাটি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। উপজেলা পরিষদের পশ্চিমদিকের সামনের সড়ক সংলগ্ন প্রায় তিন একর ফসলি জমি মাটি দিয়ে করা হয়েছে। হরষপুর ইউনিয়নের নিধারাবাদ দক্ষিণপাড়ায় ফসলি মাটি কেটে অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করছেন সাবেক ইউপি সদস্য নাসির মিয়া। পাহাড়পুর ইউনিয়নের তোফায়েল নগর বাজারের উত্তর রেললাইনে সেতু সংলগ্ন ফসলি জমি রাতের আঁধারে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ কর্মী রুহুল আমিন ও মিজানুর রহমান। একই ইউনিয়নের খাটিঙ্গা গ্রামের জমিরাবাড়ি এলাকার ফসলি জমি রাতের আঁধারে মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করছেন এলাকার প্রভাবশালী রাশেদ খান ও স্বপন খন্দকার। এদিকে চান্দুরা ইউনিয়ন পরিষদের উত্তরদিকে থাকা ফসলি জমিতেও মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে।

একাধিকবার চেষ্টা করেও মুঠোফোন না ধরায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জিয়াউল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মুন্সী আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে বুধন্তি ইউনিয়নের সোনাই নদীর পাড়ের মাটি প্রতিনিয়ত কেটে নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মুন্সী আসাদুজ্জামান মাটি কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার কালাছড়া গ্রামের পাহাড় কাটার কাজ চলছে। উপজেলা মডেল মসিজেদের সামনে ফসলি জমি, মির্জাপুর মোড়ের দক্ষিণ দিকে দুটি পুকুর, একই এলাকার সামনে সড়কের পশ্চিমদিকের ফসলি জমি, চান্দুরা ইউনিয়ন পরিষদের উত্তরদিকের ফসলি জমি মাটি বালু-মাটি দিয়ে ভরাটের কাজ চলছে। আর মির্জাপুর মোড়ের উত্তরদিকের চারশতক পুরনো পুকুর ভরাটের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এই পুকুরের ছবি তুললে গেলে পুকুর মালিক ও তাদের লোকজন তেড়ে এসে খারাপ আচরণ করেন। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা পুকুর ভরাট করেছেন বলে জানান।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাধনা ত্রিপুরা বলেন, খবর পাবার সাথে সাথে অভিযানে যাই। পুকুরের বিষয়টি মাত্র জানলাম। খোঁজ নিব। বেশির ভাগ মাটির কাটার কাজ রাতে চলে। পদে পদে তাদের লোক থাকে। আমার পৌঁছার আগেই তারা সংবাদ পেয়ে যান। আমি শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারি। কিন্তু পরিবেশ বা কৃষি বিভাগ নিয়মিত মামলা দিতে পারেন। তারা এগিয়ে আসলে আশা করি এই সমস্যাগুলোর একটি সমাধান হবে। উপজেলায় আমিই ইউএনও, এসিল্যান্ড ও প্রশাসক। যে কারণে অভিযানটা ভালো করে করতে পারছি না।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, বিজয়নগরে প্রতিটা ঘরে ঘরে এই সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিনই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলছে। উপজেলায় আমার ম্যাজিস্ট্রেট আছে মাত্র একজন, এসিল্যান্ড নেই। ব্যাপক হারে লোকজন উঠে পড়ে লাগছে। পরিবেশ থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পদায়ন হয়েছে। সমস্যাগুলো সমাধানে অভিযান চালানো হবে। 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত