একটি সফল জীবন কীভাবে মাপা যায়? এই প্রশ্নটি কেবল তাত্ত্বিক বা ধর্মীয় নয়—এটি আমাদের ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং নৈতিক অস্তিত্বের কেন্দ্রে অবস্থান করে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের খ্যাতনামা অধ্যাপক এবং ‘Disruptive Innovation’ তত্ত্বের প্রবর্তক ক্লেটন এম. ক্রিস্টেনসেন তার প্রসিদ্ধ প্রবন্ধে (Harvard Business Review, July–August 2010) এই প্রশ্নের গভীর উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন। তার এই অনুধ্যান আজও অসংখ্য মানুষকে সাফল্যের প্রকৃত অর্থ নিয়ে নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করে।
সাফল্য আত্মমর্যাদায়, অহংকারে নয়
ক্রিস্টেনসেন বলেছিলেন, সম্পদ, খ্যাতি বা ক্ষমতা দিয়ে সাফল্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করা যায় না। বরং আমরা কেমনভাবে দায়িত্বশীল জীবন যাপন করি, আমাদের সম্পর্ক কতটা দৃঢ়, এবং আমরা অন্যদের জীবনে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারি—এসব দিয়েই প্রকৃত সাফল্য নির্ধারিত হয়। এক পরিপূর্ণ জীবন মানে একটি অর্থবোধক ও মূল্যনির্ভর জীবন—না যে জীবন কেবল বাহবা বা অর্জনের পেছনে ছুটে।
কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের ভারসাম্য: আজীবন চর্চা
পেশাগত উৎকর্ষের খোঁজে আমরা অনেক সময় পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে উপেক্ষা করি। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পদক বা পদোন্নতির মূল্য তখনই অসার মনে হয়, যদি তা কাছের মানুষদের হারিয়ে অর্জিত হয়। ক্রিস্টেনসেন মনে করতেন, জীবনের প্রকৃত আনন্দ আসে প্রিয়জনদের লালন-পালনে। যত দ্রুত এই ভারসাম্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করব, ততই আমাদের জীবন হবে সমৃদ্ধ।
সময়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ
আমরা কীভাবে সময় ব্যয় করছি, তা-ই আমাদের জীবনের অগ্রাধিকারের প্রকৃত প্রতিফলন। যদি কাজই আমাদের দিনগুলো সম্পূর্ণ দখল করে নেয়, তবে তা-ই আসলে আমাদের মূল্যবোধের ইঙ্গিত দেয়। ক্রিস্টেনসেন বিশ্বাস করতেন, সম্পর্ক, ব্যক্তিগত বিকাশ ও মানসিক সুস্থতায় সময় ব্যয় করা বিলাসিতা নয়—এটি অত্যাবশ্যক। এই বিনিয়োগগুলিই আমাদের জীবনের সবচেয়ে গভীর সুফল বয়ে আনে।
জীবনের জন্য প্রয়োজন একটি কৌশলগত পরিকল্পনা
যেমন একটি কোম্পানির সাফল্যের জন্য একটি স্পষ্ট কৌশল দরকার, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও দরকার একটি লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পনা। উদ্দেশ্যহীনভাবে চললে আমরা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি, যা আমাদের প্রকৃত স্বত্বার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ক্রিস্টেনসেন তাঁর শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতেন একটি ব্যক্তিগত কৌশল তৈরি করতে—যেটি আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, দৈনন্দিন সিদ্ধান্তে দিকনির্দেশনা দেয় এবং আমাদের একটি অর্থপূর্ণ উত্তরাধিকার গঠনে সহায়তা করে।
নৈতিকতা: একজন সম্মানিত জীবনের ভিত্তি
ক্রিস্টেনসেনের কাছে নৈতিকতা ছিল আপসহীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি ছোট আপসও সারাজীবনের আত্মমর্যাদা ক্ষয় করতে পারে। একবার তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলায় অংশগ্রহণ না করে নিজের নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন—গৌরবের চেয়ে সততার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, প্রকৃত মানসিক প্রশান্তি আসে তখনই, যখন আমরা জানি আমরা আমাদের আদর্শের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থেকেছি—এমনকি যদি তাতে কিছু হারাতেও হয়।
অন্যের উপকারে আসাই আসল তৃপ্তি
ক্রিস্টেনসেনের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে ছিল ‘সেবা’। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত সুখ আসে অন্যদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার মাধ্যমে। শিক্ষক, পরামর্শদাতা, বন্ধু বা পিতা—যে ভূমিকাতেই হোন না কেন, তিনি সদা চেষ্টা করতেন আশপাশের মানুষদের উন্নত করতে। আর এভাবেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এক গভীর আনন্দ, যা পেশাগত স্বীকৃতির চেয়েও অনেক বেশি অর্থবহ।
একটি চূড়ান্ত শিক্ষা
‘আপনার সেরা চিন্তাভাবনা শুধু ক্যারিয়ার নয়—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করুন।’
ক্রিস্টেনসেনের চিরন্তন বার্তাটি ছিল এই: আমরা কী অর্জন করেছি তার মাধ্যমে জীবনের মান নির্ধারিত হয় না, বরং আমরা কী ধরনের মানুষে পরিণত হয়েছি, অন্যদের কীভাবে ব্যবহার করেছি, এবং আমাদের রেখে যাওয়া প্রভাব কতটা গভীর—এসবই তার মূল মানদণ্ড।
ক্রিস্টেনসেনের দৃষ্টিভঙ্গির মূল শিক্ষা
*পদোন্নতির মাধ্যমে নয়, আমরা কেমন মানুষ হচ্ছি তার ভিত্তিতে সাফল্য মাপা উচিত।
*আমরা কীভাবে সময় ব্যয় করছি, সেটিই আমাদের মূল্যবোধের সবচেয়ে সত্য সূচক।
*নৈতিকতা সব সিদ্ধান্তেই প্রধান নির্দেশক হওয়া উচিত।
*প্রকৃত সুখ আসে সম্পর্ক এবং সেবার মাধ্যমে—স্বীকৃতির মাধ্যমে নয়।
ক্রিস্টেনসেন আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার মানবিক দর্শন আজও আমাদের ভাবিয়ে তোলে এবং অনুপ্রাণিত করে। আমাদের জীবনের সত্যিকারের সফলতা, শেষ পর্যন্ত, নির্ধারিত হবে আমরা কাকে ভালোবেসেছি, কাকে সাহায্য করেছি, এবং আমরা নিজের সঙ্গে কতটা সত্য ছিলাম—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে।
এম এম মাহবুব হাসান
ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক