রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস

সরকারি চিকিৎসা নামে মাত্র

আপডেট : ০৮ মে ২০২৫, ১২:২৮ এএম

দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগপ্রতিরোধে সরকারি কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকারি হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চলছে নামমাত্র চিকিৎসা। হাতেগোনা কিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগের অধীনে এই চিকিৎসা চললেও রোগীদের জন্য নেই আলাদা শয্যা ও বিভাগ। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে পারছে রোগীরা। কিন্তু নিয়মিত ওষুধ পাচ্ছে না। আবার যে সব হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগ নেই, সেখানে এই রোগীরা যেতেই পারছে না। আর উপজেলা পর্যায়ে রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থাও নেই।  

ফলে বাধ্য হয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। এসব হাসপাতালে মাসে এক ব্যাগ রক্ত লাগে এমন একজন রোগীর চিকিৎসা নিতে মাসে ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার টাকা। এই ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে এসব রোগী নিয়মিত চিকিৎসা নিতে পারছে না। অনেক পরিবার মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছে।

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন, থ্যালাসেমিয়া সমিতি ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসার এই চিত্র পাওয়া গেছে। 

এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতির উপদেষ্টা ডা. এম এ খান (মহিউদ্দিন আহমেদ খান) দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসায় সরকারের কোনো পলিসি নেই। অথচ চাইলেই সরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা দেওয়া যেতে পারে। এটা বড় ধরনের কোনো সার্জারি না। সাধারণ চিকিৎসা। থ্যালাসেমিয়ার জন্য একটি আলাদা ডেডিকেটেড হাসপাতাল দরকার। যেখানে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সব ধরনের চিকিৎসা এবং বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন হবে। 

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এটা প্রতিরোধ করতে সরকারকে একটি পলিসি তৈরির জন্য বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি। যাতে এই বাহকগুলো শনাক্ত করা যায়। একজন বাহক আরেকজন বাহককে বিয়ে না করে, বিয়ের আগে ক্যারিয়ার পরীক্ষা করে, পেটে বাচ্চা আসার পর পেটের বাচ্চা রোগী কি না, সে জন্য প্রিম্যাটার ডায়াগনসিস করা এগুলো ফলো করা গেলে, আমাদের দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগী অনেক কমে আসবে। 

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের কনসালট্যান্ট ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, রোগীর মা-বাবাকে অসম্ভব ধৈর্যশীল হতে হবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটা কোনো পাপের ফল না। এটা ক্যানসার না ও ভবিষ্যতে এই রোগ ক্যানসারে রূপ নেওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। তারা যেন সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে, সে জন্য সবার সহযোগিতা করতে হবে। 

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, মূল লক্ষ্য কোনো পরিবারে যেন একটি থ্যালাসেমিয়া শিশু জন্মগ্রহণ না করে। এ ব্যাপারে বাবা-মা বা নতুন বিয়ে হওয়া দম্পতিকে প্রথম থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিয়ের আগেই তাদের পরীক্ষা করতে হবে যে তারা এই রোগের বাহক কি না। দুজন বাহক হলে সে ক্ষেত্রে ভয়টা বেশি। একজন বাহক ও একজন নরমাল হলে ভয়ের কোনো কারণ নেই।

রোগী বেড়েছে তিনগুণ : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক, যা মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ ২০১৪-১৫ সালে বাহক ছিল ৭ থেকে ৮ শতাংশ, ২০২৩ সালে ছিল ৯ শতাংশ। 

নারী ও পুরুষ বাহকের বিয়ের কারণে তাদের সন্তানরা ২৫ শতাংশ এই রোগ নিয়ে জন্ম নেয়। এর ফলে প্রতিবছর প্রায় ৮ হাজার শিশু রক্তের এই রোগ নিয়ে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে।

থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত সাত বছরে রোগী বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। প্রতিবছর প্রায় ৮ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। বর্তমানে রোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার। 

বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, তাদের প্রতিষ্ঠানে ২০১৮ সালে নিবন্ধিত ছিল রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭২৫ জন। ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৯৮ জন, ২০২০ সালে ৩ হাজার ৪১৬ জন, ২০২১ সালে ৪ হাজার ৯৪১ জন, ২০২২ সালে ৬ হাজার ৫৫ জন, ২০২৩ সালে ছিল ৭ হাজার ২২ জন এবং ২০২৪ সালে  হাজার ৫১১ জন। এখন তাদের নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ১০ জন।

মাসে ব্যয় ১৩ হাজার টাকা: থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া একজন রোগীর মাসে ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হয় বলে ফাউন্ডেশন থেকে জানানো হয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এই ব্যয় যে সব রোগীর মাসে একব্যাগ রক্ত লাগে, তাদের জন্য। একবার রক্ত পরিসঞ্চালনে ২ হাজার টাকা, রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যবহৃত বিশেষ ফিল্টার ব্যয় ২ হাজার টাকা, প্রতি মাসে ওষুধ (আয়রন চিলাটর) ৭ হাজার টাকা ও হাসপাতাল কেয়ার-ল্যাব টেস্ট ২ হাজার টাকা। 

এ ব্যাপারে ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, কোনো কোনো রোগীর সপ্তাহে এক ব্যাগ হিসেবে মাসে তিন ব্যাগও রক্ত লাগে। সেক্ষেত্রে তাদের ব্যয় হবে ২৫ হাজার টাকার মতো। এই প্রতিষ্ঠানে যাকাত ফান্ডসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা আসায় কিছুটা কম লাগে। ঢাকার বাইরের রোগীর স্বজনদের তিনদিন বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। তবে এই ব্যয় বহন করা দরিদ্র মানুষের জন্য খুব কষ্ট। 

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নাম মাত্র: সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীকে রক্ত দিতে হয় ও তখন শরীরে আয়রন জমে। এই আয়রন বের করার জন্য ওষুধ খেতে হয়। এই ওষুধগুলো সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত হারে সরবরাহ নেই এবং অধিকাংশ হাসপাতালে ওষুধই নেই। অনেক সময় ব্লাড বাড়ানোর জন্য একটি ওষুধ দিতে হয়। সেটাও সরকারি হাসপাতালে থাকে না। সে জন্য আমরা চাচ্ছি সরকারি হাসপাতালে যেন ওষুধগুলো নিয়মিত সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. এম এ খান বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অনিয়মিতভাবে চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওষুধ ঠিকমতো দেয় না। এখন বন্ধ। সরকারি কোনো হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য আলাদা কোনো বিভাগ বা শয্যা নেই। সরকারি হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসা অপ্রতুল। কয়েকটি হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা অনিয়মিতভাবে এসব রোগীর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বেসরকারিভাবে চিকিৎসা আছে, কিন্তু ব্যয় বেশি। হেমাটোলজিস্ট বেশি নেই। থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল ও থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতাল সুলভ মূল্যে রোগীদের ওষুধ দেয়।

এ ব্যাপারে ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছে, কিন্তু স্ট্যান্ডার্ড কেয়ার পাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে যেভাবে রোগীদের রক্ত পরিসঞ্চালন হচ্ছে, তাতে অনেক সময় জীবাণু শরীরে চলে যাওয়ার সুযোগ থেকে যায়। নিয়মিতভাবে ওষুধ দেওয়া হয় না। অথচ যতদিন সে পৃথিবীতে বাঁচবে ততদিন তার এই চিকিৎসা করতে হবে।

এখনো চালু হয়নি বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন: থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বলে জানান অধ্যাপক ডা. এম এ খান। তিনি বলেন, এসব রোগী বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে না, ২৫-৩০ বছরের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে পারলে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ৮০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত। তখন আর রক্ত নিতে হয় না। স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে। 

এ ব্যাপারে ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, এখন বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট হচ্ছে, তবে কম। কিছু বেসরকারি হাসপাতালে হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছিল। এখন বন্ধ। এই প্রতিস্থাপনে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

রক্তের পর্যাপ্ততা বড় চ্যালেঞ্জ: ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য নিরাপদ রক্তের পর্যাপ্ততা বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী হয়, তাতে বছরে ৩৬ হাজার ব্যাগ রক্তের দরকার। ১৮ শতাংশ ডোনারের মাধ্যমে সংগ্রহ হয়। বাকি রক্ত বাইরে থেকে নিতে হয়। সেগুলো কতটা নিরাপদ তা তারা নিশ্চিত নন। তবে ডোনারের মাধ্যমে যেগুলো সরাসরি সংগ্রহ করা হয়, সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করায় সেগুলো শতভাগ নিরাপদ। রক্ত নিরাপদ এবং সংগ্রহের সব পদ্ধতি অনুসরণ করা না হলে রোগীর ঝুঁকি থাকে।

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস: থ্যালাসিমিয়া রোগ এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করি’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত