আদর্শ নার্স সেই ব্যক্তি যিনি রোগীর সেবা ও যত্নের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব, মানবতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তার কাজ কেবল চিকিৎসকদের সহায়তা করা নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোগীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানোম গ্যাব্রেয়াসুস বলছেন ‘কোনো দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হচ্ছেন নার্স। বিশেষ করে, তারা কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক সামনে থেকে কাজ করেছেন। বিশ্বকে সুস্থ রাখতে তাদের যে সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তা পূরণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে নার্স সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘বর্তমানে প্রায় ২৯ কোটি নার্স এবং ২ কোটি ২০ লাখ মিডওয়াইফ সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আড়াই লাখ এবং বিশ্বে ৬০ লাখ নার্সের প্রয়োজন হবে।’ গতকাল আধুনিক নার্সিংয়ের জনক ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন উপলক্ষে ‘বিশ্ব নার্স দিবস’ পালন করেন নার্সরা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়েছে।
একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অন্তত তিন জন নার্স থাকতে হবে। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার। সে হিসেবে নার্স প্রয়োজন ৪ লাখ ২ হাজার। কিন্তু বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফার কাউন্সিল নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ চিকিৎসক অনুপাতে নার্স সংকট ২ লাখ ৯২ হাজার। সে হিসাবে ৭৪ শতাংশ নার্সের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। এ বিষয়ে দেশ রূপান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শুধু নার্স সংকট নয়, নার্সিং পেশা ও নার্সিং শিক্ষার দুরবস্থার কথাও বলছেন নার্সরা। তাদের তথ্যমতে, দেশে নার্সিং শিক্ষায় সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নার্সিং কলেজগুলোয় শিক্ষকদের জন্য পদ সৃষ্টি করলেও গত পাঁচ বছরেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কলেজগুলো চলছে ২০০৮ সালের আগের ডিপ্লোমা নার্স দিয়ে। অর্থাৎ এসএসসি পাস ডিপ্লোমা নার্স এখন পড়াচ্ছেন বিএসসি ইন নার্সিং ব্যাচেলর গ্র্যাজুয়েট কোর্সের শিক্ষার্থীদের। ফলে নার্সিং শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক বিষয়।
প্রতিবছর ৩৫ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। পড়ালেখা শেষে বের হয় প্রায় ২৫ হাজার নার্স। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা বাড়ার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ নার্স ও ৩১ লাখ মিডওয়াইফের ঘাটতি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এই ঘাটতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোর ওপর। যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। দেশে করোনার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ গেছে ২ সহস্রাধিক নার্সের। দেশের নার্সদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কভিড-১৯ এ আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা ২৩২০ আর মারা গেছেন ১২ জন নার্স।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবায় নার্সিং পেশার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে চিকিৎসকদের চেয়ে নার্সের সংখ্যা বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে নার্স সংকট প্রবল। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনদের বিভিন্ন ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে অতিরিক্ত রোগীর চাপ নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নার্সদের। ফলে নার্সরা যেমন কাজের সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না, তেমনি রোগীরাও মানসম্মত এবং কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যায় এবং অমানবিক হবে, যদি আমরা নার্সদের কথা ভুলে যাই। এরাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে অর্থনীতিতে অবদান রাখছেনএর ফলে একটি স্বাস্থ্যকর এবং উৎপাদনমুখী কর্মিবাহিনী তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবায়। মনে রাখতে হবে, এই তারাই স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত সম্পদকে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করে, প্রতিরোধমূলক সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি খরচ কমাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা উদ্ভাবন ও গবেষণার অগ্রভাগে রয়েছেন। তাদের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। নার্স সংকটের কারণে স্বাস্থ্যসেবা যেন হুমকির মধ্যে না পড়ে।