তারা দুজন চিকিৎসক দম্পতি। উভয়েই পড়তেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। একজন ডা. সেখ বনি আমীন, অন্যজন ডা. আখতার বানু। সেখ বনি আমীনের জন্ম ১৯৩৫ সালে। বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার সাতসৈয়া গ্রামে। আর আখতার বানু জন্ম নেন ১৯৪১ সালে পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদের জলঙ্গী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ভারত ভাগের সময় পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু উভয়েই যখন পড়াশোনা করছেন, তখনই প্রণয় থেকে পরিণয়। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পড়াকালে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬২ সালে। কিন্তু সেখ বনি আমীন ছাত্রজীবন শেষ করেছিলেন ১৯৬৫ সালে। আর আখতার বানু ১৯৬৬ সালে। এরপর শুরু হয় জীবন সংগ্রাম।
এর মধ্যে চলে আসে আমাদের অস্তিত্বের একাত্তর। কিন্তু দুজন সিদ্ধান্ত নেন, মুক্তিযুদ্ধে যাবেন। এমন সিদ্ধান্ত নেন তখন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন পাক সেনারা কুষ্টিয়া শহরে কারফিউ জারি করে। এরপর শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। দুজনই তখন কুষ্টিয়ায়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন একই চেম্বারে। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ কারফিউ একটু শিথিল হলে, ছোট ছোট সন্তান নিয়ে পা বাড়ান ভারতের উদ্দেশে। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে, ১৪ এপ্রিল পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত পার হয়ে পৌঁছে যান সাদীখান দেয়ারে। সেখান থেকে শরণার্থী শিবিরে। তখন শরণার্থীদের মধ্যে মহামারী আকারে দেখা দেয় কলেরা। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় উভয়েই শরণার্থীদের দেওয়া শুরু করেন চিকিৎসাসেবা। সেই সংবাদ যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন প্রবাসী সরকার তাদের কলকাতায় ডেকে পাঠান। ৬ মে বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক কর্তৃক উভয়েই চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন সাদীখান দেয়ার হাসপাতালে। চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন, শরণার্থী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের। এভাবে চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস। দেশ স্বাধীনের পর তারা চলে আসেন কুষ্টিয়ায়। বিমর্ষ চিত্তে তখন দেখেন, তাদের বাড়িঘর, চেম্বারের কোনো কিছু অবশিষ্ট নেই। সবকিছুই তখন ধ্বংসস্তূপ। তারপরও তারা থামেননি।
১৯৭৩ সালে নিজ গ্রাম সাতসৈয়ায় ডা. সেখ বনি গড়ে তোলেন মরহুম পিতার নামে হাজি আবদুল হামিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এরপর ২০০৫ সালে পৈতৃক ভিটায় স্ত্রীর নামে স্থাপন করেন ‘মুক্তিযোদ্ধা ডা. আখতার বানু মাতৃসদন’। আবার ২০০৭ সালে ডা. আখতার বানু স্বামী ডা. সেখ বনি আমীনের নামে গড়ে তোলেন ‘মুক্তিযোদ্ধা ডা. সেখ বনি আমীন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়’। যতদিন বেঁচে ছিলেন, দুজনই অধিকাংশ সময় গ্রামেই থাকতেন। না হলে কোনো বছর অস্ট্রেলিয়া অথবা আমেরিকায় ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। এই দম্পতির ৩ মেয়ে আর ২ ছেলে। মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি বছরের বড় একটি সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটাতেন। বাকি সময় থাকতেন দেশে। ২০১০ সালের ১১ মে যখন ডা. আখতার বানু রতœগর্ভা হিসেবে পদক পান, তখন ঢাকার শেরাটন হোটেলে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন ‘সময় কেটে যাচ্ছে, সময়ের গতিতে। মানুষের জন্য কতটুকু কী করতে পেরেছি জানি না, তবে মানুষকে ভালোবাসতে জানি।’ আবার মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা ২০ হাজার টাকা করায় ডা. বনি আমীন সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘সম্মানী ভাতা বাবদ পাওয়া টাকার পুরোটাই প্রতিবেশী গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে আসছি।’ অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘যুদ্ধের পর যখন দেশে ফিরে আসি, তখন বিধ্বস্ত ক্লিনিক পুনর্নির্মাণ করি এবং চিকিৎসা পেশায় মনোনিবেশ করেছিলাম। সৌদি আরবে কিছু চিকিৎসক নেওয়া হবে শুনে ১৮৪ জনের সঙ্গে আমরা দুজনও ইন্টারভিউতে অংশ নিই। বাছাইকৃত ১৮ জনের আমরাও ছিলাম। টানা ১৩ বছরের মতো সৌদি আরবে কাজ করেছি। এরপর বাংলাদেশে ফিরে আরও কিছুদিন চিকিৎসাসেবায় ছিলাম।’ ১৯৯৪ সালে এ দম্পতি স্থায়ীভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে অবসর নেন।
যতদিন বেঁচে ছিলেন, দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনসহ যাবতীয় অর্থ সহায়তা দিয়েছেন এই দম্পতি। গ্রামে ১০ শয্যার একটি শিশু ও মাতৃসদন হাসপাতালকে ৮০ শতাংশ জমিও দান করেছেন তারা। এছাড়াও গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুদান দিয়েছেন। ২ পুত্র ৩ কন্যার সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র সানি, জ্যেষ্ঠ কন্যা জুডি ও মেজ কন্যা এ্যানি বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। নাজমা ও টনি থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। রয়েছে ৮ নাতি এবং এক নাতনি। অর্থাৎ বিশ্বের দুই প্রান্তে পুত্র-কন্যারা বাস করায় এক অর্থে তারা ছিলেন বিশ্বনাগরিক। মুক্তিযোদ্ধা এ চিকিৎসক দম্পতির প্রচুর সম্পদ রয়েছে।
অন্যের সমালোচনার বদলে দেশের জন্য নিজের করণীয় এবং দায়িত্ব পালনের ব্যাপারটি প্রত্যেকের বিবেচনায় রাখা দরকার বলে উল্লেখ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বনি আমীন এবং আখতার বানু। দেশকে ভালোবেসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন এই দম্পতি। কোনো ধরনের লোভ তাদের আচ্ছন্ন করেনি। জীবনে কখনো অন্যকে প্রতারণা করার কথা ভাবতেও পারেননি। এমন চরিত্রের মানুষ যেন বর্তমানে প্রায় হারিয়ে গেছেন। হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। কিন্তু তাদেরকে কর্ম-বিশ্বাস এবং মঙ্গল ভালোবাসাই বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ তারা নেই। তবে ভালোবাসার এক অদ্ভুত সুন্দর আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন সমাজে। মানবসেবায় তাদের যে অনিন্দ্য সুন্দর চাওয়া ছিল, তা কতটুকু পূরণ হয়েছে- কে জানে? কিন্তু এটা ঠিক, সত্য-সুন্দর-কল্যাণের মৃত্যু নেই। তারা আছেন আমাদের হৃদয়ে পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার গভীর স্পর্শে।
লেখক : সাংবাদিক