দেশের সামগ্রিক বন্দর ও লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনার মধ্যে আগামী অর্ধদশকের মধ্যে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসছে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর, বে-টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনালের মতো কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রকল্প। বর্ধিত কলেবরের সেই পরিবর্তিত বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রধান বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর তখনো সন্দেহাতীতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষজ্ঞ অভিমত অনুযায়ী অধিক জল-গভীরতার (ড্রাফট) কারণে মাতারবাড়ী বন্দর, বে-টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনালে দীর্ঘতর কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। তবু চট্টগ্রাম বন্দরের জিসিবি, সিসিটি ও এনসিটি টার্মিনালগুলোতেও যে জাহাজগুলো বর্তমানে ভিড়ছে, সেগুলোরও চট্টগ্রাম বন্দরে আসা-যাওয়া বজায় রাখা দেশের রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যের স্বার্থেই অত্যাবশ্যক হবে।
বাস্তবায়নাধীন ও পরিকল্পনাধীন যেসব বন্দর বা টার্মিনালের ওপর দেশের বৃহত্তর আকারের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের চলাচল নির্ভরশীল হবে, সেসব বন্দর বা টার্মিনালের নিজেদের মধ্যেও কনটেইনার পরিবহনের যোগাযোগব্যবস্থা এসব প্রকল্পকে পুরোপুরি উপযোগী করার ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে। এ ক্ষেত্রে যাতে চট্টগ্রাম বন্দর, বে-টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনালের সঙ্গে প্রায় ১০৪ কিলোমিটার দূরবর্তী মাতারবাড়ী বন্দরের মধ্যে নৌপথে কনটেইনার পরিবহন যাতে ত্বরিত, নিরবচ্ছিন্ন ও ব্যয়সাশ্রয়ী হয়, সেই বিষয়টা এখন থেকেই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করে তা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মাতারবাড়ী বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করার একটি প্রধানতম শর্ত হলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যকার মহাসড়কের আমূল উন্নয়ন। চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ীর মধ্যকার মহাসড়ক ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ লেনে উন্নীত করতে হবে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর ও পারিপাশির্^ক টার্মিনালগুলোর মধ্যে কনটেইনার পরিবহনের জন্য সড়কের পাশাপাশি নৌপথকেও ব্যবহারোপযোগী করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল, বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী বন্দর এই বন্দর ও লজিস্টিকস বেল্টের সহযোগী হিসেবে প্রয়োজন হবে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো বা আইসিডি। রপ্তানি ও আমদানি পণ্যের সুষ্ঠু, ত্বরিত ও নিরবচ্ছিন্ন ব্যবস্থাপনার জন্য আইসিডি অপরিহার্য। নতুন আইসিডি নির্মাণের জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপারে দক্ষিণ চট্টগ্রাম উপযোগী এলাকা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এসব স্থানে আইসিডি নির্মিত হলে তা কর্ণফুলী টানেলের মাধ্যমে একদিকে যেমন চট্টগ্রাম বন্দর, বে-টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনালের সঙ্গে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, অন্যদিকে তেমনি মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গেও অপারেশন পরিচালনা করা সহজতর হবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার খুলে আমদানি পণ্য ট্রাকে/কাভার্ড ভ্যানে লোডিং করার যে অপারেশন কার্যক্রম, তা থেকে যত দ্রুত সম্ভব চট্টগ্রাম বন্দরকে সরে আসতে হবে এবং ভবিষ্যৎ সামগ্রিক বন্দর ব্যবস্থাপনায়ও এই অপারেশন কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি আইসিডিগুলোকে দিতে হবে। যাতে সব বন্দর, টার্মিনাল তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতায় কাজ করতে পারে।
ভবিষ্যতে বন্দর ও লজিস্টিক অবকাঠামোর পরিচালন কার্যক্রমে বর্তমান সময়ের মতোই বেসরকারি আইসিডিগুলো সন্দেহাতীতভাবে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করবে। বিগত ১৪ বছরের পরিসংখ্যান বিচার করলে ২০২৪ সালের রপ্তানি পণ্যের ভলিউম ২০১০ সালের রপ্তানি পণ্যের প্রায় ২ দশমিক ২ গুণ। আগামী বছরগুলোতেও রপ্তানির ক্ষেত্রে এই আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি দেশের আপামর অর্থনীতির খাতিরেই বজায় রাখতে হবে। একইভাবে বাড়ছে আমদানি বাণিজ্যের আকার। সুতরাং আধুনিক ও গতিশীল বন্দর ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বেসরকারি আইসিডি খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ, সরবরাহ শিকল ব্যবস্থাপনায় বর্ধিত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বাড়তি চাপ সামলাতে প্রয়োজন হবে নতুন আইসিডি। এ ক্ষেত্রে আইসিডি নির্মাণের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ-উৎসাহী সংস্কার করা প্রয়োজন। সব ধরনের আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরিয়ে আইসিডি থেকে খালাসের সর্বাত্মক অনুমোদন দেওয়া হলে এই খাতে নতুন আইসিডি স্থাপিত হবে, যা রপ্তানি পণ্য মজুদ ও হ্যান্ডলিংকে সহজ ও দ্রুত করবে। পক্ষান্তরে বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার জট, যানজট ও লোকের ভিড় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে বন্দর ব্যবস্থাপনাকে কাক্সিক্ষত একটি নতুন, আধুনিক, গতিশীল পর্যায়ে উন্নীত করবে।
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন