জীবদ্দশায় থেকে গিয়েছিলেন প্রায় অচেনা, কিন্তু মৃত্যুর পরে ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন, এমন কিছু মানুষকে নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
বিখ্যাত হওয়ার আকাক্সক্ষা যেন মানব প্রকৃতিরই অংশ। কেউ তা অর্জন করেন জীবদ্দশায়, কেউ আবার মৃত্যুর পর। সময়ের আবর্তে কিছু নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়, অথচ তাদের জীবনের সময়কাল জুড়ে ছিল অচেনা, অবহেলিত, এমনকি বিদ্রুপের শিকার হওয়ার গল্পও। এসব মানুষের মৃত্যু শুধু তাদের জীবনের শেষ নয়, বরং খ্যাতির সূচনা হয়ে উঠেছে। এই ফিচারটি তেমন কিছু মানুষের কাহিনি তুলে ধরবে, যারা জীবদ্দশায় থেকে গিয়েছিলেন প্রায় অচেনা, কিন্তু মৃত্যুর পরে ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন।
জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ
সুরের নীরব সম্রাট, যার ঐশ্বর্য মৃত্যুর পরে উদ্ভাসিত: বারোক সংগীতের এক বিশাল স্তম্ভ, যার সুরের ঐশ্বর্য আজও বিশ্বকে মোহিত করে রাখে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সংগীতের এই মহান কারিগর তার জীবদ্দশায় পাননি তেমন স্বীকৃতি, তেমন সমাদর। তিনি ছিলেন থুরিংগেনের এক নিভৃতচারী সংগীতজ্ঞ, যিনি অর্গান বাজানো আর সংগীতের জটিল কাঠামো নির্মাণেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
বাখের সংগীত ছিল তার সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি জটিল। তার সুরের বহুমুখী বিন্যাস আর ঐশ্বরিক ভাবনার প্রকাশ সমকালীন শ্রোতাদের কাছে হয়তো দুর্বোধ্য ছিল, অথবা তাদের রুচি ততটা পরিশীলিত ছিল না। তিনি ছিলেন একজন পরিশ্রমী সংগীত পরিচালক এবং শিক্ষক, যিনি নিয়মিতভাবে নতুন নতুন সংগীত রচনা করতেন, কিন্তু তার সেই সৃষ্টি তেমন প্রচার পায়নি। হ্যান্ডেল বা টেলিমানের মতো সংগীতকাররা যখন খ্যাতির শীর্ষে, তখন বাখ ছিলেন অনেকটা বিস্মৃতির আড়ালে, যেন এক নীরব শিল্পী নিজের ভুবনেই মগ্ন। ১৭৫০ সালে বাখের প্রয়াণের পর, তার রচিত অমূল্য সংগীত ভাণ্ডার ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। পা-ুলিপিগুলো স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকে, যেন কোনো গোপন ধনভাণ্ডার অনাবিষ্কৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু কালের নিয়ম বড় অদ্ভুত। প্রায় এক শতাব্দী পর, উনিশ শতকের শুরুতে, ফেলিক্স মেন্ডেলসন যখন বাখের ‘সেন্ট ম্যাথিউ প্যাশন’ (St Matthew Passion) পুনরায় পরিবেশন করেন, তখন বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করে সেই নীরব প্রতিভার গভীরতা, সেই সুরের ঐশ্বর্য। যেন এক ঘুমন্ত দৈত্য জেগে উঠল, বাখের সংগীত বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তার জটিল হারমনি, সুরের অসীম বিস্তার আর আবেগের গভীরতা শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে নিল। বাখের ফিউগ, কনসার্টো এবং ক্যান্তাটাগুলো সংগীতের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। তার সংগীত শুধু হৃদয়কে শান্তই করে না, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক আবেগেও আপ্লুত করে তোলে। সেই নীরব সুরকারের আত্মা যেন আজও তার সংগীতের প্রতিটি নোটের মধ্যে জীবন্ত, প্রতিটি সুরে অনুরণিত। আজ জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সুরকারদের একজন হিসেবে বিশ্ব জুড়ে পূজিত হন। জীবদ্দশায় উপেক্ষিত এই সংগীতজ্ঞ মৃত্যুর পরে লাভ করেছেন সেই উচ্চ আসন, যা তার প্রতিভার ন্যায্য প্রাপ্য ছিল। তার সংগীত আমাদের শেখায়, সত্যিকারের শিল্প সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। হয়তো তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি মেলে না, কিন্তু সৃষ্টির ঐশ্বর্য একদিন না একদিন বিশ্বকে আলোড়িত করবেই।
জন কিটস
জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১) : অকালান্তের সুর, যার কবিতা কালের সীমা ছাড়িয়ে।
ইংরেজি সাহিত্যের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা, যার জীবন দীপশিখার মতো স্বল্পস্থায়ী হলেও তার কাব্যিক দ্যুতি আজও অমলিন। ১৭৯৫ সালে লন্ডনের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই তরুণ কবি মাত্র ২৬ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার জীবন ছিল স্বপ্ন আর বেদনার এক করুণ কাব্য, যেখানে সৃষ্টির আনন্দ মিশে গিয়েছিল অকালমৃত্যুর ছায়ায়।
জীবদ্দশায় কিটসের কবিতা সমালোচকদের নির্মম সমালোচনার শিকার হয়েছিল। তার আবেগময় ভাষা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চিত্রকল্প, আর চিরায়ত গ্রিক মিথের প্রতি আকর্ষণ তৎকালীন সাহিত্য মহলে অনেকেই ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। ‘ককনি পোয়েট’ (ঈড়পশহবু চড়বঃ)-এর মতো ব্যঙ্গাত্মক আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তাকে, যা তার সংবেদনশীল কবি হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। ভালোবাসার কাঙাল এই তরুণ কবি ফ্যানি ব্রাউনের সঙ্গে তার অসমাপ্ত প্রেমও ছিল বেদনায় ভরা। সমালোচনার তীরে জর্জরিত, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘Here lies One Whose Name was writ in Water’ (এখানে শায়িত একজন, যার নাম লেখা ছিল জলে)। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুরতা বড় নির্মম, আবার বড় ন্যায়বিচারকও বটে। কিটসের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তার কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য আর গভীর আবেগ সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয় স্পর্শ করতে শুরু করে। তার ‘ওড টু এ নাইটিংগেল’ (Ode to a Nightingale)-এর বিষন্ন সুর, ‘ওড অন এ গ্রেশিয়ান আর্ন’ (Ode on a Grecian Urn)-এর শাশ্বত সৌন্দর্য, ‘ওড টু অটাম’ (Ode to Autumn)-এর স্নিগ্ধ চিত্রকল্প যেন এক অকালান্তের সুর, যা কালের সীমা ছাড়িয়ে আজও পাঠকের মনে অনুরণিত হয়। তার কবিতায় প্রেম, সৌন্দর্য, নশ্বরতা আর শিল্পের অমরত্বের যে দার্শনিক ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে, তা তাকে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। কিটসের অকালমৃত্যু ইংরেজি সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি। কে জানে, যদি তিনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, তবে সাহিত্যকে আর কত অমূল্য রতœ উপহার দিতে পারতেন! লর্ড বায়রন যথার্থই বলেছিলেন, ‘কিটস, যার স্পর্শ ছিল আগুনের মতো, কেন তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে?’মৃত্যুর পর কিটস কেবল একজন কবি নন, হয়ে উঠেছেন এক বেদনাবিধুর কিংবদন্তি।
হাইপেশিয়া
হাইপেশিয়া (৩৭০-৪১৫ খ্রিস্টাব্দ) :
জ্ঞানের জ্যোতির্বিদ, ধর্মান্ধতার আঁধারে যার জীবনাবসান : আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানালোকিত প্রাঙ্গণে, যেখানে দর্শন আর বিজ্ঞানের মুক্ত আলোচনায় মুখরিত থাকত পণ্ডিতদের সভা, সেখানে এক ব্যতিক্রমী নারী জ্ঞানের মশাল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন হাইপেশিয়া। নারী হয়েও তিনি তৎকালীন সমাজের সব বাধা অতিক্রম করে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা আর দর্শনের গভীরে ডুব দিয়েছিলেন। তার প্রজ্ঞা আর মেধা ছিল এতটাই প্রখর যে, বহু পুরুষ পণ্ডিতও তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতেন। প্লেটো আর সক্রেটিসের দর্শনে স্নাত হাইপেশিয়ার কণ্ঠ ছিল যুক্তির ধারালো তরবারি, আর তার মন ছিল অনুসন্ধিৎসু এক দিগন্তের মতো। তিনি শুধু জ্ঞানার্জনই করেননি, সেই জ্ঞান বিতরণেও ছিলেন অক্লান্ত। দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ছুটে আসত তার বক্তৃতা শুনতে, তার জ্ঞানের প্রদীপের আলোয় নিজেদের মনকে আলোকিত করতে। আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর ওরেস্টেসের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিও তার জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ ছিলেন, জ্ঞানের পরামর্শের জন্য ছুটে যেতেন তার কাছে। কিন্তু সেই আলো সহ্য হয়নি ধর্মান্ধতার আঁধারে নিমজ্জিত কিছু মানুষের। নারী হয়ে জ্ঞানের চর্চা করা, মুক্তচিন্তার প্রবক্তা হওয়া এগুলো যেন তাদের সংকীর্ণ মনে আঘাত হানে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ধর্মীয় বিদ্বেষের এক ভয়াবহ সময়ে হাইপেশিয়া হয়ে উঠেছিলেন সেই অন্ধকারের শিকার। ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে, লেন্টের এক বিষণœ সকালে, যখন হাইপেশিয়া তার রুটিনমাফিক পথে ক্যারিজে এ করে যাচ্ছিলেন, একদল উন্মত্ত, ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সন্ন্যাসী তাকে টেনে নামায়। শহরের রাজপথে, নির্মমভাবে তার বস্ত্রহরণ করা হয়। এরপর, এক গির্জার ভেতরে, ধারালো ঝিনুক বা টালির টুকরা দিয়ে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করা হয়, জীবন্ত ছিঁড়ে ফেলা হয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। সেই জ্ঞানপিপাসু নারীর রক্তে রঞ্জিত হয় আলেকজান্দ্রিয়ার মাটি, স্তব্ধ হয়ে যায় মুক্তচিন্তার কণ্ঠ।
হাইপেশিয়ার নির্মম হত্যাকাণ্ড শুধু একজন বিদুষী নারীর জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং তা ছিল জ্ঞানচর্চা আর মুক্তবুদ্ধির ওপর এক কলঙ্কজনক আঘাত। তার মৃত্যু যেন প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞান আর আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান-ঐতিহ্যের পতনের সূচনা করে। ধর্মান্ধতার বিষাক্ত ছোবলে নিভে যায় এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, কিন্তু সেই নীরব কান্না প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে পায় ইতিহাসের পাতায়। মৃত্যুর পর হাইপেশিয়া হয়ে উঠেছেন মুক্তচিন্তা আর নারী শিক্ষার এক বলিষ্ঠ প্রতীক।
গ্রেগর জোহান মেন্ডেল
গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪) : মটরশুঁটি বাগানের নীরব সাধক, যার আবিষ্কার বদলে দিল জীববিজ্ঞানের দিগন্ত। মঠের শান্ত আঙিনায়, মটরশুঁটির সবুজ লতানো গাছের মাঝে এক নীরব সাধকের মতো দিন কাটাতেন গ্রেগর জোহান মেন্ডেল। অস্ট্রিয়ান এই ধর্মযাজক ও বিজ্ঞানী জ্ঞানের অন্বেষণে নিমগ্ন ছিলেন, প্রকৃতির গোপন রহস্য উন্মোচনে উৎসর্গ করেছিলেন নিজের জীবন। মটরশুঁটি বাগানে তার নিবিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা নীরবে জন্ম দিচ্ছিল এমন এক বৈপ্লবিক ধারণার, যা জীববিজ্ঞানের চিরাচরিত ধ্যানধারণাকে আমূল পরিবর্তন করে দেবে। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর ধরে মেন্ডেল প্রায় ২৯ হাজার মটরশুঁটির গাছের ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিলেন। বংশানুক্রমের জটিল ধাঁধা সমাধানের একনিষ্ঠ চেষ্টায় তিনি খুঁটিয়ে দেখেছিলেন প্রতিটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বীজের আকার, ফুলের রঙ, কাণ্ডের উচ্চতা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, তিনি নীরবে তথ্য সংগ্রহ করতেন, সংখ্যা আর অনুপাতের জটিল জালে খুঁজতেন কোনো সুপ্ত নিয়ম। সেই নীরব গবেষণাগারে, প্রকৃতির সবুজ আবরণের নিচে জন্ম নিচ্ছিল বংশগতির সেই মৌলিক সূত্র, যা পরবর্তীতে ‘মেন্ডেলের সূত্র’ নামে বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মেন্ডেলের এই যুগান্তকারী কাজ তার জীবদ্দশায় তেমন কোনো স্বীকৃতি পায়নি। ১৮৬৫ সালে মোরাভিয়ার ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি অব ব্রুনেতে তিনি দুবার তার গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেছিলেন। সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা, সম্ভবত তার কাজের তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, অথবা তাদের মনোযোগ ছিল অন্য দিকে নিবদ্ধ। হতাশ না হয়ে মেন্ডেল মৌমাছি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন, সেখানেও তিনি সফলতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তার প্রধান কীর্তি, বংশগতির সেই অমূল্য সূত্র, রয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির আড়ালে, ১৮৮৪ সালে কিডনির জটিলতায় গ্রেগর মেন্ডেলের জীবনাবসান ঘটে। রেখে যান এক নীরব সাধনার ফল, যা মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন বিজ্ঞানীরা মেন্ডেলের সেই বিস্মৃত গবেষণা পুনরায় আবিষ্কার করেন, তখন জীববিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। মেন্ডেলের সূত্র হয়ে ওঠে জিনতত্ত্বের ভিত্তি, বংশগতির রহস্য উন্মোচনের প্রথম সুস্পষ্ট পথনির্দেশক। আজ গ্রেগর জোহান মেন্ডেল ‘বংশগতিবিদ্যার জনক’ হিসেবে বিশ্ব জুড়ে সম্মানিত।