ভারত শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের পর পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটির উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত ও সার্ক ভিসা স্কিম বাতিলসহ ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে কড়া পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে নয়াদিল্লি। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় এয়ারলাইনসগুলোর জন্য আকাশসীমা বন্ধসহ একগুচ্ছ পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। একই সঙ্গে সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্তও প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামাবাদ।
পেহেলগামে হামলার পেছনে
পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত। ইতিমধ্যে এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটি পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রক্সি শাখা। ধারণা করা হয়, টিআরএফ-এর পেছনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সমর্থন আছে।
পেহেলগামে হামলার ঘটনার পর গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে ভারতের নিরাপত্তাবিষয়ক সর্বোচ্চ কমিটি- কেবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস) বৈঠকে বসে। দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। ওই বৈঠকের পর জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত ও সার্ক ভিসা স্কিম বাতিলসহ পাঁচটি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং পাকাপাকিভাবে সীমান্ত সন্ত্রাসের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার না করবে, ততক্ষণ এই চুক্তি স্থগিতই থাকবে।’
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সই করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। এ চুক্তির আওতায় সিন্ধু, চন্দ্রভাগা, শতদ্রু, ঝিলাম, ইরাবতী ও বিপাশা নদীর পানি পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়। এই গ্রীষ্মকালে চুক্তিটি স্থগিত করার অর্থ চুক্তি অনুযায়ী পর্যাপ্ত পানি পাকিস্তান পাবে না।
নয়াদিল্লির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া। বুধবার থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থলসীমান্ত বন্ধ হয়ে গেছে। ওই সীমান্ত দিয়ে যারা ভারতে এসেছেন, তাদের সবাইকে ১ মের মধ্যে ফিরে যেতে হবে। সেই সঙ্গে সার্ক ভিসা স্কিমের অধীনেও পাকিস্তানিদের ভিসা দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি। ইতিমধ্যে যে পাকিস্তানি নাগরিকদের ওই ভিসা দেওয়া হয়েছে, তা বাতিল করা হয়েছে। আর ওই বিশেষ ভিসা নিয়ে এরই মধ্যে যেসব পাকিস্তানের নাগরিকরা ভারতে রয়েছেন, তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দিল্লিতে পাকিস্তানি দূতাবাসে সেদেশের প্রতিরক্ষা, সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর যে ‘পরামর্শদাতারা’ রয়েছেন, তাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ বা অবাঞ্ছিত বলে ঘোষণা করছে ভারত। তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। পাশাপাশি ইসলামাবাদের ভারতীয় দূতাবাস থেকে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর পরামর্শদাতাদের ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে দিল্লি। অন্য সিদ্ধান্তটি হলো দুই দেশের হাইকমিশনগুলোতে কর্মরত কর্মকর্তাদের সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে। এসব বিষয়ে অবগত করতে ভারতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। এ ছাড়া পাকিস্তান সরকারের অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে প্রবেশাধিকার স্থগিত করেছে ভারত।
এদিকে, ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে দিল্লির গুচ্ছ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটির (এনএসসি) জরুরি বৈঠক ডাকেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় এয়ারলাইনসগুলোর জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তান। একই সঙ্গে সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তানের বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যেকোনো হুমকির জবাব কঠোরভাবে ও সমানতালে দেওয়া হবে। এ ছাড়া এতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, পাকিস্তানের ন্যায্য পানি সরবরাহ বন্ধ বা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে তা যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। বুধবার রাতে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ মন্ত্রী আওয়াইজ লেখারি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, বেপরোয়াভাবে ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত পানি যুদ্ধের শামিল। এটি একটি কাপুরুষোচিত ও অবৈধ পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে বৃহস্পতিবার ভারতকে কড়া হুঁশিয়ারিও দিয়েছে পাকিস্তান। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এই জবাব কম হবে না। পাকিস্তানের একটি বেসরকারি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভারতের ঘোষণাগুলো শিশুসুলভ এবং এতে গুরুত্বের অভাব রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারত প্রতিটি ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং অতীতের মতো এবারও পাকিস্তানকে দোষারোপ করার চেষ্টা করছে। তবে আমরাও বসে থাকব না, বরং ভারতকে এর যোগ্য জবাব দেব।
অন্যদিকে, পেহেলগামে হামলাকারীদের সন্ধানে জম্মু ও কাশ্মীরে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। সে অভিযানে উধামপুর জেলায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপন সূত্রের ভিত্তিতে দুদু-বসন্তগড় এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গেলে ওই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জম্মু ও কাশ্মীরভিত্তিক বিশেষ দল দ্য হোয়াইট নাইট কর্পস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছে, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের সঙ্গে যৌথ অভিযান শুরু হয়। সংঘর্ষের সময় এক সাহসী সেনা গুরুতর আহত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এ ছাড়া ভারতীয় পুলিশের তরফে হামলাকারী তিন সন্দেহভাজন জঙ্গির নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তারা জানায়, এদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানি। তবে দিল্লি এ নিয়ে কোনো প্রমাণ প্রকাশ করেনি কিংবা বিস্তারিত তথ্য দেয়নি।