বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

দুবাইয়ের ‘কালো বিড়াল’ মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারে

  • ১২ লাখ শ্রমিকের যাত্রা অনিশ্চিত
  • বাংলাদেশ বছরে রাজস্ব হারাবে ৫ বিলিয়ন ডলার 
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২১ পিএম

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার ধ্বংস করার জন্য আবারও অপতৎপরতা শুরু করেছে শক্তিশালী একটি চক্র। আগামী ২১-২২ মে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্পর্কিত তৃতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার আগে এই চক্রটি নানান অপতৎপরতা শুরু করেছে। এতে মালয়েশিয়ায় আগামী ৬ বছরে প্রায় ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারেও তারা নানা অপতৎপরতা পরিচালনা করছেন। এতে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন রাজস্ব হারাবে এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

জনশক্তি রপ্তানি খাতের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিখাতকে ধ্বংস করার মিশনে নেমেছেন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) কিছু বহিষ্কৃত নেতা। তারা সৌদি আরবের পর বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়াকে ঘিরে দেশের ভিতরে বিভিন্ন প্রকার নেতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছে। ওইসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ মালয়েশিয়া কর্মী গ্রহণকারী দেশ হওয়ায় সেদেশে সরকার সমালোচনার মধ্যে পড়লে বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য দেশ হতে কর্মী নিয়োগ করতে পারে। এতে বাংলাদেশী কর্মীদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী জানান, যাদের অপতৎপরতায় শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের অন্যতম হচ্ছে বায়রার সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন ধামাসী কর্পোরেশনের নোমান চৌধুরী। এই চক্রটি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করছে। তারা মূলত বিতর্কিত সাবেক এমপি ফেনীর নিজাম হাজারীর প্রেসক্রিপশনে চলছেন। তার সঙ্গে আছেন একই জেলার আলাউদ্দিন নাসিম ও আবুল বাশার।

তারা আরও বলেন, মালয়েশিয়া যখন বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ কর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে তখন নানা অবান্তর শর্ত, মিথ্যাচার আর সংবাদ সম্মেলন করে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে দুই দেশের কূটনীতিক সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলা তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

জানা গেছে, জনশক্তি রপ্তানি খাতে জালিয়াতির অভিযোগে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স হিউম্যান রিসোর্স ডেভলপমেন্টর বিভিন্ন নথিপত্র তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানটির কাছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মী প্রেরণের বহির্গমন ছাড়পত্র দেওয়ার মূলকপি ও সত্যায়িত কপি চেয়েছে দুদক। এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমিক প্রেরণে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও দূতাবাসের সত্যায়ণকৃত ডিমান্ড নোটের অপব্যবহার করায় এক বছরের জন্য কালোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে হিউম্যান রিসোর্স ডেভলপমেন্টকে। প্রতিষ্ঠানটির সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার করেছেন। নিজের মেডিকেল সেন্টারে প্রায় ৭০ হাজার কর্মীর মেডিকেল চেকআপ করে হাতিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। কিছুদিন আগে রাজধানীর পল্টন থানায় তার বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন অপর একজন ব্যবসায়ী।

জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের এআএল-৪৫২। বারিধারা জে ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ১০ বাড়িতে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের মালিক ফ্যাসিবাদী সরকারের একজন দোসর। তিনিসহ আরও কয়েকজন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর দেশের জনশক্তি রপ্তানিখাতকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে আসছেন। তার ধারাবাহিকতায় ফখরুল ইসলাম গত ৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ান তিন ব্যক্তিকে গোপনে বাংলাদেশে আনেন। তাদের গোপনে মালয়েশীয় সরকারি প্রতিনিধি সাজিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেন। ওই বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নানা অপতৎপরতা চালান। 

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ফখরুলকে সিন্ডিকেটের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করে একটি অভিযোগ জমা হয়েছে। ওই অভিযোগে বলা হয়, পতিত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বাণিজ্যে ১০ সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ছিলেন ফখরুল ইসলাম। মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাণিজ্যের জন্য বাগিয়ে নিয়েছেন নিজের মেডিক্যাল সেন্টার ওয়েলকাম মেডিক্যাল। প্রায় ৭০ হাজার কর্মীর নামমাত্র স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। পরে তিনি পরিচয় লুকিয়ে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন। তার কমপক্ষে দুটি লাইসেন্স রয়েছে ১০১ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায়। সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকাতেও রয়েছে তার এজেন্সি ও ওয়েলকাম মেডিক্যাল সেন্টার।

১০১ সিন্ডিকেটভুক্ত ফখরুল ইসলামের বেনামী প্রতিষ্ঠান ছিল ত্রিবেনি ইন্টারন্যাশনাল ও সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠান দুটির মালিকানায় অন্য ব্যক্তির নাম থাকলেও যার নেপথ্য মালিক ও অংশীদার ফখরুল ইসলাম। তিনি নিজের লাইসেন্স সরাসরি ব্যবহার না করে অন্যের নামে ব্যবসা করছেন। অন্য যারা ব্যবসা করেন তাদের লাইসেন্স ছিল একটি। আর ফখরুল ব্যবসা করেছেন দুই লাইসেন্সে। তাছাড়া অন্য ব্যবসায়ীরা মূল ১০১ এজেন্সির মধ্যে অথবা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে ছিলেন। আবার অনেকে ছিলেন শুধু মেডিক্যাল সেন্টার ব্যবসায়। কিন্তু ফখরুলই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সব জায়গায় আছেন এবং ব্যবসা করেছেন। 

গত বছরের ৩১ মে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর ফখরুল ইসলামসহ কয়েকজন মিলে ভিন্ন কৌশলে সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করেন। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাশীল একটি রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতার সঙ্গে তাদের কয়েকজনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ভাইরাল হয়েছে। মালয়েশিয়ার একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মোটা অংকের অর্থ স্পন্সর করার সূত্রে দাওয়াত পান ফখরুল ও তার সহযোগীরা। শুধু তাই নয়, দেখা করেছিলেন মালয়েশিয়ার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। সেখানকার কর্মকর্তারা তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়ায় দেশে ফিরে নিজেকে বঞ্চিত দাবি করে শুরু করেছেন নানা অপতৎপরতা।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী জানান, ফখরুল এখন বায়রার সভাপতি হওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের অনুকম্পা পেতে সিন্ডিকেট বিরোধী কথা বলছেন। অথচ তিনি সব সময়ই সিন্ডিকেটের অংশ ছিলেন এবং নিজেও সিন্ডিকেট করেছেন। ফখরুলের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন টক শো, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে শ্রমবাজার ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তার বক্তব্যগুলো তার অনুসারীরা মালয়েশিয়াতে ছড়িয়ে দেয়ায় সম্ভাব্য নিয়োগকর্তারা বাংলাদেশী শ্রমিক বিমুখ হচ্ছে।

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাতকারে ফখরুল ইসলাম স্ববিরোধী বক্তব্য দেন। তিনি সেখানে মালয়েশিয়ায় পুরনো সিন্ডিকেট তৈরির কথা বলেন। তার দাবি, ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এফডব্লিউসিএমএস) বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশে কার্যকর করতে পারেননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিষয়টি মিথ্যাচার। 

এফডব্লিউসিএমএস মালয়েশিয়ার জনশক্তি আমদানি বিষয়ক সফটওয়্যার। সব সোর্স কান্ট্রি থেকে তারা শ্রমিক নিয়ে থাকেন। ফখরুলের দাবি এফডব্লিউসিএমএস দুই দেশের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছে। যা নিলর্জ্জ মিথ্যাচার। ফখরুল বলেন, অনেকে ভিসা নিয়ে এসেছেন, আমি নিজেও ভিসা এনেছি। সেটা অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে পাঠাতে হয়েছে।

দুদকের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, জনশক্তি রপ্তানি খাতে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ফখরুল বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বারিধারা জে ব্লকের ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর প্লটে করেছেন ১০ তলা ভবন। এই ভবনে তার হিউম্যান রিসোর্স ও ওয়েলকাম মেডিকেল সেন্টারের কার্যালয়। এছাড়া নামে বেনামে রয়েছে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট। ব্যাংকে রয়েছে বিপুল পরিমাণ স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি। গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁঞার ওমরপুরে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ক্রয় করেছেন তিনি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ফকরুল সাংবাদিকদের বলেন, আমি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কথা বলি। এজন্য আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)-এর মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, বায়রার নেতা পরিচয় দিয়ে ফখরুল ইসলাম ও তার সহযোগী নোমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা বিভিন্নস্থানে মিথ্যা তথ্য সম্বলিত স্মারকলিপিসহ অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে। তাদের মূল লক্ষ্য শ্রমবাজার তথা দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত