বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ইরানের বিরুদ্ধে কী সামরিক পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকছেন ট্রাম্প?

আপডেট : ১৭ জুন ২০২৫, ১২:২৯ পিএম

মাত্র আট ঘণ্টার ব্যবধানে ইরান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থানে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে। গতকাল সোমবার একদিকে তিনি ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতার সম্ভাবনার কথা বললেও, অন্যদিকে হঠাৎ করেই তেহরানের প্রায় ৯৫ লাখ মানুষকে জীবন বাঁচাতে শহর ছেড়ে পালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলন সংক্ষিপ্ত করে জরুরি জাতীয় নিরাপত্তা বৈঠকে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে ফিরে আসেন। খবর: এপি।

আজ মঙ্গলবার ভোরেই তার হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর কথা—যেখানে তাকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। কারণ, ইসরায়েল টানা চার দিনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের ওপর বড় রকমের ক্ষতি ডেকে এনেছে এবং এখন তারা বিশ্বাস করে, ওয়াশিংটনের সামান্য সহায়তা পেলেই ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমে স্থায়ী আঘাত হানা সম্ভব।

তবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো গভীর ভূগর্ভে নির্মিত হওয়ায় সেখানে বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা বা অন্য কোনো সরাসরি মার্কিন সামরিক সহায়তা পাঠানো হলে ট্রাম্পকে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে হবে। তবুও তিনি মনে হচ্ছে ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন।

গতকাল সোমবার ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে লিখেন, “ইরান যদি আমার বলা চুক্তিতে স্বাক্ষর করত, তাহলে এত প্রাণহানির দরকার হতো না। কী দুর্ভাগ্য, কী প্রাণের অপচয়! স্পষ্ট করে বলছি—ইরান কোনো অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে না! আমি বারবার বলেছি! সবাই যেন সঙ্গে সঙ্গে তেহরান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়!”

যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নৌবাহিনী ও সামরিক বিমান মোতায়েনের নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাত আরও বেড়ে গেলে তা সামাল দেওয়া যায়।

**ইসরায়েলের দাবি, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে**

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছে, এখন তারা দেশটির যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে সক্ষম। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও ক্ষেপণাস্ত্র মজুত সম্পূর্ণ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তাদের হামলা অব্যাহত থাকবে।

ইসরায়েল ইতোমধ্যে ইরানের একাধিক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালেও এখনো ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস করতে পারেনি। কারণ এটি অনেক গভীরে অবস্থিত। এ ধরনের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে হলে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের মার্কিন নির্মিত জিবিইউ–৫৭ ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ নামের বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা প্রয়োজন, যা বি–২ স্টেলথ বোমার ব্যবহারেই ছোড়া সম্ভব। ইসরায়েলের কাছে না সে বোমা আছে, না আছে ওই ধরনের বোমারু বিমান।

এদিকে ইরানের পাল্টা হামলার মুখেও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা কাঠামো বেশিরভাগই অক্ষত আছে। তবে কিছু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র সুরক্ষা ভেদ করে আঘাত হেনেছে এবং প্রাণহানিও ঘটেছে।

**ট্রাম্পের আরও সরাসরি জড়িত হওয়ার গুঞ্জন জোরালো হচ্ছে**

ট্রাম্প ওয়াশিংটনে ফেরার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথকে ফক্স নিউজের প্রাইমটাইম অনুষ্ঠানে পাঠানো হয়। সেখানে হেগসেথ জানান, ট্রাম্প এখনো চান ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি হোক।

তিনি বলেন, “ট্রাম্পের অবস্থান বদলায়নি। আপনি এখন যা দেখছেন তা হলো শক্তির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির বাস্তবায়ন। আমরা এই অঞ্চলে আত্মরক্ষামূলকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আছি, যেন শান্তিচুক্তি সম্ভব হয়।”

**ট্রাম্প সরাসরি জড়ানোর বিষয়ে কিছু বলেননি, তবে ইরানকে আলোচনার তাগিদ দিয়েছেন**

জি–৭ সম্মেলনের ফাঁকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেননি, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কিনা। তবে তিনি বারবার ইরানকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনির সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি বলেন, “ওদের কথা বলা উচিত, এখনই কথা বলা উচিত। আমার মতে, ইরান এই যুদ্ধে জিতছে না।”

একইসঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে কিছুটা সংযত রাখার চেষ্টা করেছেন। মার্কিন প্রশাসনের এক কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, ইসরায়েল সম্প্রতি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার একটি পরিকল্পনা হোয়াইট হাউসকে জানায়। তবে ট্রাম্প পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি এতে সম্মত নন। ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হোয়াইট হাউস ইসরায়েলকে জানিয়ে দেয়, এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ট্রাম্প।

**নিজ দলেই ভাঙন: যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে ট্রাম্পের সমর্থকদের ক্ষোভ**

ট্রাম্পের নিজ দল ‘ম্যাগা’ ঘরানার অনেক নেতা-সমর্থকই এখন তার অবস্থান নিয়ে দ্বিধায়। এদের একজন, কনজারভেটিভ বিশ্লেষক টাকার কার্লসন সম্প্রতি তার নিউজলেটারে ট্রাম্পকে “যুদ্ধের সহপাঠী” বলে আখ্যায়িত করেন।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, “আমি জানি না টাকার কার্লসন কী বলছে। সে চাইলে একটা টিভি চ্যানেল খুলে নিজের মতামত প্রচার করুক।”

পরে সামাজিক মাধ্যমেও তিনি কার্লসনকে কটাক্ষ করে লেখেন, “কেউ একজন দয়া করে ওই পাগল টাকার কার্লসনকে বুঝিয়ে বলুক—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে না!”

এ ছাড়া জর্জিয়ার কংগ্রেস সদস্য মার্জোরি টেলর গ্রিন এবং টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর প্রতিষ্ঠাতা চার্লি কার্কসহ ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এভাবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলা ট্রাম্পের আগের প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী।

চার্লি কার্ক এক্স-এ লেখেন, “এখন যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিভাজনের বিষয় হলো পররাষ্ট্রনীতি। আমি গত কয়েক মাস ধরে গোড়ার স্তরে যা দেখেছি, তাতে খুবই চিন্তিত—এটা ম্যাগার মধ্যে গভীর ফাটল তৈরি করতে পারে এবং ট্রাম্পের সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।”

তবে অন্যদিকে রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতো ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠরাও আছেন যারা চাইছেন, এই সুযোগে ট্রাম্প যেন ইরানকে চূড়ান্তভাবে দমন করেন।

গ্রাহাম এক্স-এ লেখেন, “ইউক্রেন-রাশিয়া ও ইসরায়েল-ইরান সংকট—এই দুই ক্ষেত্রেই শান্তি আনতে ট্রাম্প চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শান্তি আনতে হলে উভয় পক্ষের সদিচ্ছা দরকার। ইরান আগের মতো ধোঁকা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু এবার ভুল ব্যক্তিকে পেয়েছে।”

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত