ক্রমশ বেড়েই চলেছে চিরবৈরী দুই দেশ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান উত্তেজনা। জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে দুই দেশের টানাপড়েন চরমে পৌঁছেছে। টানা চতুর্থবারের মতো গত রবিবার রাতেও নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) গুলি বিনিময় হয়েছে পাকিস্তান-ভারতের সেনাদের মধ্যে। পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই আফগানিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে ভারত। কাবুলে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেছেন
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রতিনিধি আনন্দ প্রকাশ। এদিকে, লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইসলামাবাদ। আর এ হামলার জন্য ভারত দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার। সেই সঙ্গে ভারতের যেকোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপের জবাব ভয়াবহভাবে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছেন পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আব্বাসি। প্রতিবেশী এ দুই দেশের চলমান পরিস্থিতির দিকে নজর রাখার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চলমান সংকট থেকে উত্তরণে দায়িত্বশীল সমাধানের জন্য কাজ করতে উভয়পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীও।
গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে ভারতের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, রবিবার রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুপওয়ারা এবং পুঞ্চ জেলায় অবস্থিত নিয়ন্ত্রণরেখায় গুলিবর্ষণ করে। এর জবাবে ভারতীয় সেনারা দ্রুত ও কার্যকর জবাব দেয়। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এনডিটিভি বলছে, এ নিয়ে পরপর চার রাত এলওসিতে গোলাগুলির ঘটনা ঘটল। পেহেলগামে হামলার ঘটনায় লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে প্রবাসী ভারতীয়রা। বিক্ষোভের একপর্যায়ে পাকিস্তান দূতাবাসে হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ইসলামাবাদ। আর এ হামলার জন্য ভারতকে দায়ী করেছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার। তিনি বলেন, লন্ডনে আমাদের হাইকমিশনে দুবার হামলা হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এ হামলার জন্য ভারত দায়ী। ভারত তার চরমপন্থি মতাদর্শ ব্যবহার করে পাকিস্তানের বিদেশি মিশনগুলোতে আক্রমণ করার জন্য নিজ দেশের নাগরিকদের উৎসাহিত করছে। এ সময় কানাডায় শিখ নেতাকে হত্যার প্রসঙ্গ টেনে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেন, আপনি যদি কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিকভাবে মানুষকে হত্যা করতে পারেন, তবে কিছু বিদেশি মিশনে আক্রমণ করা আপনার কাছে কিছুই না। জিও নিউজ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা হাইকমিশনের বিল্ডিংয়ের কাচ ভেঙে ফেলেছে। এরপর এর ভেতর দিয়ে জাফরান রঙ নিক্ষেপ করেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় মেট্রোপলিটন পুলিশ এরই মধ্যে দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে নয়াদিল্লি। রবিবার ভারতের নৌবাহিনী এ পরীক্ষা চালায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে নৌবাহিনীর দেওয়া এক পোস্টে বলা হয়, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সফলভাবে জাহাজ বিধ্বংসী বিভিন্ন ধরনের মহড়া চালানো হয়েছে। তারা বলছে, এর মধ্য দিয়ে প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম ও ক্রুদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর প্রস্তুতি যাচাই করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরীক্ষা চালানো ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শক্তিশালী, দূরপাল্লার এবং উচ্চ-নির্ভুলতাসম্পন্ন হামলার উপযোগী করে তৈরি করা। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের প্রস্তুতি যাচাই করার ওপর জোর দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করছে ভারত। সম্প্রতি বৈঠক করেছেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই বৈঠক। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান বিভাগের মহাপরিচালক এবং বিশেষ প্রতিনিধি আনন্দ প্রকাশ আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকি এ বৈঠকে অংশ নেন।
ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, সাক্ষাৎকালে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য ও ট্রানজিট সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাম্প্রতিক আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ বৃদ্ধি, প্রতিনিধি দলের আদান-প্রদান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
এদিকে ভারত পাকিস্তানে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আব্বাসি। শনিবার দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের ১৩০টিরও বেশি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র এমনি এমনি সাজিয়ে রাখা হয়নি; এগুলো ভারতের উদ্দেশেই সংরক্ষিত। ভারতীয় গণমাধ্যমের বরাতে এ খবর জানিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান। বক্তব্যে আব্বাসি বলেন, এসব ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই তোমাদের (ভারতের) দিকে তাক করা আছে। আব্বাসির এমন মন্তব্য দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, পেহেলগামে হামলার পর থেকে একের পর এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। এ বিষয়ে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনকে সতর্ক করেছে কাশ্মীরের সব রাজনৈতিক দল। উপত্যকার রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই অবশ্যই জারি রাখতে হবে, কিন্তু ভুল পদক্ষেপ ঠিক নয়। তাতে হিতে বিপরীত হবে। এমন কিছু করা ঠিক নয়, যা মানুষকে নতুনভাবে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। এ অভিযানে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের ডজনখানেক ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাঙার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বুলডোজার। কোথাও নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণও ঘটানো হয়েছে।
দুই দেশের এ উত্তেজনাময় পরিস্থিতির দিকে নজর রাখার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সংকট সমাধানে উভয় দেশকে দায়িত্বশীল সমাধানের পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, এটি একটি চলমান পরিস্থিতি এবং তারা নিবিড়ভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা একাধিক স্তরে ভারত ও পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে নজর রাখছে চীনও। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারকে এ কথা বলেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন, যুক্তরাজ্য ও ইরানের নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাদা করে এরই মধ্যে কথা বলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার। ফোনালাপে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভিত্তিহীন প্রচার ও একতরফা নানা পদক্ষেপের বিশেষ করে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিতের বিষয়ে নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সময় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবিচল প্রচেষ্টায় চীনের অটল সমর্থন থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী।