কাশ্মীরের পেহেলগামে জঙ্গি হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। এ ঘটনায় সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি। এমনকি পাকিস্তানকে এক ফোঁটা পানিও দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী সিআর পাতিল। তবে একতরফাভাবে পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করলে সিন্ধুতে ভারতীয়দের রক্তের স্রোত বইবে বলে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। ফলে দুই দেশের মধ্যকার তিক্ততার পারদ প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
এদিকে, দ্বিতীয়বারের মতো শুক্রবার দিবাগত রাতে নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতে ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। পর্যটনকেন্দ্র পেহেলগামে হামলার পর জঙ্গিদের খোঁজে কাশ্মীরের আবাসিক অঞ্চলে সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি বন-জঙ্গলেও অভিযান শুরু করেছেন ভারতের আর্মড পুলিশ ও সেনা সদস্যরা। বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে শুক্রবার কাশ্মীর সফর করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান। কাশ্মীর জুড়ে পাঁচ সন্দেহভাজনের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানায়, শুক্রবার সিন্ধু প্রদেশের সুক্কুর জেলায় পিপিপির এক সমাবেশে সিন্ধু চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে ঝাঁজালো ভাষণ দেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল।
তিনি বলেন, ভারত সিন্ধু নদ ডাকাতির চেষ্টা করছে। সিন্ধু সভ্যতার প্রকৃত উত্তরাধিকারীরা পাকিস্তানে বাস করেন। সিন্ধু সভ্যতার বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে পাকিস্তান কখনই নদীর ওপর তার দাবি ত্যাগ করবে না।
পেহেলগাম হামলার পর সিন্ধু পানিচুক্তি থেকে ভারত একতরফা সরে আসার প্রতিক্রিয়ায় বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সভ্যতার উত্তরাধিকার লাভের জন্য চিৎকার করলেও প্রকৃত রক্ষকরা পাকিস্তানের মাটিতেই আছেন। সিন্ধু আমাদের এবং এটি আমাদেরই থাকবে।
এ সময় ভারতকে সতর্ক করে তিনি বলেন, হয় পানি, না হয় তোমাদের রক্ত এই নদীতেই প্রবাহিত হবে। বিলাওয়াল অভিযোগ করেন, ভারত সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত অবৈধভাবে সেই চুক্তি বাতিল করছে।
শুক্রবার দিল্লিতে এক বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, জলশক্তিমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত রঘুনাথ পাতিল ও বিদ্যুৎমন্ত্রী মনোহর লালের কাছে চুক্তি স্থগিতের পর সিন্দু নদীর পানির ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরেন দেশটির কর্মকর্তারা। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কীভাবে সিন্ধু অববাহিকার পানি ব্যবহার করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন উপস্থাপনা তুলে ধরেন তারা।
বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে ভারতীয় জলশক্তিমন্ত্রী সি আর পাতিল বলেন, সিন্ধু নদীর এক ফোঁটাও পানি পাকিস্তানে যেতে দেওয়া হবে না।
পোস্টে তিনি আরও বলেন, সিন্ধু পানিচুক্তি নিয়ে মোদি সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক ও জাতীয় স্বার্থে। সিন্ধুর এক ফোঁটা পানিও যেন পাকিস্তানে না যায় সেটি আমরা নিশ্চিত করব।
পেহেলগামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তে অংশ নিতে পাকিস্তান প্রস্তুত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। শনিবার পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে এক প্যারেড অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
শাহবাজ শরিফ বলেন, ভারত কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত বা যাচাই প্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা অভিযোগ করেছে। পাকিস্তান যে কোনো পক্ষপাতহীন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে অংশ নিতে প্রস্তুত। একই কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খাজা আসিফ বলেন, পাকিস্তান যেকোনো আন্তর্জাতিক তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। সাক্ষাৎকারে এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
তার অভিযোগ, ভারত এ হামলাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে আইডব্লিউটি চুক্তি স্থগিত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায় তারা।
এদিকে, জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে জঙ্গি হামলার জেরে উত্তেজনার মধ্যে নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে ফের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাতে কাশ্মীর ও লাদাখ সীমান্তে এই গোলাগুলি ঘটে বলে এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নিয়ন্ত্রণরেখার (এলওসি) বিভিন্ন পয়েন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর সেনাচৌকি থেকে উসকানিমূলকভাবে হালকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালানো হয়। জবাবে ভারতীয় বাহিনীও পাল্টা গুলি ছোড়ে।
অন্যদিকে, বৈসরণে হামলার পাঁচ দিন পেরোলেও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। তবে কাশ্মীর জুড়ে পাঁচ সন্দেহভাজনের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী।
এনডিটিভি জানিয়েছে, শোপিয়ান, কুলগাম ও পুলওয়ামা জেলায় অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। গত কয়েক দিনে সন্দেহভাজনদের ওপর দমন অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। শোপিয়ানের চোপোটিপোরা গ্রামে শাহিদ আহমেদ কুত্তের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে লস্কর কমান্ডার বলে দাবি করছে ভারত।
কুলগামের মাতালম এলাকায় আরেক সন্দেহভাজন জাহিদ আহমেদের বাড়িও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলওয়ামার মুররান এলাকায় বিস্ফোরক পেতে আহসান উল হক নামে একজনের বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের দাবি, আহসান ২০১৮ সালে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং সম্প্রতি উপত্যকায় ফিরে আসেন।
এর আগে আরও দুই সন্দেহভাজনের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। গত মঙ্গলবার পেহেলগামে গুলি করে ২৬ জন পর্যটককে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়েবা এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।