আদিম মানুষ যখন গুহার পাথরে প্রথম রেখা টেনেছিল, তখন কি সে জানত যে একদিন সেই শিল্পের ভাষাই পৌঁছে যাবে কম্পিউটারের পর্দায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে? শিল্পের এই যাত্রা নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
ভাবছি, কী আশ্চর্য এক পথ হেঁটে এসেছি আমরা! আজ আমার হাতে ধরা এই ডিভাইসে এক নিমিষে যে কোনো ছবি আঁকতে পারি, মুহূর্তেই সেগুলোকে কল্পনার রঙে রাঙাতে পারি, এমনকি একটা শব্দ লিখলেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেকেন্ডের মধ্যে এক অচেনা শিল্পকর্ম গড়ে তোলে। কিন্তু আমার মন চলে যায় অনেক, অনেক দূরে সেই আদিম সময়ের গভীরে, যখন মানুষ প্রথম মাটির রঙ আর পাথরের রেখায় নিজেদের স্বপ্নের কথা বলতে চেয়েছিল।
শিল্পের শৈশব
মনে পড়ে, যেন কতকালের স্মৃতি, আমাদের প্রথম শিল্প স্টুডিওগুলো ছিল বিশাল গুহার অন্ধকার দেয়াল। তখন রঙ ছিল বন্য মাটির খনিজ, আর তুলি ছিল হাত বা পাখির পালক। ফ্রান্সের লাসকো, স্পেনের আলতামিরার সেই গুহাগুলোতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খোদাই করেছিল শিকারের দৃশ্য, ছুটন্ত বাইসন আর রহস্যময় কিছু প্রতীক। ওরা শুধু ছবি আঁকেনি, ওরা যেন নিজেদের আত্মার কথা লিখেছিল। ওটা ছিল প্রকৃতির সঙ্গে এক গোপন কথোপকথন, এক অব্যক্ত প্রার্থনা।
আমি যদি সেই লাসকোর গুহায় গিয়ে দাঁড়াতাম
কখনো কখনো মনে হয়, যদি আমি সময়ের স্রোত উল্টো ঘুরিয়ে সেই লাসকোর গুহায় গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম! চারপাশে আর্দ্র পাথরের গন্ধ, দেয়ালের ওপর আলো-আঁধারিতে ফুটে উঠছে বাইসনের ছুটন্ত অবয়ব। আমি হয়তো এক হাতে একটা প্রাচীন তুলি ধরতাম কোনো শুকনো গাছের ডাল বা পশুর হাড় দিয়ে তৈরি করা। সামনে বসে থাকা এক আদিম শিল্পী, কপালের ঘামে ধুলো লেগে আছে, আর সে নিঃশব্দে সেই বাইসনের রূপ দিচ্ছে দেয়ালে। আমার চোখে তার চোখ পড়ত হাজার বছরের ব্যবধান পেরিয়ে, দুজন মানুষের চোখের মধ্যে একই রকম উত্তেজনা, একই রকম সৃষ্টির
তৃষ্ণা। আমি আধুনিক, সে আদিম। আমি জানি ক্যামেরা, এআই, পিক্সেল, আর সে জানে পাথরের ধুলো আর মাটির রঙ। তবু দুজনেই জানি, এই ছবিগুলো কোনো খেয়ালের নয় এটা আমাদের আত্মার গল্প বলা, আমাদের অস্তিত্ব রেখে যাওয়ার তাগিদ। সম্ভবত আমি তার পাশে বসে যেতাম। হয়তো সে একবার তাকিয়ে হাসতো ভাষা নেই, তবু বোঝাপড়া সম্পূর্ণ। সেই মুহূর্তে আমরা দুজনই শুধু ‘মানুষ’, যারা পৃথিবীকে রেখে যেতে চায় নিজের চোখের মতো করে আঁকা গল্পে।
শিল্পের নতুন ভাষা
সময় গড়িয়ে চলল। নীল নদের তীরে মিসরীয়রা বিশাল পিরামিড আর মন্দিরের দেয়ালে লিখল ফারাওদের অমরত্বের গাথা, দেবতাদের অলৌকিক কাহিনি। তাদের ছবিতে ছিল ধর্ম আর ক্ষমতা, এক নিবিড় বন্ধন। এরপর গ্রিকরা এলো, মানবদেহের নিখুঁত সৌন্দর্যকে ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তুলল, মার্বেল পাথরে যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করল। রোমানরা সেই বাস্তবতাকে আরও বিস্তারিত করল, ফ্রেস্কো আর মোজাইকে তুলে আনল নিজেদের বীরত্ব আর দৈনন্দিন জীবন। কিন্তু কালের চাকা যখন মধ্যযুগের ধূসর সময়ে প্রবেশ করল, তখন শিল্প যেন একটু থমকে গিয়েছিল। গির্জার প্রভাব বাড়ল, আর শিল্পের ভাষা হয়ে উঠল শুধুই ধর্মীয়। ব্যক্তিগত ভাবনাগুলো ঢেকে গেল আধ্যাত্মিকতার আবরণে।
তারপর এলো সেই মহাজাগতিক পরিবর্তন রেনেসাঁ। যেন সহস্র বছরের ঘুম ভাঙল ইউরোপের। শিল্পীরা নতুন করে মানুষ, প্রকৃতি আর বিজ্ঞানকে আবিষ্কার করলেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো জাদুকররা তুলির টানে শুধু ছবি আঁকেননি, তারা মানুষের ভাবনাকে, আত্মাকে ক্যানভাসে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। মোনালিসার সেই রহস্যময় হাসি, সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাদের প্রতিটি ফ্রেস্কো তারা শুধু রঙ আর তুলির খেলা ছিল না, ছিল গভীর দর্শন আর মানব মনের অদম্য জিজ্ঞাসার প্রকাশ। মনে হয় যেন আমি সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তাদের সৃষ্টি দেখছি, আলোর এক নতুন জন্ম দেখছি।
একবার ভাবি, লিওনার্দো যদি আজকের ফটোশপ হাতে পেতেন, কী করতেন? মোনালিসার চোখের রঙ কি তখন বদলে দিতেন, নাকি আরও রহস্যময় কিছু করতেন? সময় আরও এগোতে লাগল। যন্ত্রের যুগ এলো, ক্যামেরার ক্লিক মুহূর্তের বাস্তবতাকে ধরে রাখতে শিখল। শিল্পীরা বুঝলেন, বাস্তবতাকে হুবহু নকল করার দিন শেষ। এবার শুরু হলো নিয়ম ভাঙার খেলা। শিল্পী ক্লদ মোনের তুলি আলো আর রঙের ক্ষণস্থায়ী খেলায় মেতে উঠল, ভ্যান গগের ব্রাশস্ট্রোকগুলো যেন অস্থির আত্মাকে প্রকাশ করল, আর পিকাসো! তিনি তো এক ধাপ এগিয়ে সবকিছু ভেঙেচুরে দিলেন, বস্তুকে নতুন এক জ্যামিতিক রূপে দেখালেন কিউবিজম।
শিল্প তখন আর শুধু সুন্দর দেখানোর জন্য রইল না। এটা হয়ে উঠল প্রতিবাদের ভাষা, প্রশ্ন করার সাহস, গভীর অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। অ্যান্ডি ওয়ারহল স্যুপের ক্যান বা মেরিলিন মনরোর মুখকে পপ আর্টের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে শিল্পকে নিয়ে এলেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। শিল্প যেন হাসতে শিখল, খেলতেও শিখল।
ভারতের বর্ণিল শিল্পধারা
আমার এই স্মৃতিচারণ যখন শিল্পের বিশ্বজনীন পথপরিক্রমা করছে, তখন ভারতভূমিকে বাদ দিলে কি চলে? এ তো এক এমন দেশ, যেখানে প্রতিটি প্রদেশের, প্রতিটি জনজাতির নিজস্ব শিল্পভাষা রয়েছে। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহর থেকে শুরু করে অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র, মুঘল মিনিয়েচার থেকে ব্রিটিশ যুগের ক্যালেন্ডার আর্ট ভারত বরাবরই শিল্পের এক বিচিত্র ক্যানভাস।
বিশেষ করে, ভারতের বিভিন্ন জনজাতি ও সম্প্রদায়ের লোকশিল্প যেন সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। শত শত বছর ধরে চলে আসা এই শিল্পগুলো শুধু আঁকাআঁকি নয়, বরং তাদের দৈনন্দিন জীবন, বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আর গল্প বলার মাধ্যম।
মধুবনী চিত্রকর্ম (বিহার) : কল্পনার পোশাকে উজ্জ্বল রঙের পুঁতি মিথিলা অঞ্চলের নারীদের হাতে তৈরি এই শিল্পকলা মূলত দেয়াল ও কাপড়ে আঁকা হয়। উজ্জ্বল রঙ আর প্রতীকী নকশার মাধ্যমে হিন্দু দেব-দেবী, প্রকৃতি ও উৎসবের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়। এর প্রতিটি ইঞ্চি যেন এক গল্প বলে।
ওয়ার্লি চিত্র (মহারাষ্ট্র) : সরল রেখায় জীবনের ছন্দ মহারাষ্ট্রের ওয়ার্লি উপজাতিদের এই শিল্প খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দেরও পুরনো বলে ধারণা করা হয়। সাদা রঙে আঁকা সরল জ্যামিতিক আকার (ত্রিভুজ, বৃত্ত, বর্গক্ষেত্র) ব্যবহার করে তারা শিকার, নাচ, উৎসব আর দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য তুলে ধরে। এর সরলতা মনকে ছুঁয়ে যায়।
পট্টচিত্র (ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ) : পটচিত্র থেকে পিক্সেল ‘পট’ অর্থাৎ কাপড় আর ‘চিত্র’ মানে ছবি। কাপড়ের ওপর আঁকা এই স্ক্রল পেইন্টিংগুলোতে মূলত পৌরাণিক কাহিনি, বিশেষ করে ভগবান জগন্নাথ ও কৃষ্ণের লীলা ফুটিয়ে তোলা হয়। উজ্জ্বল রঙ আর সূক্ষ্ম কাজ এর বৈশিষ্ট্য।
গোণ্ড চিত্র (মধ্যপ্রদেশ) : প্রকৃতির বিন্দুময় গল্প মধ্যভারতের গোণ্ড উপজাতিদের এই চিত্র প্রকৃতি, প্রাণী এবং তাদের পৌরাণিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট বিন্দু আর রেখার মাধ্যমে জীবন্ত রূপ তৈরি করা হয়, যা যেন প্রকৃতির ছন্দকে তুলে ধরে। রামসিং শ্যামের মতো শিল্পীরা এই লোকশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন, যেন তারা প্রকৃতির প্রতিটি ফিসফিসকে ক্যানভাসে জীবন্ত করে তুলেছেন।
ভীল চিত্র (মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাট) : ভীলদের সহজ জীবনের কথা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি সম্প্রদায় ভীলদের চিত্রকর্ম তাদের সহজ জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও উপজাতীয় দেবতাদের নিয়ে তৈরি হয়। গাঢ় রেখা আর প্রাকৃতিক রঙে আঁকা এই ছবিগুলো যেন তাদের আত্মার প্রতিচ্ছবি।
কালামকারি (অন্ধ্রপ্রদেশ) : কলমের ছোঁয়ায় মহাকাব্য ‘কালাম’ অর্থাৎ কলম, ‘কারি’ অর্থাৎ কাজ। কলম দিয়ে হাতে আঁকা কাপড়ের ওপরের এই শিল্পকর্মগুলোতে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি বা পৌরাণিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়। প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হয়।
ফাদ চিত্র (রাজস্থান) : গানের তালে চলমান চিত্র এটি রাজস্থানের এক ধরনের স্ক্রল পেইন্টিং, যা লোকদেবতা পাবুজি বা দেবনারায়ণের বীরত্বগাথা বর্ণনা করে। ভোপারা (ঐতিহ্যবাহী পুরোহিত-গায়কেরা) এই চিত্রগুলো প্রদর্শন করতে করতে গান গেয়ে গল্প শোনান।
ভারতের এই হাজারো শিল্পধারা প্রমাণ করে যে, শিল্পের ভাষা স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন হলেও, মানুষের প্রকাশ করার আকাক্সক্ষা চিরন্তন।
ডিজিটাল জাদু : পিক্সেলের অসীম সম্ভাবনা
আর আজ কী অবিশ্বাস্য এক জগতে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা! গুহার পাথরের ক্যানভাস থেকে, রেনেসাঁসের সুবিশাল ফ্রেস্কো থেকে এবং ভারতের বিচিত্র লোকশিল্পের গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে, শিল্প এখন প্রবেশ করেছে এক নতুন জাদুকরী রাজ্যে ডিজিটাল আর্ট।
আমার কম্পিউটারই এখন আমার ক্যানভাস, আর মাউস বা স্টাইলাস আমার তুলি। ফটোশপ, প্রোক্রিয়েট, ব্লেন্ডারের মতো জাদুর বাক্সে আমি মুহূর্তেই নিজের কল্পনাকে রঙ দিতে পারি, ভাস্কর্য তৈরি করতে পারি, যা বাস্তবে না থাকলেও তার আবেদন অসীম।
কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো এআই আর্ট: তুলির বদলে কীবোর্ড। আমি শুধু কিছু শব্দ লিখি, হয়তো ‘মেঘে ঢাকা এক শহরের রাতের ছবি’, আর মুহূর্তের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (যেমন মিডজার্নি) হাজার হাজার পিক্সেলের সমন্বয়ে এমন এক চিত্রকর্ম তৈরি করে দেয়, যা দেখে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই। আমার নির্দেশ, আর মেশিনের জাদু মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে নতুন শিল্প, যা আগে কখনো ভাবা যায়নি।
কখনো মনে হয়, প্রাগৈতিহাসিক সেই শিল্পীরা যদি আজকের মিডজার্নি বা ডালি এআই দেখে ফেলত, অবাক হয়ে বলত ‘এই সব কী হলো? আমরা তো গুহার দেয়ালে হাতের ছাপ দিয়েই খুশি ছিলাম!’
শিল্পীসত্তার চিরন্তন ক্ষুধা
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, ‘এগুলো কি সত্যিকারের শিল্প?’ আমার হাসি পায়। শিল্পের সংজ্ঞা তো বারবার বদলেছে। ক্যানভাস থেকে স্ক্রিন, তুলির বদলে স্টাইলাস, মানুষের হাতের বদলে এআই-এর অ্যালগরিদম মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু শিল্পের মূল সুর বদলায়নি। সেই আদিম মানুষ যখন গুহার দেয়ালে আঁকছিল, তারও এক গভীর তাগিদ ছিল নিজেকে প্রকাশ করার। আজও, যখন এআই এক নিমিষে শত শত ছবি তৈরি করে, তার পেছনে থাকে মানুষের নির্দেশ, মানুষের কল্পনা।
গুহাচিত্র হোক বা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির ৩৬০ ডিগ্রি পেইন্টিং শিল্প আমাদের বলে আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি, কী ভাবি, কী নিয়ে স্বপ্ন দেখি। যুদ্ধ, প্রেম, বেদনা, আনন্দ, প্রতিবাদ, কিংবা নিছক সৌন্দর্য সব কিছুই তো আমরা শিল্পে রেখে দিই, যেন পৃথিবী আমাদের গল্প মনে রাখে।
ভবিষ্যতের শিল্প?