জুলাই-আগস্টে গণহত্যাসহ মানবতবিরোধী অপরাধের মামলায় গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২৪ জুন প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অন্যদিকে জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুমের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে ২৪ জুন প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন ট্রাইব্যুনাল। পৃথক মামলায় প্রসিকিউশনের পৃথক আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে রবিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন বিচারকের ট্রাইব্যুনাল এসব আদেশ দেন।
এদিন আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের হাতকড়া পড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে আনার ঘটনার বিষয়টি শুনানিতে উঠে আসে। এসময় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এ নিয়ে কিছুটা উত্তাপ ছড়ায় ট্রাইব্যুনালে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রবিবার যাদের হাজির করা হয় তারা হলেন— সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, শাহজাহান খান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, শাজাহান খান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান মোহাম্মদ সেলিম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম ও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান।
হাতকড়া পরানো নিয়ে শুনানিতে যা হলো
শুনানির আগে শাহজাহান খানকে যখন কাঠগড়ায় হাজির করা হয় তখন তিনি হাতকড়া পরানো হাত উঁচিয়ে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে ফারুক খানের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান তার মক্কেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য একটি আবেদন জমা দেন। একই সঙ্গে আসামিদের হাতকড়া পরানো নিয়ে আপত্তি তুলে তিনি ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কখন আসামিকে হাতকড়া পরানো যাবে, কখন নয় সে বিষয়ে কারাবিধির সংশ্লিষ্ট বিধান উল্লেখ করেন তিনি।
এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখানে তো আসামিদের হ্যান্ডকাফ পরানোর প্র্যাক্টিস ছিল না। পড়ানো হলো কেন?’ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান দায়িত্বরত পুলিশদের ডায়াসের সামনে আসতে বলেন।
এসময় নুরুন্নবী ও শহীদুল নামে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ডায়াসের সামনে যান। আদালতের প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা শহীদুল বলেন, কারাগার থেকে তাদের হাতকড়া পরিয়ে আনা হয়েছে। পুলিশের সদরদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে, হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, পরিয়ে আসামিদের আনার জন্য।
ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেন, ‘এখানে কেন আপনারা হ্যান্ডকাফ পরালেন?’ এসময় শাহজাহান খান ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলে চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘আপনার কথা পরে শুনবো।’
পুলিশ কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘উনারা (আসামি) গাড়ি থেকে নামার পর হ্যান্ডকাফ পরানো হয়েছে।’ এ সময় আসামিদের কয়েকজন একসঙ্গে চিৎকার করে বলেন, ‘এটা মিথ্যা, প্রিজন ভ্যানেই হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়েছে।’
একজন পুলিশ কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, ‘আসামিদের কেউ কেউ আমাদের হুমকি দিয়েছেন। আমাদের দেখে নেবে বলেছেন।’ এ সময় কাঠগড়া থেকে ‘মিথ্যা’, ‘মিথ্যা’ বলে সমস্বরে চিৎকার করেন আসামিদের কয়েকজন।
একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘জেল অথরিটি (কারা কর্তৃপক্ষ) তাদের (আসমিদের) যেভাবে পাঠিয়েছে সেভাবেই আনা হয়েছে। প্রিজন ভ্যানের ভেতরে হ্যান্ডকাফ পরানোর অভিযোগ সঠিক নয়। তাদের গাড়ি থেকে নামানোর পর হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। আসামি জিয়াউল আহসান হেলমেট ছুঁড়ে ফেলেছেন। আসামিদের এ ধরণের আচরণ ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো ভয় দেখানোর চেষ্টা।’
এসময় ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা নিজের চোখে দেখেছি কাঠগড়ায় হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আনা হয়েছে।’ জবাবে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা হয়তো এখানে আসার সময় খুলতে একটু দেরি হয়েছে।’
একপর্যায়ে কাঠগড়ায় থাকা শাহজাহান খান ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে বলেন, যে কথাগুলো বলা (পুলিশ) হয়েছে সেগুলো সত্য নয়। গাড়ি থেকে (প্রিজন ভ্যান) বের করার সময় আমাদের হ্যান্ডকাফ ছিল। হ্যান্ডকাফ ধরে নামানো হয়েছে। আমি শাহজাহান খান। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার পরিবারের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। এখানে আমির হোসেন আমু আছেন। তার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমার সবাই বাংলাদেশে থাকি। আমরা আপনাদের মর্যাদা দেখতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিফ প্রসিকিউটর বার বার বলছেন ‘সাবেক আওয়ামী লীগ’। কিন্তু আওয়ামী লীগতো কোনো নিষিদ্ধ দল নয়।’
এসময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আপনি এখানে কোনো পলিটিক্যাল বক্তব্য দেবেন না। আপনার মন্ত্রী ছিলেন, নেতা ছিলেন ভালো কথা। পুলিশ কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু আপনারা দায়িত্বশীল ব্যক্তি। আমরা আশা করবো আপনারাও আচরণ ভালো করবেন।’
ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা তো নিষেধ করে দিয়েছি, এখানে কাউকে হ্যান্ডকাফ পরানো যাবে না। আপনারাও কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না। শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন।’
একপর্যায়ে সাবেকে আইনমন্ত্রী উঠে দাড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, কারাগারে তাদের ট্রাইব্যুনালে মামলা সংক্রান্ত কোনো নথি দেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের আদেশ চান তিনি। তবে, চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ওনাদের বিষয়ে অভিযোগ কি সেবিষয়ে নথি দেওয়া হয়েছে। আর তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল না হওয়া পর্যন্ত মামলার কোনো নথিপত্র সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
একপর্যায়ে হাসানুল হক ইনু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আদালত আদেশ দিলে তারা আমাদের মামলার নথিপত্র দিতে বাধ্য। জেল কর্তৃপক্ষ দিতে বাধ্য। এটা একজন আসামির অধিকার।’ একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আপনারা এখন পর্যন্ত মামলার সংক্রান্ত নথিপত্র পেয়েছেন কি না তা আমরা দেখবো।’
শেখ হাসিনার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলে দুই মাস সময়
গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় দুই মাস বেড়েছে। আগামী ২৪ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলে সময় নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে এ মামলায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকেও এ মামলায় আসামি করা হয়। তাকে রবিবার ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়।
কাদেরসহ ৪৫ জনের তদন্ত প্রতিবেদন ২০ জুলাইয়ের মধ্যে
জুলাই-আগস্টে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য ও আমলাসহ ৪৫ জনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের সময় বাড়িয়েছে ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত প্রতিবেদন আগামী ২০ জুলাইয়ের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গুমের মামলায় প্রতিবেদন দাখিলে দুই মাস সময়
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জোরপূর্বক গুমের অভিযোগের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে দুই মাস সময় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আগামী ২৪ জুন প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১১ জন আসামি। মামলার অন্যতম আসামি সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে রবিবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।