বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। চলতি মাসে ভারত প্রায় ১ হাজার ১০০ জনকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে, যাদের মধ্যে রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকও রয়েছে বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর পাশাপাশি কুড়িগ্রামে ভারতীয় ড্রোনের অনুপ্রবেশে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সীমান্তে পুশইন ঠেকাতে স্থানীয় জনতা ও বিজিবি মানবপ্রাচীর গড়ে প্রতিরোধ করছে, যা দুই দেশের সম্পর্কে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
গত শুক্রবার রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ী সীমান্তে চারটি ভারতীয় ড্রোন বাংলাদেশের আকাশে প্রায় আধঘণ্টা চক্কর দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বিজিবি ড্রোনের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) দায় অস্বীকার করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তের ৫০০ মিটার অভ্যন্তরে ড্রোনের চলাচল আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘ড্রোন পাঠানো কেবল নজরদারি নয়, এটি একটি আগ্রাসী রাজনৈতিক বার্তাও বহন করে।’
এদিকে, শুক্রবার রাতে কুড়িগ্রামের কচাকাটায় বিএসএফ ৫০-৬০ জনকে পুশইন করার চেষ্টা করলে স্থানীয়রা খবর পেয়ে মানবপ্রাচীর তৈরি করে প্রতিরোধ গড়ে। বিজিবি ও আনসার ভিডিপি কঠোর অবস্থান নেয়, এবং রাত ২টা পর্যন্ত উত্তেজনার পর বিএসএফ পিছু হটে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। তিনি জানিয়েছেন, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৬৩ জন ‘ঘোষিত বিদেশি’কে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা শুরু হয়েছে, এবং আরও ফেরত পাঠানো হবে। ঢাকা এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুশইন, ড্রোন অনুপ্রবেশ এবং মানবপ্রাচীর দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি করছে। তারা বলছেন, দ্রুত কূটনৈতিক সমাধান না হলে সম্পর্কের আরও অবনতি হতে পারে। পুশইনকে অনেকে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে দেখছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যাচাই ছাড়া জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং অনৈতিক।
পুশইনের হিসাব
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ৪ থেকে ২৭ মে পর্যন্ত ১৭টি জেলার সীমান্ত ও সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া দিয়ে ৯৭৫ জন এবং ৩১ মে আরও ৮২ জনকে বিএসএফ পুশইন করেছে। সবচেয়ে বেশি পুশইন হয়েছে মৌলভীবাজার দিয়ে ৩৩১ জন, খাগড়াছড়ি দিয়ে ১১১, সিলেট সীমান্ত দিয়ে ১০৩ ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ৮৪ জন। এ ছাড়া লালমনিরহাট দিয়ে ৭৫, সুনামগঞ্জ দিয়ে ১৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে ১৭, ঠাকুরগাঁও দিয়ে ১৯, পঞ্চগড় দিয়ে ৩২, ঝিনাইদহ দিয়ে ৪২, মেহেরপুর দিয়ে ৩০, চুয়াডাঙ্গা দিয়ে ১৯, ফেনী দিয়ে ৩৯, সাতক্ষীরা দিয়ে ২৩, হবিগঞ্জ দিয়ে ১৯, কুমিল্লা দিয়ে ১৩, দিনাজপুর ২, এবং সুন্দরবন দিয়ে ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া প্রায় ১০০ জন সীমান্তে আটক রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে ভারতে শ্রমিক ছিলেন, কেউ কারাভোগ করেছেন এবং কিছু রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকও রয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ী সীমান্তে শুক্রবার রাতে চারটি ভারতীয় ড্রোন বাংলাদেশের আকাশে ৫০০ মিটার অভ্যন্তরে চক্কর দেয়। স্থানীয়রা জানান, ড্রোনগুলো ভারতের আসামের কাকড়িপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে পাঠানো হয়। রৌমারী সদর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ফিরোজ মিয়া বলেন, ২৭ মে ১৪ জন ভারতীয় নাগরিক পুশইনের পর থেকে ড্রোন দিয়ে নজরদারি চলছে। শুক্রবার রাতে ৪-৫টি ড্রোন বড়াইবাড়ী ও বারবান্দা গ্রামে দেখা গেছে।
আসামের পুশব্যাক ঘোষণা
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৬৩ জন ‘ঘোষিত বিদেশি’কে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, রাজ্য কর্র্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল, মাতিয়া বন্দিশিবিরে আটক ‘ঘোষিত বিদেশিদের’ দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে। আদালতের এ নির্দেশ মেনে তারা পুশব্যাক করছে।
হিমন্ত বিশ্বশর্মা জানান, যাদের বিরুদ্ধে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত এবং যারা কোনো উচ্চতর আদালতে আপিল করেননি, শুধু তাদেরই পুশব্যাক করা হচ্ছে। যাদের মামলা এখনো বিচারাধীন, বা আপিল চলছে, তাদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য নয়।
তবে অনেক পরিবারের অভিযোগ- আটক ব্যক্তিরা কোথায় আছেন, সে বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পরিষ্কার তথ্য দেওয়া হয়নি। কিছু বাংলাদেশি পরিবার বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট এবং ভিডিও দেখে দাবি করেছেন, তারা তাদের স্বজনদের শনাক্ত করতে পেরেছেন।
মুখ্যমন্ত্রী জানান, ভারত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই ‘ফেরত প্রক্রিয়া’ পরিচালনা করছে। তবে ঢাকা থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি।
কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৮, ১৩, ১৫ ও ২০ মে ভারতকে চিঠি দিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। চিঠিতে ১৯৭৫ সালের জয়েন্ট গাইডলাইনস, ২০১১ সালের সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা এবং বিজিবি-বিএসএফ সমঝোতা লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়। ভারতকে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে না পাঠিয়ে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর দাবি জানানো হয়।
ভারত ১৫ মে দাবি করে, বাংলাদেশ তাদের অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেয়নি। ২১ মে ভারত জানায়, তারা ২ হাজার ৪৬১ জনের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অনুরোধ পাঠিয়েছে, যা বাংলাদেশ এখনো সম্পন্ন করেনি।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা পুশব্যাক করি না। প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক ভারতকে ফেরত নিতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারতীয় পুশইন অবৈধ এবং বাংলাদেশ কূটনৈতিক সমাধান চায়। তিনি জানান, কিছু রোহিঙ্গা ও ভারতীয় রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। বিজিবি সীমান্তে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে এবং বিএসএফের সঙ্গে পতাকা বৈঠকে প্রতিবাদ জানিয়েছে।