বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

গাইবান্ধায় অরকা-হোমস

রানা প্লাজা ধসে মা-বাবা হারানো শিশুরা বেড়ে উঠছে মাতৃস্নেহে

আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৭ এএম

সিরাজগঞ্জের দক্ষিণ নলসন্ধা গ্রামের ১৩ বছরের মরিয়ম আকতার। বাবা থেকেও নেই। তার মা স্বপ্না বেগম পোশাকশ্রমিক ছিলেন। তিনি রানা প্লাজা ধসে মারা যান। মাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে মরিয়ম। কিন্তু অরকা-হোমস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বাবা-মার মত স্নেহ ভালবাসায় বেড়ে উঠছে মরিয়ম আকতার। সে এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। মরিয়ম আকতার জানায়, প্রায় আট বছর থেকে এখানে আছি। এখানে বাবা-মার মত আদর পাচ্ছি। ভাল আছি। লেখাপড়া করছি।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কাচাবাড়ি গ্রামের রিকতা (১৬) ও মুক্তার (১৪) আপন দুই বোন। তাদের জীবন কাহিনী ঠিক মরিয়মের মতই। তাদের বাবা নেই। মা মমতা বেগম রানা প্লাজায় পোশাকশ্রমিকের চাকরি করতেন। তার উপার্জনে সংসার চলতো। রানা প্লাজা ধসে মমতা বেগমের দুই পা ও এক হাত অচল হয়েছে। শুরু হয় তাদের জীবনের কালো অধ্যায়। কিন্তু অরকা হোমসে রিকতা আকতার ও মুক্তা আকতার আনন্দে দিন কাটছে। তারা জানায়, আমরা এখন ১১ বছর থেকে দুই বোন থাকছি। লেখাপড়া করছি। ভাল পরিবেশে থাকছি।

মরিয়ম, রিকতা ও মুক্তির মত মা দুলালি বেগমকে হারিয়েছে গাইবান্ধা সদর উপজেলার ধানঘড়া গ্রামের আলিফ হাসান। ষষ্ট শ্রেণির ছাত্র আলিফ জানায়, ১২ বছর ধরে অরকা-হোমসে ভালই আছি। মায়ের মত ভালবাসা পাচ্ছি। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করতে পারছি। ভাল পরিবেশে বসবাস করছি। খাবারও উন্নত।

তাদের মত তাহমিনা আক্তার বিথী (১৪)। বাবা-মাকে হারিয়ে ঠাই হয় এখানে। বিথী জানায়, মা রওশন আরা বেগম রানা প্লাজা ধসে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। চার বছর বয়সে এখানে আছি। বেশ ভালো আছি।

শুধু বিথী, রিকতা ও মুক্তি, আলিফ হাসান, আলিফ হাসানই নয়। তাদের মত রানা প্লাজার ভবন ধসে বাবা-মা হারিয়েছে বিভিন্ন জেলার এমন ৪৪ জন শিশু আরকা হোমসে মাতৃস্নেহে বেড়ে উঠছে। তাদের লেখাপড়াসহ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছে অরকা-হোমস (ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন) নামে গাইবান্ধার এই প্রতিষ্ঠানটি। বিজিএমইএ’র সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটি শিশুদের লেখাপড়া ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

গাইবান্ধার অরকা-হোমস্ কার্যালয় সুত্র জানায়, ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে অরকা-হোমস গড়ে উঠে। প্রায় ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়। এখানে উন্নত পরিবেশে ৪৪ জন শিশু বসবাস করছে। এরমধ্যে ২৩ জন ছেলে ও ২১ জন মেয়ে। এসব শিশু অরকা হোমস সংলগ্ন হোসেনপুর মুসলিম একাডেমিতে প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।

গাইবান্ধা থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে অরকা-হোমস। বুধবার বিকেলে (২৩ এপ্রিল) সরেজমিন অরকা হোমস ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকৃতিঘেরা পরিবেশে শোভা পাচ্ছে তিনতলা বিশিষ্ট ভবন। সু-দৃশ্য প্রধানফটক পেরিয়ে খেলার মাঠ। তারপর অরকা হোমস। পাশেই হোসেনপুর মুসলিম একাডেমি পাঠশালা। মাঠে শিশু ছেলেমেয়েরা আনন্দ-উল্লাস করে খেলাধুলা করছে। ভবনের ভিতরে টাইলস লাগানো কক্ষ, উন্নত শয্যা ও টয়লেট ব্যবস্থা। পৃথক খাবার ব্যবস্থা। নিচতলায় রয়েছে লাইব্রেরি ও বিনোদন ব্যবস্থা। না দেখলে বিশ্বাস হবে না বাবা-মা হারানো অসহায় শিশুরা কত ভাল পরিবেশে থাকে। তিনতলা ভবনে ছেলেরা এবং পাশে দ্বিতল ভবনে মেয়ে শিশুরা থাকে। কাছে যেতেই এগিয়ে এসে কথা বলছে শিশুরা। তাদের দেখভাল করছেন দুই ব্যক্তি।

কেমন আছো তো্মরা জানতে চাইলে জামালপুর জেলার বোয়ালমুই পাড়ার হাসান শেখ (১৪) জানায়, এক যুগ আগে মা কল্পনা বেগমকে হারিয়ে এখানে নয় বছর থেকে আছি। পড়ালেখা করছি। এখানে ভালো আছি। বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। অরকা হোমস আমার থাকা খাওয়া ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা একে অন্যের ভাই। পাশে থাকা ফারুক জানায়, আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দিবো। আমরা ভাল আছি। তাদের মত প্রায় সবাই ভাল থাকার কথা জানায়।

অরকা হোমস এর তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, সাতজন কর্মকর্তা কর্মচারি শিশুদের তদারকি করছে। এখানে বসবাসকারি শিশুদের লেখাপড়া শেষ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। শিশুরা যেন বাবা-মার মত স্নেহ পায় সেজন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত